...............................................................................................................................................................।
বেশ কিছুদিন আগে এই বিষয়টি নিয়ে একটি লেখা পোষ্ট করেছিলাম। ধারাবাহিকতার চিহ্ন তুলে ধরে শেষ অবধি যেন আমি হারিয়েই গেলাম। আসলে এভাবে যেকোন বিষয়কে একেবারে অসমাপ্ত পর্যায়ে রেখে বেশকিছুদিন এমন উধাও হওয়া মোটেও আশাব্যঞ্জক বা সুবিধার কথা নয়। নিয়মিত পাঠকদের জন্য এ এক বিরক্তিও বটে,ফলে দীর্ঘদিন পর ঐ বিষয়টির বাকি অংশ পড়ার আর তেমন ইচ্ছে নাও জাগতে পারে তা-ই স্বাভাবিক।
আসলে ব্যস্ততা,অসুস্থতা সব কিছুমিলিয়ে এই কিছুদিন একেবারেই খুব অস্বস্তিতে কেটেছে,তাই লিখা হয়নি বা লিখার সেই মানসিকতাটূকু একটু দূরে ছিল বলা চলে। তবুও তাই বলে পাঠকের তালিকা থেকে নিজেকে বাদ দিইনি;সময় সুযোগে লিখতে না বসলেও বদলেও যাও বদলেও দাও-এ চোখ বুলাতে ভুল হত না। এই দীর্ঘ বিরতির জন্য প্রথমেই ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি পাঠকদের কাছে।
এবার প্রসঙ্গে আসা যাক- ‘বিদেশ’ শব্দটা আমাদের কাছে খুব আনন্দের একটা শব্দ। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ছাত্রছাত্রী, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার সাথে সাথেই স্বপ্ন আকতে শুরু করেন ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোকে নিয়ে,সে স্বপ্ন হতে পারে উচ্চ ডিগ্রির অর্জনের কিংবা উচ্চ ডিগ্রির নামে ভবিষ্যতের রুপ রেখা আকার; আর নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা যারা উত্তারাধিকার সুত্র ধরে ছোটবেলা থেকেই নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকেন বিদেশের জন্য, কোন রকম স্কুলের গন্ডিটা পার করলেই তারা নিজেদের যথেষ্ট মনে করে, কেননা ছেলে একটু বড় হলেই বিদেশে থাকা বাবা বা বড় ভাই থেকে সেখানে যাওয়ার ডাক চলে আসে, নির্দেশ মত কোন একটি বিষয়ের উপর কারিগরি প্রশিক্ষণ বা কোন কাজের উপর একটু দক্ষতা নিয়েই গৌরবের সহিত বিদেশে পা পাড়ায়।
তারা জানে বিদেশ ছাড়া তাদের ভবিষ্যত নেই,তাই দেশে থাকা অবস্থায় নিজেদের তারা সেরা বখাটে বা কোন রাজনীতৈক দলের নেতার সেরা অনুসারী করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। বিদেশে পাড়ি দেয়ার দলে এই দুই শ্রেণীর লোকের সংখ্যাই বেশি। তবে ইদানীংকালে শিক্ষিত তরুনদের মাঝে এই বিদেশপ্রীতি বেশ লক্ষনীয়। এর প্রধান দুইটা কারন,
এক,দেশে বিদেশী ডিগ্রীর কদর বেশি আর দুই,ভবিষ্যত নিয়ে শংকা তথা চাকুরী সুযোগের স্বল্পতা। আর সাধারন শ্রমিক হয়ে যারা পাড়ি জমাতে চাইছেন তারা মনের মধ্যে গেথেই নিয়েছেন,যে এই দেশে পরিশ্রম করে কোন লাভ হবেনা,পরিশ্রমের সঠিক মুল্য পাওয়া যায়না।
