বদলী হজ্বের মাসায়েল
হজ্ব একটি কঠিন ইবাদত। একে জিহাদের সাথেও তুলনা করা হয়েছে। এ কারণে এতে ছওয়াবও বেশি এবং উপকারিতাও অনেক। বিধানগত দিক থেকে হজ্ব আদায় করা সহজ, কিন্তু যেহেতু এর জন্য সফর করতে হয় এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জমায়েত বিশেষ বিশেষ স্থানে একসাথে এই ইবাদত আদায় করে থাকে তাই তা কঠিন ও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে অনেক মানুষের আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও শারীরিক অক্ষমতার কারণে তা আদায়ের সামর্থ্য থাকে না।
এ ধরনের মাজুরদের প্রতি মেহেরবানী করে আল্লাহ তাআলা বদলী হজ্বের অবকাশ দান করেছেন।
বদলী হজ্বের নাম শুনলেই অনেকে মনে করতে পারেন তা আদায়ের জন্য বোধ হয় আলাদা কোনো নিয়ম আছে। তা ঠিক নয়। যেভাবে নিজের হজ্ব আদায় করা হয় সেভাবেই বদলী হজ্বও আদায় করা হয়। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, নিয়ত ও তালবিয়ার সময় বদলী হজ্বে প্রেরণকারীর পক্ষ থেকে হজ্বের নিয়ত করা হয়।
এরপর হজ্বের সকল কাজ এক ও অভিন্ন।
হজ্বের নিয়ম এক হলেও বদলী হজ্ব সংক্রান্ত কিছু বিষয় এমন আছে, যা বদলী হজ্বে প্রেরণকারী ও প্রেরিত উভয়েরই জানা থাকা জরুরি। বর্তমান নিবন্ধে ঐ মাসআলাগুলোই উল্লেখ করা হয়েছে।
বদলী হজ্বের জরুরি মাসায়েল
মাসআলা : যার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে এবং হজ্ব আদায়ের শারীরিক সক্ষমতাও আছে তার নিজে হজ্ব করা জরুরি। এক্ষেত্রে অন্যকে দিয়ে বদলী হজ্ব করানো জায়েয নয়।
বদলী করালে এর দ্বারা তার ফরয হজ্ব আদায় হবে না। -হিদায়া ১/২৯৬; আলবাহরুল আমীক ৪/২২৩৯; বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৫৪
মাসআলা : যার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে এবং হজ্ব আদায়ের সক্ষমতাও ছিল, কিন্তু শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্ব করেনি। অতপর হজ্ব আদায়ের সক্ষমতা হারিয়ে মাজুর হয়ে পড়েছে এমন ব্যক্তির উপর ফরয নিজের পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করানো অথবা মৃত্যুর সময় তার পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করানোর অসিয়ত করে যাওয়া।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, বিদায় হজ্বে খাছআম গোত্রের একজন নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে, কিন্তু তিনি এত বৃদ্ধ যে, বাহনের উপর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেন না। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্ব করতে পারব?’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ।
(তার পক্ষ থেকে হজ্ব করতে পারবে)। ’-সহীহ বুখারী ১/২০৫; সহীহ মুসলিম ১/৪৩১
হযরত আলী রা. অতিশয় বৃদ্ধ লোক সম্পর্কে বলেছেন-
يُجَهِّزُ رَجُلاً بَنَفَقَتِهِ فَيَحُجُّ عَنْهُ
সে তার পক্ষ থেকে হজ্ব করাবে এবং এর খরচ বহন করবে। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮/৫৯৯
দেখুন : আলবাহরুল আমীক ৪/২২৬১; মানাসিক, মোল্লা আলী কারী ৪৩৪
মাসআলা : কারো উপর হজ্ব ফরয হয়েছে এবং সে হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফে পৌঁছেছে, কিন্তু হজ্বের মূল সময়ের আগেই তার মৃত্যু এসে গেছে-এই ব্যক্তির জন্য মৃত্যুর সময় তার পক্ষ থেকে বদলী হজ্বের অসিয়ত করার প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে তার উপর থেকে হজ্ব রহিত হয়ে যায়। কেননা, সে হজ্ব আদায়ের সুযোগ পায়নি।
-ফাতহুল কাদীর ২/৩২৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৬০৪; গুনইয়াতুন নাসিক ৩৩
যেসব কারণে নিজে হজ্ব আদায়ে অক্ষম গণ্য হয়
১. ফরয হওয়ার পর আদায়ের সুযোগ পাওয়ার আগেই মৃত্যু এসে গেলে। এ ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি থেকে হজ্ব রহিত হয়ে যায়। সুতরাং তার জন্য মৃত্যুর সময় হজ্বের অসিয়ত করে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
২. কেউ জোরপূর্বক আটকে রাখলে বা হজ্বের সফরে যেতে না দিলে।
৩. এমন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে, যা থেকে সুস্থতা লাভের আশা নেই।
যেমন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে, অন্ধ বা খোড়া হয়ে গেলে কিংবা বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা এত বেশি হলে যে, নিজে বাহনের উপর আরোহন করতে
পারে না।
৪. রাস্তা অনিরাপদ হলে। অর্থাৎ সফর করতে গেলে যদি জান-মালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
৫. নারী তার হজ্বের সফরে স্বামী বা উপযুক্ত মাহরাম পুরুষ সঙ্গী না পেলে।
