আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আগাম আভাস কি পাওয়া যাচ্ছে?

এ মাসের ২২ তারিখে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘রাজশাহীতে হঠাৎ হামলা-জখম’। একই দিন যুগান্তর-এ প্রকাশিত খবরটির শিরোনাম ছিল ‘রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের সিট দখলে নেমেছে ছাত্রদল-শিবির’। খবর দুটির শিরোনাম ও ভেতরের বিভিন্ন উদ্ধৃতি থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার সারসংক্ষেপ দাঁড়ায়, রাজশাহীতে বিএনপি-সমর্থিত নবনির্বাচিত মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকেই ছাত্রদল-যুবদল-শিবির নতুন করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে এবং নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধারে সক্রিয় তৎপরতা শুরু করেছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৮ সেপ্টেম্বর। ওই দিনই সন্ধ্যায় নগরের আলুপট্টিতে মিছিলের আয়োজনের সময় একাত্তর মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাফিকুল আলমকে লক্ষ্য করে শিবিরের কর্মীরা ককটেল নিক্ষেপ করেন।

একই রাতে পঞ্চবটী এলাকায় ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির রাজশাহী কার্যালয়ে অবৈধ গ্যাস-সংযোগের দাবিতে হামলা চালান ছাত্রদলের কর্মীরা। এদিকে নতুন মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই রাজশাহী কলেজ মুসলিম হোস্টেলে সিট দখলে নামে ছাত্রদল। তারা চাঁদাবাজিও শুরু করে। এভাবে নগরজুড়ে ঘটতে থাকে বিভিন্ন ঘটনা।

ছাত্রদল-যুবদলের পাশাপাশি ছাত্রশিবিরের তৎপরতাও নতুন মাত্রা পায়। তারা বিনোদপুরে ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর হামলা চালায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।
হামলা-জখম, চাঁদাবাজি-দখলবাজির নৈমিত্তিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে এই ঘটনাগুলো নতুন মাত্রার সংযোজন এবং সবই রাজশাহী মহানগরের ঘটনা। রাজশাহী ছাড়া আরও চারটি সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরাই মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। কাজেই, এসব স্থানেও পরিস্থিতির ব্যত্যয় ঘটবে, এমন ভাবার কারণ আছে বলে মনে হয় না।


জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হওয়ায় সে নির্বাচনের ফলাফলের প্রতিফলন সংসদ নির্বাচনেও ঘটবে, এমন আস্থা বিএনপি তথা ১৮-দলীয় কর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ নির্বাচন কখন হবে, তা নিয়ে যেমন সংশয় আছে, তেমনই নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও আগাম মন্তব্য করার সময় আসেনি। তবে ১৮-দলীয় জোটের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার অগ্রিম প্রত্যাশাকে ধ্রুব ধরে নেওয়া হলে বলাই যায় যে ক্ষুদ্রের মধ্য দিয়ে বৃহৎকে এখনই দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ রাজশাহী মহানগরের গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমেই ভবিষ্যতে সারা দেশের পালাবদল-পরবর্তী চিত্র আঁচ করা যাচ্ছে। ক্ষমতায় আসার আগের অবস্থাই যদি এই হয়, ক্ষমতাসীন হওয়ার পরের পরিস্থিতি কী হবে—তা ভেবে উৎকণ্ঠিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।


বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যসংগঠন অনুশীলন নাট্যদলের পক্ষ থেকে একটা ব্যানার নিয়ে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। সেই ব্যানারে লেখা ছিল, ‘হল দখল পদ দখল নয়, মানুষের কাছে চলো’। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকও সেদিন নাট্যকর্মীদের সঙ্গে রাস্তায় নেমেছিলেন। ব্যানারসহ রাস্তায় দাঁড়ানোর ছবি তখন বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হলে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকে এই ঘটনাকে সাহসী ও সময়োপযোগী বলে প্রশংসা করলেও কেউ কেউ ১৪-দলীয় জোট সরকার সম্পর্কে আমাদের আগাম আশঙ্কার নিন্দা করেছিলেন।

আমরা হঠাৎ ওই ‘কাণ্ডটি’ কেন করলাম, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে। প্রশ্ন উত্থাপনকারী ব্যক্তিরা সে সময় সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাত্র দুই বছরের মধ্যে তার আগের ১৫ বছরের চিত্র কী করে ভুলে গিয়েছিলেন, তা ভেবে আমরা তখন বিস্মিত হয়েছিলাম।
আসলে গত শতকের নব্বই-পরবর্তী তিনটি গণতান্ত্রিক সরকার আমলের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। আর সে দাঁড়ানোর ফলাফল কী হয়েছে, তা গত পাঁচ বছরে মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা পাল্টে যাওয়ার ব্যাপারটা তো এখন একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গেছে।

সম্ভবত বেশির ভাগ মানুষ এতে কিছু মনেও করে না। তারা ক্রমবর্ধমান এই প্রক্রিয়াকে বোধ করি মেনেই নিয়েছে। আর মেনে নেওয়ার ফলটি হয়েছে এই যে দখলকারীরা দখলের আওতা বাড়াতে বাড়াতে দেশের সাধারণ মানুষকেও তাঁদের নিজের সম্পত্তি বিবেচনা করছেন। সাধারণ মানুষের বোধবুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা, স্বাধীনতা-অধিকার, মতামত, কাজকর্ম, খাওয়া-শোয়া—সবই তো এখন দখলকারীদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের ব্যানারে লেখা সেদিনের কথাগুলো আজ এক নির্মম পরিহাসে পরিণত হয়েছে।