আর বিদেশের মাটিতে কলুর বলদের মত খাটলেও সেখানে তারা স্বস্তির মুজুরি পাবেন বলে আশা। সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরতে না পারলেও শুধু মাত্র নিরেট শ্রমিক হয়ে বিদেশ পাড়ি জমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণঞ্চলের জনগনের আধিক্যটা বেশ লক্ষ্য করার মত, বিশেষ করে নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাম্মনবাড়িয়া, চাঁদপুর, ফেনী, ভোলা, বরিশাল এ জায়গাগুলোতে এর হারটা প্রকট আর বাংলাদেশের লন্ডনপাড়া তথা সিলেটের কথাতো সবারই জানা। হিসেব করলে দেখা যাবে গড়ে প্রতিটি পরিবারে একজন করে সদস্য দেশের বাহিরে থাকেন। আমাদের শ্রমিকেরা বিশ্ববাজার কাঁপিয়ে তুলছে কিংবা আমাদের ছাত্র বিদেশের মাটিতে বড় বৈজ্ঞানিক হয়ে নব আবিষ্কারে বিশ্বের দৃষ্টির সম্মুখে এসে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। উচ্চডিগ্রি অর্জনের পর অধিকাংশই আর দেশে ফিরতে চান না।
সেখানেই নিজেদের জীবন বেছে নেন; তারপর তাদের বড় কোন অর্জনের পর যখন আমরা সংবাদ মাধ্যমে শুনি তিনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কোন নাগরিক, তাতেই আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি।
আমরা কি এতেই বেশি তৃপ্ত থাকবো? নাকি যখন আমাদের জনশক্তিকে আমাদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধশালী দেশে পরিনত করে বিশ্বকে তাক লাগাব কিংবা আমাদের মেধাকে আমাদের দেশে কাজে লাগিয়ে তার গবেষণার সব রকম সুবিধাদি নিশ্চিত করে তার সেরা আবিষ্কারে সহায়তা করে তাকে বড় বিজ্ঞানীর পরিচয় দিয়ে তাকে এবং দেশকে বিশ্বের দরবারে নতুন ভাবে পরিচয় করিয়ে দেব, আমাদের শক্তির প্রমান দিব বিশ্বের দরবারে? এই বোধটুকু বুঝতে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথা সরকারের এবং সেই সাথে আমাদের শিক্ষিত তরুণদের। উচ্চশিক্ষা যদি মাতৃভূমির কল্যানেই না লাগানো যায়, তবে এর মাঝে অহমিকা নেই। দেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার জায়গাগুলো আমদেরই বুঝতে হবে, তবে নিসন্দেহে এর জন্য সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের বিকল্প নেই।
আমাদের এখনি খুঁজে বের করতে হবে,আমাদের দূর্বলতার জায়গাগুলো কোথায়? কেন আমাদের মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে? কেন আমাদের জনশক্তিকে আমরা দক্ষ করে তুলে আমাদের মাটিতে কাজে লাগাতে পারিনা? অথচ তারা ঠিকই বিদেশের মাটিতে অনেক ঝুকিপূর্ণ কাজ সানন্দে গ্রহন করে নিচ্ছে, আমাদের শ্রমিকদের হাতে গড়া বহুতল বিল্ডিং টিকে থাকে যুগের পর যুগ আর আমাদের মাটিতে ছয়মাস না যেতেই ফাটল ধরে।
কেন আমাদের সাধারন নিম্নমধ্যবিত্তরা নিজেদের বসতভিটা, সহায়-সম্বল বন্ধক রেখে বিদেশে যাবার স্বপ্ন বুকে বাধেন? নিঃসন্দেহে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কোন কঠিন বিষয় নয়। আমাদের বোধহয় আর বিলম্ব করা উচিত হবেনা, কেননা আমরা এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছি। আমরাও এতদিনে ইচ্ছে করলে ‘চিন দেশ’ হয়ে যেতে পারতাম। আমাদের আর তাদেরকে অনুসরণ করতে হতনা,আমাদের তখন অনুসরণ করত অন্য কোন দেশ। আমরা কি কেবল অন্য দেশকে অনুসরণকারী দেশ হয়েই থাকবো, কখনো অন্য দেশের অনুসরনকারী দেশ হয়ে থাকব না?