এসব কারণে ঐ ব্যক্তিকে মাজুর বা অক্ষম গণ্য করা হবে এবং সে নিজের পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করাতে পারবে।
-মানাসিক, মোল্লা আলী কারী ৪৩৫; গুনইয়াতুন নাসিক ৩২১
মাসআলা : যার পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করা হবে বদলী করানোর সময় তার উপর হজ্ব ফরয হতে হবে। হজ্ব ফরয না হওয়া অবস্থায় নিজের পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করালে তা নফল হজ্ব বলে গণ্য হবে এবং এর দ্বারা ফরয হজ্ব আদায় হবে না। সুতরাং পরবর্তীতে হজ্বের সামর্থ্য হলে তাকে নিজের ফরয হজ্ব আদায় করতে হবে। আর নিজে আদায় করতে না পারলে পুনরায় অন্যকে দিয়ে বদলী করাতে হবে। -মানাসিক, ৪৩৫
মাসআলা : যেসব ওজরে বদলী হজ্বের অনুমতি আছে সেগুলো দেখা দেওয়ার আগে বদলী হজ্ব করানোর যাবে না।
ওজরহীন অবস্থায় বদলী হজ্ব করালে তা হবে নফল হজ্ব। এর দ্বারা তার ফরয হজ্ব আদায় হবে না। যেমন কারো উপর হজ্ব ফরয হয়েছে এবং তার নিজে হজ্ব আদায়ের শারীরিক সক্ষমতাও আছে, কিন্তু সে এ অবস্থায় নিজে আদায় না করে অন্যের দ্বারা বদলী করিয়েছে তাহলে এর দ্বারা তার ফরয হজ্ব আদায় হবে না। সুতরাং তাকে ঐ হজ্ব নিজে আদায় করতে হবে। যদি নিজে আদায় না করে এবং পরে অক্ষম হয়ে পড়ে তাহলে পুনরায় অন্যের দ্বারা বদলী হজ্ব করাতে হবে, আগের বদলী যথেষ্ট হবে না।
-বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৫৫; মানাসিক ৪৩৬; গুনইয়াতুন নাসিক ৩২
মাসআলা : হজ্ব আদায়ে অক্ষমতার ওজর দুই ধরনের হতে পারে : ক) যা দূর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। খ) স্বাভাবিক অবস্থায় যা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
যে ওজর দূর হওয়ার সম্ভাবনা আছে যেমন অসুস্থ, পাগল বা কারাবন্দি হওয়া; স্বামী বা মাহরাম পুরুষের ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বদলী হজ্ব জায়েয হওয়ার জন্য শর্ত হল, ওজরটি মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী হতে হবে। সুতরাং এ ধরনের ওজরে বদলী হজ্ব করানোর পর যদি ঐ ওজর অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয় তাহলে তার ফরয হজ্ব আদায় হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে বদলী হজ্ব করানোর পর মৃত্যুর আগে ওজর দূর হয়ে গেলে ঐ হজ্বটি নফল হয়ে যাবে এবং তাকে নিজের ফরয হজ্ব আদায় করতে হবে।
আর দ্বিতীয় প্রকারের ওজর, অর্থাৎ যা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই, যেমন অন্ধ বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়া। এক্ষেত্রে বদলী হজ্ব জায়েয হওয়ার জন্য তা মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী হওয়া শর্ত নয়। অর্থাৎ এ জাতীয় ওজরের কারণে অন্যের দ্বারা বদলী হজ্ব করানোর পর আল্লাহ তাআলার খাছ কুদরতে যদি দৃষ্টিশক্তি বা চলৎশক্তি ফিরে পায় তাহলে তাকে পুনরায় ফরয হজ্ব করতে হবে না। পূর্বের বদলী হজ্বের মাধ্যমে তার ফরয হজ্ব আদায় হয়ে গেছে। -আলবাহরুর রায়েক ৩/৬১; রদ্দুল মুহতার ২/৫৯৯; গুনইয়াতুন নাসিক ৩২১; যুবদাতুল মানাসিক ৪৪৮
মাসআলা : মাহরাম পুরুষ ছাড়া মহিলাদের হজ্বের সফরে যাওয়া জায়েয নয়।
অন্য মহিলাদের সঙ্গী হয়েও হজ্বে যাওয়া নাজায়েয। তারা স্বামী বা মাহরাম পুরুষের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। যদি মাহরাম পুরুষের ব্যবস্থা না হয় আর এভাবেই এমন বার্ধক্য এসে যায় যে, নিজে হজ্ব করার শক্তি না থাকে তাহলে ঐ সময় কাউকে পাঠিয়ে বদলী হজ্ব করিয়ে নিবে বা বদলী হজ্বের অসিয়ত করে যাবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো নারী মাহরাম ছাড়া সফর করবে না। ’ জনৈক ব্যক্তি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি অমুক অমুক বাহিনীর সাথে জিহাদে যাওয়ার ইরাদা করেছি।
এ দিকে আমার স্ত্রীও হজ্বে যাওয়ার ইচ্ছা করেছে (আমি এখন কী করতে পারি?) রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমিও তার সাথে (হজ্বে) যাও। ’-সহীহ বুখারী ১/২৫০; সহীহ মুসলিম ১/৪৩৪
বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেছেন, ‘নারী মাহরাম ছাড়া হজ্ব করবে না। ’
রাই-এর অধিবাসিনী একজন নারী ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর নিকট পত্র লিখলেন যে, তিনি একজন বিত্তবান নারী। কিন্তু তার স্বামী নেই এবং কোনো মাহরাম পুরুষও নেই। আর ইতিপূর্বে তিনি হজ্ব করেননি।
(এখন তিনি কি স্বামী বা মাহরাম ছাড়া হজ্বে যেতে পারবেন?) উত্তরে ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. লিখেছেন-
إِنَّ هَذَا مِنْ أَمْنِ السَّبِيْلِ الَّذِيْ قَالَ اللهُ، وَلَيْسَ لَكِ مَحْرَمٌ فَلاَ تَحُجِّيْ إِلَّا مَعَ بَعْلٍ أَوْ مَحْرَمٍ.
