জাহাজ শিল্প বাংলাদেশে দ্রুত প্রসারমান একটি শিল্পে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর কোনো জাতিই জাহাজ শিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশকে কোনোভাবেই অবহেলা করতে পারে না। এই শিল্প আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে জোরালোভাবে সংশ্লিষ্ট। আবার দেশের অধিকাংশ আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যও হচ্ছে সমুদ্রনির্ভর। ফলে দেশের অভ্যন্তরেই ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দক্ষ নাবিক, ক্যাপ্টেন ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের।
দক্ষ নৌযান অফিসার থেকে শুরু করে নৌ-প্রকৌশলীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সৃষ্টিতে বিগত ৫০ বছর ধরে অনন্য ভূমিকা রেখে আসছে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি। স্বাধীনতার পর নৌযান চালানোর ক্ষেত্রে যোগ্য ও বুদ্ধিসম্পন্ন অফিসারের অভাব দেখা দিলে, মেরিন একাডেমি সে শূন্যতা পূরণের দায়িত্ব নেয় অতি গুরুত্বের সঙ্গে। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মেরিন একাডেমি ডেক এবং ইঞ্জিনিয়ার অফিসারদের একসঙ্গে পেশাদারি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে বিভিন্ন কোর্স চালু রয়েছে। ১৯৯০ সালে এ একাডেমি ওয়ার্ল্ডর্ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, মালমো, সুইডেনের একমাত্র শাখা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এক নৈসর্গিক পরিবেশে ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির যাত্রা শুরু হয়। পাহাড়, টিলা ও বিস্তীর্ণ সমতলে অবস্থিত দেশের একমাত্র সরকারি এই মেরিন একাডেমির ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবেশ যে কাউকে মোহিত করবে। সূচনালগ্ন থেকে দক্ষ অফিসার তৈরি ও দেশের বিভন্ন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে বিশেষ করে নৌদুর্যোগে অনন্য ভূমিকা রাখার সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে গত বছর এই একাডেমি ৫০ বছরপূর্তি উৎসব করেছে। বছরব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে চলতি মাসেই উৎসব শেষ হয়েছে।
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে প্রিন্সিপালস অব নেভিগেশন, ওশান অ্যান্ড অফশোর নেভিগেশন, কোস্টাল নেভিগেশন, নেভিগেশন এইডস, মেটিওরলজি, কারগো অপারেশনস অ্যান্ড স্টাবিলিটি, জেনারেল শিপ নলেজ।
প্রায়োগিক বিষয়সমূহের মধ্যে রয়েছে সীম্যানশিপ, সীগন্যালিং, ওয়াচ কিপিং, মেরিটাইম ল অ্যান্ড কনভেনশন। একাডেমিক বিষয়সমূহ : ম্যাথমেটিকস, ফিজিঙ্ (থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিক্যাল), ইংরেজি, বাংলাদেশ স্টাডিজ, প্রি-সী মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং।
থিওরিটিক্যাল বিষয়সমূহ : মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং প্র্যাকটিস পার্ট-১, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং প্র্যাকটিস পার্ট-২, ওয়ার্কশপ প্রোসেস অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস, ইলেকট্রটেকনোলজি, নাভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড শিপ কনস্ট্রাকশন, অ্যাপ্লাইড হিট, অ্যাপ্লাইড ম্যাকানিঙ্, ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং।
ট্রেনিং এর সময় : সমুদ্রে যাত্রা করার আগে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এই ট্রেনিং কোর্সটি দুই বছরের জন্য।
দুই বছরের ট্রেনিং কোর্সটি আবার ৪টি টার্মে বিভক্ত। এক একটি টার্মের সময়সীমা ১৮ থেকে ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত। ট্র্রেনিং এর পর বাকি দুই মাস একাডেমি বন্ধ থাকে গ্রীষ্ম এবং শীতকালীন ছুটির জন্য। প্রতিবছর জুন/জুলাই মাসে গ্রীষ্মকালীন এবং ডিসেম্বর/জানুয়ারি মাস শীতকালীন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রয়োজন হলে ছুটির মধ্যেও ওয়ার্কশপ অথবা সমুদ্রকালীন প্রশিক্ষণ কোর্স অব্যাহত থাকতে পারে।
