আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রৌদ্র ছায়ার নিচে

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। মহোদয় এর আগে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, 'তেল' একটি স্নেহজাতীয় পদার্থ। যথাসময়ে, যথাস্থানে তেলের ব্যবহার যদি ঠিকমতো করা যায়, তাহলে সুফল নিশ্চিত। তবে প্রয়োগক্ষেত্রে অর্থের নিষ্প্রয়োজন, প্রয়োজন হচ্ছে, নিজের কথামালাকে কীভাবে, কখন, সেই ব্যক্তিটিকে মালার মতো করে গলায় যিনি পরিয়ে দিতে পারেন, তিনি একজন সফল তৈলমর্দনকারী। আর যিনি সেই কথামালার মালাটিকে নিজ গলায়, গলা থেকে নিজ বক্ষে, বক্ষ থেকে নিজ হৃদয়ে চিরস্থায়ী করে নিতে পারেন, কোনো প্রকার মর্মবেদনা সেই তেলগ্রহীতার জন্য প্রযোজ্য নয়, তিনি সার্থক।

আবার অনেক ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, এমনকি একজন হোমিওপ্যাথির চিকিৎসককেও যদি তাদের স্বপক্ষে সত্য না বলে মিথ্যাকেই সত্যের প্রলেপে উদ্ভাসিত করা যায়, তারা সবাই আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো বলবেন, এর আগে আপনার মতো কেউ বলেনি আমাকে। যিনি বলেছেন, তিনি যে সত্য বলেননি, সেটি ধ্রুবতারার মতো সত্য। তবে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং চিকিৎসকদের একটি সুবিধা আছে, তারা আমৃত্যু নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কর্ম সম্পাদন করলেও কখনো 'অবসরপ্রাপ্ত' উপাধিতে ভূষিত হয় না। অবসরপ্রাপ্ত সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার রাজনীতিবিদদের যাবতীয় অপকর্মের স্বপক্ষে তৈলমিশ্রিত বাক্য উপহার দিলে তারা তখনই তাদের নিজস্ব রসে সিদ্ধ হতে, অথবা সিক্ত হতে হতে যখন সেই রসের তলানিতে গিয়ে দেখতে পান, পায়ের তলায় মাটি নেই, এমনকি সেসব 'তেলদাতারা কেউই আশপাশে নেই, তখন তিনি বুঝতে পারেন, এর আগে কেন আমার বোধোদয় হয়নি, কাল আমাকে ক্ষমা করবে না। ' 'এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে, চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র।

' যিনি এগিয়ে গিয়েছেন, সংসদ সদস্য হওয়ার আগে হাজার রকমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, হাজারের একটিও রক্ষা না করে ৪০-৫০ লাখ টাকার শুল্কমুক্ত গাড়িখানার কথা একবারও ভুল করেননি, তার চরিত্র যে ফুলের মতো পবিত্র, এ কথা এ এলাকার সবাই জানেন। অন্যের ঘর ভেঙে সুন্দরী সুশ্রীকে নিজের ঘরে তুলেছিলেন, যে সুশ্রী একদিন ওই সংসদ সদস্য রাজনীতিবিদকে কথার জালে কথার রসে সিক্ত করেছিলেন। অথচ সেই সংসদ সদস্য মিথ্যা প্রলোভনে ভোট নিয়ে, ভোটদাতাদের সঙ্গে প্রতারণা করে সংসদে না গিয়ে গিয়েছেন থাইল্যান্ডের পাতাইয়াতে। ফিলিপাইনের নাতিশীতোষ্ণ শহর 'বাগিও সিটি'তে- রাজধানী ম্যানিলা থেকে যার দূরত্ব ৩০০-৩৫০ কিলোমিটার। সমুদ্রসৈকত, পাঁচতারা, তিনতারা হোটেল, যাবতীয় লেহ্য পেয় এবং সারারাত হৈ-হুল্লোড়, যেমন আছে পাতাইয়াতে, আছে ভারতের গোয়া বিচে, এমনকি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে, সেসব দেশে যেতে আমাদের প্রিয় সংসদ সদস্যদের কোনো অসুবিধা না হলেও অসুবিধা হয় তার নির্বাচনী এলাকায় যেতে।