‘মহিলাদের জন্য স্বামী বা মাহরাম পুরুষের ব্যবস্থা হওয়া হজ্বের সামর্থ্যের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের এই আয়াতে বলেছেন-
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (কাবা ঘরে) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের উপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ্ব করা ফরয। (সূরা আলে ইমরান : ৯৭) আপনার তো মাহরাম পুরুষ নেই। স্বামী বা মাহরাম ছাড়া আপনি হজ্বে
যাবেন না। ’
অনুরূপ সিদ্ধান্ত তাউস, আমের, ইকরামা ও উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. প্রমুখ বিখ্যাত মনীষী তাবেয়ীদের থেকেও বর্ণিত আছে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮/৬৩৬-৬৪১)
-ফাতহুল কাদীর ২/৩৩০; মানাসিক ৪৩৬; আলবাহরুর রায়েক ২/৩১৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৬৫
মাসআলা : যার বদলী হজ্ব আদায় করা হবে তার পক্ষ থেকে আদেশ বা অনুমতি থাকতে হবে।
তার আদেশ বা অনুমতি ছাড়া কেউ তার পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করলে এটি তার নফল হজ্ব গণ্য হবে। এর দ্বারা তার ফরয হজ্ব আদায় হবে না। -মানাসিক ৪৩৬; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫৯৯
মাসআলা : কোনো ব্যক্তির উপর হজ্ব ফরয ছিল, কিন্তু সে তা আদায় করেনি এবং তার পক্ষ থেকে আদায়ের অসিয়তও করেনি। এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। তার পক্ষ থেকে ওয়ারিশদের বদলী হজ্ব করা বা করানো জরুরি নয়।
তবে কোনো ওয়ারিশ বা অন্য কেউ স্বেচ্ছায় তার পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করলে এর দ্বারা ঐ মৃত ব্যক্তির ফরয হজ্ব আদায় হয়ে যাওয়ার আশা করা যায়।
হযরত বুরাইদাহ রা. বলেন, জনৈক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মা ইন্তিকাল করেছেন। তিনি হজ্ব করেননি। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্ব করতে পারি?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি তার পক্ষ থেকে হজ্ব করো। ’ (সহীহ মুসলিম ১/৩৬২)
হযরত আতা রাহ. বলেছেন, ‘অসিয়ত না করলেও মৃতের পক্ষ থেকে হজ্ব করানো যাবে।
’
উল্লেখ্য, উপরোক্ত ক্ষেত্রে ওয়ারিশগণ যদি মাইয়্যেতের অবণ্টিত পরিত্যক্ত সম্পদ দ্বারা বদলী হজ্ব করাতে চান তাহলে দুটি শর্ত অবশ্যপালনীয় : ক) বদলী হজ্বের অসিয়ত না করার কারণে মৃতের সকল সম্পদের বর্তমান মালিক যেহেতু ওয়ারিশগণ তাই উক্ত সম্পদ দ্বারা বদলী হজ্ব করাতে হলে সকল ওয়ারিশের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি থাকতে হবে। খ) ওয়ারিশদের কেউ যদি নাবালেগ হয় কিংবা কোনো ওয়ারিশের যদি সম্মতি না থাকে তাহলে তার অংশ থেকে বদলী হজ্বের জন্য কিছুই নেওয়া যাবে না।
দেখুন : মানাসিক ৪৩৬; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫৯৯; গুনইয়াতুন নাসিক ৩২২, ৩২৮
মাসআলা : বদলী হজ্ব করার জন্য কোনো প্রকার বিনিময় বা পারিশ্রমিক লেনদেন করা যাবে না। কেননা হজ্ব একটি ইবাদত। আর ইবাদতের বিনিময় নেওয়া ও দেওয়া দুটোই নাজায়েয।
তাই বদলী হজ্বের জন্য পারিশ্রমিক দেওয়া হলে প্রদানকারী ও গ্রহণকারী দুজনই গুনাহগার হবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রেরণকারীর হজ্ব আদায় হয়ে যাবে বটে তবে হজ্ব আদায়কারী পারিশ্রমিকরূপে যা কিছু নিয়েছে তা ফেরত দেওয়া ওয়াজিব। সে শুধু হজ্বের খরচ নিতে পারবে। অতিরিক্ত কিছুই নিতে পারবে না। -আলবাহরুল আমীক ৪/২২৬৯; মানাসিক ৪৩৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৬০০
মাসআলা : মহিলাকে দিয়েও বদলী হজ্ব করানো জায়েয যদি তার সাথে স্বামী বা মাহরাম পুরুষ থাকে।