অ্যাওয়ার্ড অব প্রি-সী প্রফেশনাল সার্টিফিকেটস : সফলতার সঙ্গে যেসব শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া এবং প্রশিক্ষণ শেষ করেন তাদের নিম্নোক্ত সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। সার্টিফিকেট অব প্রি-সী নটিক্যাল সায়েন্স, সার্টিফিকেট অব প্রি-সী মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স (ফেজ-১), ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্স (বিএমএস) ডিগ্রি, অ্যাওয়ার্ড অব ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্স (বিএমএস) ডিগ্রি। তিন বছরের ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্স ডিগ্রি কোর্স যুগপৎ চলতে থাকে এবং প্রফেশনাল কোর্সের ওপর অধিক জোর দেয়া হয়। প্রি-সী নটিক্যাল কোর্স যা দুই বছরের কোর্স একাডেমিতে এবং এক বছরের কোর্স সমুদ্রে সম্পন্ন হয় যা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্বীকৃতপ্রাপ্ত তিন বছরের বিএমএস (নটিক্যাল) ডিগ্রি কোর্সের সমতুল্য।
প্রি-সী মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সটি দুই বছরের একাডেমিক কোর্স এবং ছয় মাস সমুদ্রে ও ছয় মাসের একাডেমিক কোর্সের অংশবিশেষ যা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্বীকৃতপ্রাপ্ত তিন বছরের বিএমএস (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি কোর্সের সমতুল্য।
উভয় ক্ষেত্রে, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ক্যাডেটদেরকে বিএমএস (নটিক্যাল/ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি প্রদান করে থাকে।
ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ : ব্যবহারিক ট্রেনিংয়ের মধ্যে থাকে রোয়িং, পাওয়ার বোট হ্যান্ডলিং, সিগন্যালিং, সিমাফোর অ্যান্ড এভিলুশনস। ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ আবার ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু টেকনিক্যাল বিষয়ের ওপর হয়ে থাকে যেমন- ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ/সীম্যানশিপ/ ফিজিঙ্/ইলেকট্রিক্যাল/মেকানিক্যাল ল্যাবরেটরিজ ইত্যাদি। এ ছাড়া জাহাজে অবস্থানরত নির্দেশক থাকবেন যারা শিক্ষার্থীদের সব সময় পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখবেন এবং জাহাজ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে নোঙর করবে যেমন- গুরুত্বপূর্ণ মিল, স্ক্র্যাব ইয়ার্ড, ড্রাই ডক, ফ্যাক্টরি যেখানে থেকে ক্যাডেটরা যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ ও শিল্পের ব্যবহার সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
শারীরিক প্রশিক্ষণ : সুস্থ দেহ মানে সুস্থ মন।
তাই কঠোর শৃঙ্খলার একঘেয়েমি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে শারীরিক প্রশিক্ষণ এবং প্যারেড সাধারণ প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত সব ক্যাডেটদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত খেলাধুলার চর্চা হয়ে থাকে। মানসিক গুণাবলী বৃৃদ্ধির জন্য পূর্ণ মনোযোগ, সচেতনতা, সহিষ্ণুতা, সাহস, সংযম, দলীয়ভাবে কাজের উদ্দীপনা এবং সহকর্মীসুলভ আচরণ তৈরিতে খেলাধুলা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। একাডেমি বিভিন্ন ধরনের খেলার আয়োজন করে থাকে যেমন- ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল, হকি, ক্রিকেট, টেনিস, ব্যাডমিন্টন, সুইমিং এবং অ্যাথলেটিকস।
এ ছাড়া ইনডোর গেমসের সুযোগ আছে যেমন- ক্যারম, টেবিল টেনিস এবং দাবা। একাডেমির প্রত্যেক ক্যাডেটকে বাধ্যতামূলকভাবে খেলাধুলায় অংশ নিতে হয়।
অন্যান্য কার্যক্রম : একাডেমিতে ক্যাডেটরা স্বাধীনভাবে সৃষ্টিশীল কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, শখ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে তারা নিজেদের নিয়োজিত করতে পারে। ক্যাডেটরা বিভিন্ন জাতীয় দিবসে, ধর্মীয় এবং অন্যান্য উৎসবগুলোতে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সিম্পোজিয়াম এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে।