এখন দখলকারীদের কেউ হয়তো বলেও ফেলতে পারেন, ‘কেন, সেদিন তোমরা ব্যানারে যে কথা বলেছ, আমরা সে কথাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। তোমরা বলেছিলে—হল দখল পদ দখল নয়, মানুষের কাছে চলো, আমরা তো দখলের আওতা বাড়িয়ে মানুষকেই দখলে নিয়ে নিয়েছি!’
রাজশাহীর নবনির্বাচিত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন দায়িত্ব গ্রহণের দিন মহানগরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে একটি গুচ্ছ খুদেবার্তা পাঠান। খুদেবার্তায় তিনি ওই নাগরিকদের কাছ থেকে উপদেশ, সহযোগিতা ও সমালোচনা প্রত্যাশা করেছেন। খুদেবার্তার জের ধরেই তাঁর উদ্দেশে কিছু কথা নিবেদন করতে ইচ্ছা হচ্ছে। আশা করি, কথাগুলো তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না।

রাজশাহীতে হঠাৎ হামলা-জখম এবং ছাত্রলীগের ওপর শিবিরের হামলা বিষয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদক আবুল কালাম মোহম্মদ আজাদের প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলছেন, ‘ওরা আমাদের ছেলেদের ওপর হামলা করছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল-মিটিং পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না, রুয়েটে দিচ্ছে না, মেডিকেল কলেজে দিচ্ছে না। এভাবে কি গণতন্ত্র চর্চা করা যায়?’ (প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর)। মেয়রের কাছে সবিনয়ে দুটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই। তাঁর এই বক্তব্যটি মেয়রসুলভ, না দলীয়? মেয়রকে আরও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রথম আলো প্রতিবেদকের কাছে তিনি এই মন্তব্য করেছেন ২১ সেপ্টেম্বর। অথচ এর ঠিক তিন দিন আগে ১৮ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব গ্রহণের সময় তিনি নিজ দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বলছেন, ‘আপনারা সিটি করপোরেশনের কার্যালয়ে অযথা ভিড় করবেন না।

আপনাদের জন্য আমার বাসা রয়েছে। দলীয় কার্যালয় রয়েছে। সেখানে আমি আপনাদের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করব। ’ (প্রথম আলো, ১৯ সেপ্টেম্বর)। মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে মেয়র স্ববিরোধী বক্তব্য দিলেন না কি?
স্মরণ করা যেতে পারে, দায়িত্ব গ্রহণকালে মেয়র আরও কী বলেছেন।

তিনি বলছেন, ‘আসুন এই সবুজ নগরকে আমরা আরও সবুজে পরিণত করি, যেখানে সারা বছর ফুল ফুটে থাকবে। শান্তির নগরকে বিশ্বের মডেলে পরিণত করি, যাতে অন্য দেশ তা অনুসরণ করে। আমি এই নগরের পিতা নয়, সেবক হতে চাই। সিটি করপোরেশনের সেবার দ্বার সব সময় উন্মুক্ত থাকবে। ’ আমাদের প্রশ্ন, মেয়রের এই উদার ও বিচক্ষণ বক্তব্য কি কেবল কথার কথা হয়েই থাকবে? মেয়রের কাছে দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, ওরা করেছে, অর্থাৎ ছাত্রলীগ করেছে, আওয়ামী লীগ করেছে, ১৪ দল করেছে, তাই আমরাও করছি—এটা কি শান্তির নগর প্রতিষ্ঠার পক্ষে কোনো যথার্থ যুক্তি? এটা তো প্রতিহিংসাপরায়ণতা।

না, এই প্রশ্ন কেবল রাজশাহী সিটি মেয়রের কাছে নয়, দলমত-নির্বিশেষে এ প্রশ্ন সব ক্ষমতাসীনের কাছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ‘ওরা করেছে, তাই আমরাও করছি’—এমন বক্তব্য বারবার উপস্থাপনের মাধ্যমে আসল সত্য এবং যুক্তিবিদ্যার সাধারণ নিয়মকে অস্বীকারের দৃষ্টান্তই স্থাপন করে চলেছি। এতে দেশের অনেক সাধারণ মানুষ প্রকৃত যুক্তি নয়, কুযুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে—দেশ ও জাতি অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে এমন যুক্তিহীন ভাবাবেগে তাড়িত করার দায় রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে।
নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি সাধারণ ঘটনা।

তাই বলে পালাবদলের পাশাপাশি দখল-বদল ঘটবে, এটা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারে না। দেশের সাধারণ মানুষকে এভাবে বেশি দিন দখল করে রাখা সম্ভব নয়—এ কথা রাজনীতিবিদেরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। আমরা প্রত্যাশা করি না, সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের ঘটনাটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হোক। আমরা এও চাই না, মেয়র নির্বাচন-পরবর্তী রাজশাহীর মধ্য দিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশকে দেখা যাক।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।