আর বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার, যার মাধ্যমে বদলী হজ্ব করানো হচ্ছে তিনি হজ্বের মাসায়েল সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত কি না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, বিদায় হজ্বে খাছআম গোত্রের একজন নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে, কিন্তু তিনি এত বৃদ্ধ যে, সওয়ারীর উপর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেন না। সুতরাং আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্ব করতে পারব? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ। ’ (সহীহ বুখারী ১/২৫০; সহীহ মুসলিম ১/৪৩১)
দেখুন : আলবাহরুল আমীক ৪/২২৬৮; মানাসিক ৪৫৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৫৭; আদ্দুররুল মুখতার ২/৬০৩; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ৫/২৭
মাসআলা : যার পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করা হচ্ছে হজ্বের অধিকাংশ খরচ তাকেই বহন করতে হবে। যদি কেউ সম্পূর্ণ নিজের খরচে কারো পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করে তাহলে এর দ্বারা প্রেরণকারীর ফরয হজ্ব আদায় হবে না।
তবে প্রেরিত ব্যক্তি কিছু খরচ নিজের পক্ষ থেকে বহন করলে অসুবিধা নেই।
হযরত আলী রা. অতিশয় বৃদ্ধ লোকের সম্পর্কে বলেছেন, সে কাউকে তার পক্ষ থেকে হজ্বে পাঠাবে এবং হজ্বের খরচ বহন করবে। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮/৫৯৯; সুনানে বায়হাকী ৫/২৬; মানাসিক ৪৩৮; আদ্দুররুল মুখতার ২/৬০০
মাসআলা : বদলী হজ্বে প্রেরণকারী যদি এই বলে টাকা দেয় যে, ‘আপনি এ টাকা স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে খরচ করতে পারবেন, কিছু বেঁচে গেলে তা ফেরত দিতে হবে না’ তাহলে হজ্ব আদায়ের পর হজ্বের প্রয়োজনে কেনা কাপড়-চোপড়, সামানপত্র ও উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা প্রেরণকারীকে ফেরত দিতে হবে না। এসব বস্ত্ত সে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে।
তবে যদি প্রেরণকারী টাকা দেওয়ার সময় এ রকম কিছু না বলে এবং তার কথাবার্তা বা অবস্থা দেখে বোঝা যায়, উদ্বৃত্ত টাকা-পয়সা ও হজ্বের প্রয়োজনে কেনা বস্ত্তসামগ্রী প্রেরণকারীকে ফেরত দিতে হবে তাহলে প্রেরিত ব্যক্তির উদ্বৃত্ত টাকা ও অন্যান্য সামানপত্র রেখে দেওয়া জায়েয হবে না।
অবশ্যই তা প্রেরণকারীকে ফেরত দিতে হবে। হ্যাঁ, ফেরত দেওয়ার পর তিনি যদি খুশি মনে তা দিয়ে দেন তাহলে সেগুলো গ্রহণ করতে অসুবিধা নেই।
বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেন, ‘কারো পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করার পর যদি প্রেরিতের নিকট প্রেরকের দেওয়া কিছু অর্থ অবশিষ্ট থাকে তাহলে সে প্রেরণকারীকে বিষয়টি জানাবে। সে দিয়ে দিলে প্রেরিতের গ্রহণ করতে বাধা নেই। অন্যথায় প্রেরণকারীকে তা ফেরত দিতে হবে।
’ (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮/৫৪১) -শরহু মুখতাছারিত তহাবী ২/৪৯৫; মাবসূত, সারাখসী ২৭/১৭২; ফাতাওয়া খানিয়া ১/৩০৭; মানাসিক ৪৫৯; আলবাহরুল আমীক ৪/২৩৭৮, ২৩৮১
মাসআলা : বদলী হজ্বে প্রেরণকারী যদি বদলী আদায়কারীকে টাকা-পয়সার হিসাব-নিকাশের ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখার জন্য বলে, ‘আমি আপনাকে হজ্বের জন্য প্রদত্ত টাকার মালিক বানিয়ে দিলাম বা আপনাকে হাদিয়া দিলাম তাহলে ঐ টাকায় আদায়কৃত হজ্ব দ্বারা প্রেরকের ফরয হজ্ব আদায় হবে না। কারণ হাদিয়া করার কারণে বা মালিক বানিয়ে দেওয়ার কারণে সে ঐ টাকার মালিক হয়ে গিয়েছে এবং হজ্বটি তার নিজের টাকায় সম্পন্ন হয়েছে। এ কারণে বদলী হজ্বের জন্য টাকাটা প্রেরকের মালিকানায় রেখেই প্রেরিত ব্যক্তিকে হজ্বের খরচ হিসাবে প্রদান করতে হবে। আর হিসাবের ঝামেলা এড়ানোর জন্য পূর্বোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রেরণকারী টাকা দিয়ে একথা বলে দিবে যে, কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা আমাকে ফেরত দিতে হবে না বা কোনো হিসাবও আমাকে দিতে হবে না।
-যুবদাতুল মানাসিক ৪৫৯