এ ছাড়া শিক্ষাসফর এবং ভ্রমণের ব্যবস্থাতো আছেই।
নেভি অফিসারদের যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারাই উত্তীর্ণ হবে যারা নিয়ম-কানুন মেনে চলতে পারবে। সে জন্য এই একাডেমিতে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে তারা সব ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে পারে।
ভর্তিতথ্য : তিন বছর মেয়াদি নটিক্যাল সায়েন্স এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করা যাবে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে।
দুই বছর তাত্তি্বক পড়াশোনা এবং এক বছর 'অন জব ট্রেনিং' মিলিয়ে তিন বছরে শেষ হবে স্নাতক।
নটিক্যাল সায়েন্স এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হতে হলে শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করতে হবে এবং দুটিতেই জিপিএ থাকতে হবে ৩.৫। এ ছাড়া গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানে আলাদা করে ৩.৫ গ্রেড পয়েন্ট এবং ইংরেজিতে তিন গ্রেড পয়েন্ট থাকতে হবে।
দৈহিক উচ্চতা : ছেলেদের জন্য কমপক্ষে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি এবং মেয়েদের জন্য কমপক্ষে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি। এ ছাড়া এ-লেভেল সম্পন্ন শিক্ষার্থীকে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান ও ইংরেজিসহ পাঁচটি বিষয়ে নূ্যনতম সি গ্রেড থাকতে হবে।
শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীকে অবশ্যই সাঁতার জানতে হবে। এই কোর্সের জন্য শিক্ষার্থীর খরচ হবে চার লাখ ১০ হাজার টাকা।
বিস্তারিত :www.macademy.gov.bd|
আবেদন পদ্ধতি : মেরিন একাডেমির ফরম সোনালী ব্যাংকের যেকোনো শাখা বা ওযয়েবসাইট (www.macademy.gov.bd) থেকে সংগ্রহ করা
যাবে। নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে এক হাজার ১০০ টাকা নিবন্ধন ফিসহ জমা দিতে হবে সোনালী ব্যাংকে। রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দেওয়ার একই তারিখে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড থেকে প্রার্থীর দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে একটি গোপনীয় ট্র্যাকিং নম্বরসংবলিত খুদে বার্তা আসবে।
এরপর সোনালী ব্যাংকের ওয়েবসাইটে মেরিন একাডেমি অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ফরম লিংকে গিয়ে প্রার্থীর মুঠোফোন নম্বর ও ট্র্যাকিং নম্বর দিলেই অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ফরম আসবে। এবার অনলাইনে সঠিকভাবে এই ফরম পূরণ করে জমা দিলেই প্রার্থী সোনালী ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে প্রবেশপত্র ডাউনলোড করতে পারবেন।
আবাসিক ও খাদ্য ব্যবস্থা : আবাসিক সুবিধা- দুই বছরের ট্রেনিং সময়ে ক্যাডেটদের আবাসিক হলে থাকার সুবিধা রয়েছে।
অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা : ক্যাডেটদের খাবারের জন্য ২৫৭৫ টাকা প্রতি মাসে দিতে হয়। এই টাকার পরিমাণ বাড়তে পারবে।
খাবারের তালিকা নির্ভর করে প্রশিক্ষণ এবং ফান্ডের ওপর। মেডিকেল সুবিধা- স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে একটি ডিসপেন্সারি রয়েছে। এখানে ডাক্তার আছেন। কেউ বেশি অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
বৃত্তি : ক্যাডেটদের জন্য বিভিন্ন বৃত্তি চালু আছে।
যেমন-সোহরাওয়ার্দী বৃত্তি। সোহরাওয়ার্দী বৃত্তি, প্রেসিডেন্ট ও সিইও, ন্যাশনাল মেরিন কনসালটেন্ট গ্রুপ এবং পূর্বতন ক্যাডেটদের উদ্যোগে ৩৬টি বৃত্তি বিভিন্ন শ্রেণীতে মেধা অনুসারে নটিক্যাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডেটদের মধ্যে ভাগ করা হয়েছে। একাডেমি বৃত্তি সাধারণত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদান করা হয়। তা ছাড়া শিক্ষা বোর্ড ক্যাডেটদের এইচএসসির ফলাফলের ওপর বৃত্তি প্রদান করে থাকে।
ক্যাডেটদের জন্য সেনাকল্যাণ সংস্থা, জেলা পরিষদ, এফএফডাব্লিউ বৃত্তি প্রদান করে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।