আমাদের উপরমহলের কর্মকর্তারা রেমিট্যেন্সে মুগ্ধ হয়ে এ বিষয়টির দিকে মোটেও দৃষ্টিপাত করছেন না কিংবা প্রয়োজনও মনে করছেন না, বিষয়টি নিয়ে যে একটুখানি ভাববার প্রয়োজন সেটিও তারা তাদের চিন্তার মধ্যে আনতে নারাজ।
বিদেশের মাটিতে ক্রমাগত হারে চলে যাওয়া মানে দেশে চাকুরির সুযোগ বৃদ্ধি নয়, দেশে খাদ্য ঘাটতি কমে যাওয়া নয়, জনসংখ্যার চাপ কমে যাওয়া নয়, আবাদী জমি কমে গিয়ে বসতভিটা বেড়ে যাওয়ার হার কমে যাওয়া নয়! যারা ভাবছেন আমাদের জনশক্তি বিদেশে যাওয়া মানে একটুখানি স্বস্তির আভাস! এ বড় ভুল ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া কিছু নয়। বরঞ্চ এটা আমাদের সামগ্রিক দেশের জন্য বিরাট হুমকি। এই জনস্রোতকে এখুনি রুখতে হবে, এর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষ বিদেশে যাবে…তা উচ্চ শিক্ষার জন্যই হোক আর নিরেট শ্রমিক হয়েই হোক কিন্তু তা যেন সীমার পর্যায়ে থাকে। কেউ যেন দিশেহারা না হয়ে দেশ ত্যাগে উদ্বুদ্ধ না হয় সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
আর অতিমাত্রায় বিদেশপাড়ির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পর থেকে বেড়ে গেছে দালালের উতপাত।
একশ্রেণীর অসাধু, লোভী চক্র তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে টাকা-কড়ি সব হাতিয়ে নিচ্ছেন। নিজেদের শেষ সম্বল বসতভিটা বিক্রি করে দালালের হাতে টাকা জমা দিয়ে বিদেশের স্বপ্ন বুকে লালন করছেন আর দালাল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঘুরিয়ে তাকে তখনো স্বপ্ন দেখান, অথচ ততক্ষণে সহায়সম্বল হারিয়ে এমন অনেক পথে বসেছে। আবার কেউবা দালালের ক্ষপ্পরে পড়ে বিদেশভূমিতেই প্রতারিত হচ্ছেন, নানা অত্যাচার আর নিপীড়নের শিকার হয়ে সেখানেই দূর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন আর দেশে বসে বৃদ্ধ বাবা মাকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে নিত্যদিন কাঁদতে হচ্ছে ছেলের নিরাপত্তা কামনায়, টাকা-পয়সার দিকে তাদের খেয়াল নেই, দিনরাত প্রার্থনায় মশগুল থাকেন সন্তান যেন বেঁচে থাকে এক্টুখানি খবর যেন মিলে কিংবা স্ত্রীকে এমন প্রতীক্ষা করতে হচ্ছে স্বামীর জন্য। মানুষের বাড়িতে বান্দির মত খেটে যাচ্ছেন কেবল সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে।
এমন অনেক পরিবার দেশের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে, মুখ ঠুকরে কেঁদে চলছে দিনরাত। এদের কান্না কি কেউ শোনার নেই?
রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বমুখী চিত্র কি এসব নিপীড়িত মানুষের কাঁন্নাকে ঢেকে দিয়েছে? বিষয়টির দিকে অতিবিলম্বে জোর দৃষ্টিপাত করার জন্য অনুরোধ করছি। আশা করছি সংশ্লিষ্টরা বিষয়টির দিকে গভীর মনোযোগের সহিত দৃষ্টিপাত করবেন। দেশীয় শিক্ষার মানকে বৃদ্ধি করে, উচ্চশিক্ষার ব্যপক সুযোগ সৃষ্টি করে, দেশীয় মেধায় আস্থা রেখে গবেষণা চর্চা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে, জনশক্তিকে বোঝা না ভেবে তাদের সঠিক ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করে দেশের উপর সব ধরনের মানুষের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে এই বিদেশ পাড়ির প্রবনতাকে লাগাম টেনে ধরতে হবে।
আমরা চাই না একটা ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় গন্ডি পেরিয়ে চাকুরি অনিশ্চয়তায় ঘুমহীন রাত কাটাক,আমরা চাইনা জন্ম লাভের পর কোন শিশু বিদেশ নির্ভরশীলতায় বেড়ে উঠুক, আমরা চাইনা দুবেলা দুমুঠো অন্নের অভাবে পিতা তার সর্বস্ব বিক্রি করে সন্তানের হাত থেকে বই-খাতা কেড়ে নিয়ে বিদেশে যাবার পাসপোর্ট হাতে ধরিয়ে দিক,আমরা চাই না সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায়ই পিতাকে সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে অধিক চিন্তিত হতে, শুধুমাত্র দেশে ভালো কিছু করার অভাববোধ থেকে সন্তানকে বিদেশ পাঠানোর জন্য টাকা-পয়সা যোগাড় করতে হন্য হয়ে পড়ুক,…আমাদের অনেক চাওয়া থাকতে পারে, আমাদের অনেক চাওয়া থাকবে, চাওয়ার কখনো শেষ হতে পারে না, সন্তান যতই ভালো পথে চলুক মা বাবা সবসময় কামনা করে ছেলে যেন আরো ভালো হয়ে চলে,খারাপ পথে না যায়।
একটি দেশ যতই স্বনির্ভর থাকুক তবুও তার আরো স্বনির্ভর হওয়ার অনেক চাওয়া থাকতে পারে। আর আমরা তো অনেক দূরে, আমাদের তো কেবল চাওয়া আর চাওয়া, কেননা আমরা যে এখনো কেবল দাঁড়াতে শিখছি, এখনো দাঁড়াতে পারিনি, আমরা দাঁড়াবো, স্বনির্ভর হব, আমাদের স্বনির্ভরতকে আরো দৃঢ় করতে অনেক চাওয়া ব্যক্ত করবো। আমাদের রাজনীতি এখনো স্থিতিশীল নয়, আমরা ক্ষমতার লোভে মরিয়া, কে শুনবে কার কথা? তাদের এত সময় কোথায় এসব সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবার? বলতে দ্বিধা নেই, দেশীয় স্বার্থকে ঊর্ধ্বে রেখে রাজনীতি করতে এখনো শিখেনি আমাদের রাজনীতিবিদরা, এ বড়ই লজ্জার। তবুও আশা রাখি, তাদের বোধদয় হবে এমন আশায় বুক বেঁধে রাখি।
চারিদিকে বিজ্ঞানের প্রসার, বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে, বিশ্বকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে দেখে নিজেদের পশ্চাদপদতাকে মনে করে নিশ্চয়ই এতদিনে কিছুটা হলেও লজ্জা বোধ করছেন আমাদের রাজনীতিবিদেরা।
তাদের ঝগড়া মেটাবার জন্য তৃতীয় পক্ষ হস্তক্ষেপ করছে এ বড়ই লজ্জার, আমরা জাতি হিসেবে লজ্জিত, আর তারা এর ধারক হয়ে নিশ্চয়ই আরো বেশি লজ্জিত হওয়ার কথা। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাবার রীতি থেকে সরে এসে নিজেদের আদর্শের সংস্কার করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে, আপনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন,আপনার সন্তানও এ দেশের রাজনীতিকে ঘৃণা করছে। আমরা বড়ই বেহায়া এত অসংগতি দেখেও আপনাদের উপরই আবার আস্থা রাখি,হয়ত আবারও রাখব,আবারও রাখতে হবে, নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে মনে শুভবোধ জাগ্রত হবে হয়ত এই টুকু দেখে যাবার প্রত্যাশায়। কবে হবে ভেবে পাই না। আদৌ হবে কিনা তাও জানি না।
তবে শুধু রাত-বিরাতে কল্পলোকে ছবি আঁকি একটি সুন্দর, সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।