মাসআলা : বদলী হজ্বের জন্য নিজ দেশ থেকেই কাউকে পাঠাতে হবে। নিজ দেশ থেকে কাউকে পাঠানোর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অন্য দেশে অবস্থানরত কাউকে দিয়ে বদলী হজ্ব করানো হলে প্রেরণকারীর ফরয হজ্ব আদায় হবে না। এক্ষেত্রে নিজ দেশ থেকে পুনরায় বদলী হজ্ব করাতে হবে। -মানাসিক ৪৪০; গুনইয়াতুন নাসিক ৩২৯; রদ্দুল মুহতার ২/৬০৫
মাসআলা : মৃত ব্যক্তি তার পক্ষ থেকে বদলী হজ্বের অসিয়ত করে গেলে নিয়ম হল, তার কোনো ঋণ থাকলে প্রথমে তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তা আদায় করা। এরপর অবশিষ্ট সম্পদের এক তৃতীয়াংশ থেকে বদলী হজ্বের অসিয়ত কার্যকর করা।
এক তৃতীয়াংশ সম্পদ দ্বারা মৃতের আবাসস্থল থেকে হজ্বের জন্য পাঠানো সম্ভব হলে তার এলাকা থেকেই কাউকে পাঠাতে হবে। এক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশ থেকে কাউকে দিয়ে হজ্ব করালে মৃতের অসিয়ত ও ফরয হজ্ব আদায় হবে না। কিন্তু এক তৃতীয়াংশ সম্পদ দ্বারা যদি মৃতের এলাকা থেকে হজ্ব করানো সম্ভব না হয় তাহলে ঐ টাকা দিয়ে যেখান থেকে হজ্ব করানো যায় সেখান থেকেই করাবে। অবশ্য ওয়ারিশগণ চাইলে নিজ সম্পদ থেকে কিছু দিয়ে মৃতের এলাকা থেকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারবে। (প্রাগুক্ত)
মাসআলা : মাইয়েত যদি বদলী হজ্বের অসিয়ত করে না যায় আর ওয়ারিশগণ স্বেচ্ছায় তার বদলী হজ্ব করাতে চায় সেক্ষেত্রে মৃতের এলাকা থেকে বদলী করানো জরুরি নয়।
তারা অন্য দেশ যেমন- সৌদি আরব বা তার কাছাকাছি কোনো দেশ থেকেও মাইয়েতের পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করাতে পারবে। তবে এক্ষেত্রেও তার দেশ থেকে কাউকে পাঠিয়ে হজ্ব করানো উত্তম। কারণ এভাবে করলে মাইয়েতের উপর যেভাবে হজ্ব ফরয হয়েছিল সেভাবে আদায় করা হয়। -আলবাহরুল আমীক ৪/২৩৪৮; মাআরিফুস সুনান ৬/৩১৬; মানাসিক ৪৩৬; আলমুগনী, ইবনে কুদামা ৫/৪১
মাসআলা : বদলী হজ্বের ইহরাম বাঁধার সময় প্রেরণকারীর পক্ষ থেকে নিয়ত করতে হবে। এর জন্য উত্তম হল, মুখে এভাবে বলা যে, আমি অমুকের পক্ষ থেকে হজ্বের ইহরাম করছি বা নিয়ত করছি, এমনকি তালবিয়া বলার সময়ও তার নাম যুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।
যেমন এভাবে বলবে, লাববাইক আন ফুলান (ব্যক্তির নাম)।
যদি তার নাম জানা না থাকে বা স্মরণ না থাকে তাহলে এভাবে বলবে যে, যিনি আমাকে বদলী হজ্বের জন্য প্রেরণ করছেন বা যার পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করছি তার পক্ষ থেকে হজ্বের নিয়ত করলাম। ইহরামের সময় একবার এই নিয়ত করা যথেষ্ট। হজ্বের প্রতিটি কাজে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রেরণকারীর পক্ষ থেকে নিয়ত করতে হবে না।
বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেন, কারো পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করলে তালবিয়া পড়ার সময় তার নাম নিয়ে একবার এভাবে বলাই যথেষ্ট যে,
لَبَّيْكَ عَنْ فُلَانٍ
(অমুকের পক্ষ থেকে লাববাইক।
)
অনুরূপ বক্তব্য হযরত আতা রাহ. থেকেও বর্ণিত আছে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮/২৩৪)
দেখুন : মানাসিক ৪৪২; আলবাহরুল আমীক ৪/২২৬৩
মাসআলা : যদি মুখে প্রেরণকারীর নাম উল্লেখ করতে ভুলে যায়, কিন্তু মনে মনে তার পক্ষ থেকে নিয়ত করেছে, তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই।
অন্তরের নিয়তই যথেষ্ট।
হযরত হাসান বসরী ও আতা রাহ. বলেছেন-
إِذَا حَجَّ الرَّجُلُ عَنِ الرَّجُلِ فَنَسِيَ أَنْ يُسَمِّيَهُ فَقَدْ أَجْزَأَ عَنْهُ الْحَجُّ، فَإِنَّ اللهَ قَدْ عَلِمَ عَمَّنْ حَجَّ.
যদি কেউ কারো পক্ষ থেকে (বদলী) হজ্ব করে আর সে (ইহরামের সময়) প্রেরকের নাম উচ্চারণ করতে ভুলে যায় তাহলেও তার হজ্ব আদায় হবে যাবে। কারণ আল্লাহ তাআলা জানেন, সে কার পক্ষ থেকে হজ্ব করেছে।
(মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮-/২৩৫)
দেখুন : আলবাহরুল আমীক ৪/২২৬৩; মানাসিক ৪৪২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫৯৯
মাসআলা : বদলী হজ্ব আদায়কারী যদি ইহরাম বাঁধার সময় প্রেরণকারীর পক্ষ থেকে নিয়ত করতে ভুলে যায় তাহলে হজ্বের কাজ শুরু করার আগেই প্রেরকের পক্ষ থেকে নিয়ত করে নিবে। যদি নতুন করে প্রেরকের পক্ষ থেকে নিয়ত না করে হজ্বের আমলসমূহ করতে শুরু করে দেয় তাহলে তখন আর নিয়ত করার সুযোগ থাকে না। তখন এই হজ্ব হবে আদায়কারীর নিজের হজ্ব। প্রেরণকারীর টাকা ফেরত দেওয়া তার জন্য অপরিহার্য। -মানাসিক ৪৪২; রদ্দুল মুহতার ২/৫৯৯; গুনইয়াতুন নাসিক ৩২৫
মাসআলা : মৃত ব্যক্তি যদি নির্দিষ্ট কাউকে দিয়ে তার বদলী হজ্ব করানোর অসিয়ত করে থাকে যে, অমুক আমার বদলী হজ্ব করবে, অন্য কেউ করতে পারবে না, তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে তার বদলী হজ্ব করানো জায়েয নয়।
আর যদি অসিয়তের সময় কারো নাম বললেও অন্য কাউকে দিয়ে করাতে নিষেধ না করে থাকে অর্থাৎ শুধু এতটুকু বলেছে যে, অমুককে দিয়ে আমার বদলী হজ্ব করাবে, এক্ষেত্রে উত্তম হল ঐ নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দিয়েই হজ্ব করানো। তবে ঐ ব্যক্তি যদি রাজি না হয় বা কোনো কারণে করতে সক্ষম না হয় তাহলে অন্য কাউকে দিয়েও করাতে পারবে।
তদ্রূপ ঐ ব্যক্তির অসম্মতি বা অক্ষমতা ছাড়াও যদি তাকে না পাঠিয়ে অন্য কাউকে পাঠায় তাহলেও মৃতের ফরয হজ্ব আদায় হয়ে যাবে। -আলবাহরুল আমীক ৪/২৩৮৭; মানাসিক ৪৫১; আদ্দুররুল মুখতার ২/৬০০; গুনইয়াতুন নাসিক ৩২৮
মাসআলা : মৃত ব্যক্তি যদি শুধু এটুকু অসিয়ত করে যে, আমার পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করাবে, কিন্তু কোনো প্রতিনিধি নিয়োগ করেনি তাহলে সকল ওয়ারিশ একত্র হয়ে পরামর্শক্রমে যেকোনো ব্যক্তিকে বদলী হজ্বের জন্য পাঠাতে পারবে। এতে মৃতের ফরয হজ্ব আদায় হয়ে যাবে।
-মানাসিক ৫৫১; গুনইয়াতুন নাসিক ৩২৮
মাসআলা : যদি কোনো বদলী হজ্বকারী তাওয়াফে যিয়ারত না করেই দেশে চলে আসে তাহলে এ কারণে হজ্ব বাতিল হবে না। তবে তাকে নিজের খরচে মক্কা মুকাররমায় গিয়ে অবশ্যই তাওয়াফে যিয়ারত করতে হবে। অন্য কাউকে দিয়ে তা করানোর সুযোগ নেই। -মানাসিক ৪৫১
মাসআলা : বদলী হজ্বকারী শুধু এক হজ্বের ইহরাম করবে। তার জন্য একত্রে দুই হজ্বের নিয়তে ইহরাম করা-একটি প্রেরণকারীর পক্ষ থেকে আর অপরটি নিজের জন্য-এটি জায়েয নয় এবং এর দ্বারা প্রেরণকারীর হজ্ব আদায় হবে না।
তবে নিজের নিয়তে যে হজ্বের ইহরাম করেছে তা যদি ছেড়ে দেয় তাহলে প্রেরকের বদলী হজ্ব আদায় হবে।
মাসআলা : বদলী হজ্বকারী নির্দিষ্ট এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে ইহরাম করবে। একই হজ্বের ইহরাম দুই ব্যক্তির পক্ষ থেকে করা জায়েয নয়। যদি এমনটি করে তাহলে দু’জনের কারো হজ্ব আদায় হবে না। এটি আদায়কারীর নিজের হজ্ব হবে।
সুতরাং ঐ দুই ব্যক্তি যদি তাদের পক্ষ থেকে হজ্ব করার জন্য তাকে টাকা দিয়ে থাকে তাহলে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। -মানাসিক ৪৪৬; আদ্দুররুল মুখতার ২/৬০৭, ৬০১; গুনয়াইতুন নাসিক ৩২৫, ৩২৭
মাসআলা : বদলী হজ্ব আদায়কারী ইহরাম করবে প্রেরণকারীর মীকাত থেকে। অর্থাৎ প্রেরণকারীর দেশ থেকে মক্কা মুকাররমা যেতে যে মীকাত পরে সেখান থেকে বদলী হজ্বের ইহরাম করবে। যেমন-বাংলাদেশ থেকে সরাসরি মক্কাগামী হজ্বযাত্রীদের জন্য মীকাত হল ‘কারনুল মানাযিল’ ও ‘যাতু ইরক’। এই স্থানদ্বয় অতিক্রমের আগেই ইহরাম করতে হবে।
সতর্কতার জন্য বিমানে ওঠার আগে কিংবা বিমানে উঠেই ইহরাম করে নেওয়া ভালো। -মানাসিক ৪৪২; রদ্দুল মুহতার ২/৬০০; গুনইয়াতুন নাসিক ৩৩২
মাসআলা : প্রেরিত ব্যক্তি প্রেরণকারীর আদেশের উল্টো করবে না। যেমন-প্রেরক হজ্বে ইফরাদ করার আদেশ করেছে, কিন্তু আদায়কারী প্রথমে নিজের জন্য উমরাহ করেছে। তারপর প্রেরকের পক্ষ থেকে হজ্ব করেছে। এমনটি করলে প্রেরকের হজ্ব আদায় হবে না।
আর আদায়কারীকে অবশ্যই প্রেরকের টাকা ফেরত দিতে হবে। -মানাসিক ৪৪৪; রদ্দুল মুহতার ২/৬০০; গুনইয়াতুন নাসিক ৩৩৩
মাসআলা : কেউ কেউ ঈসালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে করা হজ্বকেও বদলী হজ্ব বলে থাকে। স্মরণ রাখতে হবে, এটি পারিভাষিক বদলী হজ্ব নয়। বদলী হজ্ব শরীয়তের একটি বিশেষ পরিভাষা।
ঈসালে ছওয়াবের হজ্ব আর বদলী হজ্ব দুটো এক নয়।
বদলী হজ্ব হল নিজে হজ্ব আদায়ে অক্ষম কোনো ব্যক্তি জীবদ্দশায় কাউকে হজ্বের খরচ দিয়ে তার পক্ষ থেকে ফরয হজ্ব আদায়ের জন্য প্রেরণ করা বা মৃত্যুর সময় তার ফরয হজ্ব আদায়ের অসিয়ত করে যাওয়ার ফলে তার পক্ষ থেকে আদায়কৃত হজ্ব।
আর নিজ খরচে কারো পক্ষ থেকে হজ্ব করলে বা করালে সেটিকে পারিভাষিক অর্থে বদলী হজ্ব বলা হয় না। এতে বদলী হজ্বের বিশেষ বিধানগুলো লক্ষণীয় নয়। এটি হল মুলত ঈসালে ছওয়াবের হজ্ব। এক্ষেত্রে হজ্ব আদায়ের সময়ই ঐ ব্যক্তির নিয়তে আদায় করা যায়।
আবার আদায়ের পরও তাকে ছওয়াব পৌঁছানোর নিয়ত করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই ঐ ব্যক্তি এর ছওয়াব পেয়ে যাবেন।
মাসআলা : প্রেরক অনুমতি দিলে বদলীকারীর জন্য তামাত্তু বা কিরান হজ্ব করাও জায়েয। তদ্রূপ বিশেষভাবে ইফরাদ হজ্ব করার নির্দেশ না দিলে; সে ক্ষেত্রেও কিরান ও তামাত্তু যে কোনোটি করা জায়েয। হানাফী মুতাআখখিরীন ফকীহগণের অনেকে এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, প্রেরকের অনুমতি থাকলে বদলীকারী কিরান ও তামাত্তু যে কোনোটি করতে পারবে, ইফরাদ হজ্ব করা জরুরি নয়।
যেমন-আল্লামা ফখরুদ্দীন হাসান ইবনে মানসুর আলউযজান্দী রাহ. (মৃত্যু : ৫৯২ হি.), আল্লামা রহমতুল্লাহ সিন্ধী রাহ. (মৃত্যু : ৯৯৩ হি.), আল্লামা আলাউদ্দীন হাসকাফী রাহ. (মৃত্যু : ১০৮৮ হি.), আল্লামা কাযী হুসাইন ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল গনী হানাফী রাহ. (মৃত্যু : ১৩৬৬ হি.) প্রমুখ। এছাড়া উপমহাদেশের বড় বড় অনেক মুফতী ছাহেব এই ফতোয়া দিয়েছেন। যেমন-মুফতী কেফায়েতুল্লাহ দেহলভী রাহ., মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ., মুফতী যফর আহমদ উছমানী রাহ., মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানবী রাহ., শাইখুল ইসলাম মুফতী তকী উছমানী দা.বা. প্রমুখ।
এছাড়াও রিয়াদস্থ গবেষণা ও ইফতাবোর্ড এবং ভারতের ইসলামী ফিকহ একাডেমীর সিদ্ধান্তও অনুরূপ। দেখুন : ফাতাওয়া খানিয়া ১/৩০৭; লুবাবুল মানাসিক ৪৫৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৬১১; ইরশাদুস সারী ৬৪৭; কেফায়েতুল মুফতী ৪/৩৪৫; জাওয়াহিরুল ফিকহ ১/৫০৮; ইমদাদুল আহকাম ২/৫২৩; ফাতাওয়া উছমানী ২/২২২; ফাতাওয়াল লাজনাহ আদ্দাইমাহ ১১/৮২
মাসআলা : বদলী হজ্ব এমন লোককে দিয়ে করানো উচিত, যিনি নিজের ফরয হজ্ব আদায় করেছেন।
যে ব্যক্তি নিজের হজ্ব আদায় করেনি সে যদি এমন হয় যে, তার উপর হজ্ব ফরয নয় তাহলে তাকে দিয়েও বদলী করানো জায়েয আছে। তবে তা মাকরূহ তানযীহি। আর যদি তার উপর হজ্ব ফরয হয়ে থাকে, কিন্তু সে এখনও তা আদায় করেনি তাহলে তার জন্য বদলী হজ্ব করা মাকরূহ তাহরীমী তথা নাজায়েয। তবে কেউ এমন ব্যক্তির দ্বারা বদলী হজ্ব করালে প্রেরণকারীর হজ্ব আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় তাকে বদলী করাতে হবে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে হজ্বের ইহরাম করার সময়-
لَبَّيْكَ عَنْ شُبْرُمَةَ
(শুবরুমার পক্ষ থেকে লাববাইক) এভাবে বলতে শুনে বললেন, ‘শুবরুমা কে?’ লোকটি বলল, ‘আমার ভাই (বর্ণনাকারী বলেন) অথবা বলল, আমার নিকটাত্মীয় এক লোক। ’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি কি নিজের হজ্ব করেছ?’সে বলল, ‘না। ’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আগে তোমার নিজের হজ্ব কর তারপর শুবরুমার পক্ষ থেকে কর। -সুনানে আবু দাউদ ১/২৫২
হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত আছে-
كان لا يرى بأسا أن يحج الصرورة عن الرجل.
যে ব্যক্তি নিজের হজ্ব করেনি যে অন্যের পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করাকে তিনি দোষের বিষয় মনে করতেন না।
বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত মুজাহিদ, হাসান বসরী ও সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব রাহ.ও এমনই মনে করতেন।
(মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮/১৮৯) দেখুন : মাবসূত, সারাখসী ৪/১৫১; আলবাহরুল আমীক ৪/২২৬৩; ফাতহুল কাদীর ৩/৭৯; রদ্দুল মুহতার ২/৬০৩
মাসআলা : কাউকে এমনিই নেক কাজের নিয়তে হজ্ব করাতে চাইলে বা হজ্ব আদায়ে আর্থিক সহায়তা করতে চাইলে এমন ব্যক্তিকে করানো উত্তম, যিনি এখনও হজ্ব করেননি। -মাবসূত, সারাখসী ৪/১৫২; আলবাহরুল আমীক ৪/২২৬৮; গুনইয়াতুন নাসিক ৩৩৯
মাসআলা : কোনো কোনো কিতাবে আছে যার উপর হজ্ব ফরয হয়নি এমন ব্যক্তি বদলী হজ্বে গেলে কাবা শরীফ দেখার দ্বারা তার নিজের উপর হজ্ব ফরয হয়ে যায়। যদিও সে গরীব হোক না কেন। সুতরাং তার জন্য জরুরি, হজ্বের পর পরবর্তী বছর হজ্বের সময় পর্যন্ত মক্কায় অবস্থান করা এবং হজ্বের নির্দিষ্ট সময় নিজের ফরয হজ্ব আদায় করা। যদি দেশে চলে আসে তাহলে পুনরায় নিজের ফরয হজ্ব আদায়ের উদ্দেশে মক্কা মুকাররমা যাওয়া জরুরি।
এ বক্তব্য ঠিক নয়। বিশুদ্ধ মতানুসারে এমন গরীব ব্যক্তি বদলী হজ্ব করতে গিয়ে বাইতুল্লাহ শরীফ দেখার দ্বারা তার উপর হজ্ব ফরয হয় না। কেননা, সে অন্যের পক্ষ থেকে হজ্বের ইহরাম বাঁধার কারণে তৎক্ষণাৎ নিজের জন্য হজ্ব করতে সক্ষম নয়। আর পরবর্তী বছর হজ্বের সময় আসা পর্যন্ত তার পক্ষে সেখানে অবস্থান করা সম্ভব নয়। আবার স্বদেশে চলে আসার পর পুনরায় হজ্বের জন্য যাওয়ারও তার আর্থিক সামর্থ্য নেই।
এইজন্য মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম উক্ত বক্তব্যটি প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং এ ধরনের গরীব বদলীকারীর উপর বাইতুল্লাহ শরীফ দেখার দ্বারা হজ্ব ফরয না হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন। -রদ্দুল মুহতার ২/৬০৪; গুনইয়াতুন নাসিক ৩৩৮; জাওয়াহিরুল ফিকহ ১/৫০৭; ফাতাওয়া উছমানী ২/২২২
মাসআলা : অন্যের বদলী হজ্ব করার দ্বারা নিজের ফরয হজ্ব আদায় হয় না। সুতরাং বদলী আদায়কারীর উপর হজ্ব ফরয হলে তাকে পৃথকভাবে নিজের ফরয হজ্ব আদায় করতে হবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে ইহরাম করার সময়-
لَبَّيْكَ عَنْ شُبْرُمَةَ
(শুবরুমার পক্ষ থেকে লাববাইক) এভাবে বলতে শুনলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, শুবরুমা কে? সে বলল, আমার ভাই বা (বলেছে) আমার এক আত্মীয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি নিজের হজ্ব করেছ? সে বলল না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, আগে তোমার নিজের হজ্ব কর। তারপর শুবরুমার পক্ষ থেকে হজ্ব কর। (সুনানে আবু দাউদ ১/২৫২)
যদি অন্যের পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব করার দ্বারা নিজের ফরয হজ্বও আদায় হয়ে যেত তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে আগে নিজের হজ্ব করতে বলতেন না। আরো দেখুন : মাবসূত, সারাখসী ৪/১৪৭; ফাতহুল কাদীর ৩/৬৮; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৭৮; আলবাহরুল আমীক ৪/২২৫২
মাসআলা : উমরাহর বদলী করাও জায়েয আছে।
হযরত আবু রাযীন আলউকায়লী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবা অতিশয় বৃদ্ধ মানুষ। তিনি হজ্ব ও উমরাহ করতে সক্ষম নয়। (আমি কী করতে পারি?)’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমার বাবার পক্ষ থেকে তুমি হজ্ব ও উমরাহ আদায় কর। ’ (জামে তিরমিযী ১/১১২) দেখুন : গুনইয়াতুন নাসিক ৩২০
মাসআলা : মান্নত হজ্বের বদলী করা জায়েয। অর্থাৎ কেউ হজ্ব বা উমরার মান্নত করেছে, কিন্তু স্বয়ং তা আদায় করতে সক্ষম নয় বা আদায়ের আগেই তার মৃত্যু এসে গেছে তাহলে সে কারো দ্বারা এর বদলী করিয়ে নিবে বা বদলী করানোর অসিয়ত করে যাবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘জুহাইনা গোত্রের এক নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, ‘আমার মা হজ্বের মান্নত করেছিলেন। কিন্তু হজ্ব আদায়ের আগেই তিনি মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্ব করতে পারব?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি তার পক্ষ থেকে হজ্ব কর। যদি তোমার মায়ের কোনো অনাদায়ী ঋণ থাকত তাহলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে না? আল্লাহর ঋণও আদায় কর। আল্লাহর ঋণ আরো বেশি আদায়যোগ্য।
’ (সহীহ বুখারী ১/২৫০)
মাসআলা : যে ব্যক্তি নিজের ফরয হজ্ব আদায় করে ফেলেছে তার জন্য নফল হজ্ব করার চেয়ে উত্তম হল, অন্য কারো ফরয হজ্বের বদলী করা।
হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।