ঢাকা থেকে যার সর্বোচ্চ দূরত্ব ৩০০ অথবা ৪০০ কিলোমিটার। যেহেতু আমাদের রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক আমরা সবাই নিজের রসে সিদ্ধ হতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, যেহেতু তৈলসিক্ত আমাদের মন-প্রাণ-দেহ। মহামতি লেনিন কখনই তৈলসিক্ত হতে চাননি। তৈলমর্দনকারীরা তাকে তৈলাক্ত করতে চেয়েছিলেন। মহামতি যেদিন বুঝতে পারলেন, তার চারপাশে চাটুকারেরা তার ছায়াকে ঘিরে ফেলেছে, তখন তিনি অত্যন্ত সাবলীল কণ্ঠে জানালেন- 'আমি নিজের রসে সিদ্ধ হতে রাজি নই।

'মহামতি হতে না চাইলেও আমরা চাই, তবে রসে নয়, তেলে সিক্ত। সিদ্ধ হতে হতেই ৪২ বছর হারিয়ে গেল, মিশে গেল কালের ধুলোও। সেই ধুলোর উড়াউড়ি কবে শেষ হবে, কে শেষ করবেন সেটি একমাত্র আল্লাহ, ভাগবান, ঈশ্বর ছাড়া কেউ বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। বিগত ৪২ বছর গণতন্ত্রের জন্য এ দেশে হাজার রকমের ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি-বাদল হলেও সেই বাদলে শরীর ভিজেনি, রাজনীতিবিদদের, সংসদ সদস্যদের। কারণে, অকারণে আমাদের সংসদ সদস্যরা অভিমান করে ফিরে এসেছেন বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি লুই কানের সুরম্য, দৃষ্টিনন্দন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওই বিশাল ভবনের মায়া ত্যাগ করে।

শুধু একবার নয়, একাধিকবার। তবে ৯০ দিন পেরোনোর আগেই সংসদ সদস্যরা ছুটে গিয়েছেন, ল্যুই কানের সেই সুরম্য ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে, না গেলে 'সংসদ সদস্যত্ব' থাকবে না, পাওয়া যাবে না লেহ্য-পেয় মাসিক ভাতাসহ যাবতীয় সুখ স্বাচ্ছন্দ্য। এই স্যুট, এই স্বাচ্ছন্দ্য চিরতরে যেন নিজের করায়ত্তে থাকে, হয়তো সে দিকেই লক্ষ্য করে দলীয় প্রধানের ইচ্ছায়, ইশারায় সংসদ সদস্যদের যেতে হয় শেরেবাংলা নগরের সুরম্য ভবনের দিকে। এমনকি মাঝে মধ্যে বেড়িয়েও আসতে হয়।

এ প্রসঙ্গে দৈনিক তাদের সম্পাদকীয়তে 'সরকারের উদ্দেশ্য কি' এই শিরোনামে জানিয়েছিল- জুলাই মাসের নবম সংসদ অধিবেশনের টিআইবি রিপোর্ট।

কোরাম সংকট। দেরিতে অধিবেশন শুরুর কারণে প্রথম অধিবেশনে ২৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটে যার মূল্য ৫ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা, প্রতি মিনিটে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা এবং প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬শ' টাকা (সংক্ষেপিত) খরচ...। উলি্লখিত খরচগুলো আমার দেশের নাগরিকদের অর্থেরই অর্থ, সেই অর্থ সরকারদলীয় এবং বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে যোগ না দিয়ে তারা বিলাসভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন কখনো ইউরোপ, কখনো মধ্যপ্রাচ্যে। তাদের ইউরোপে যাওয়ার প্রধান কারণ হতে পারে- জার্মান কবি গ্যাটের (যোহান উলফ গ্যাইটে ভন, ১৭৪৯-১৮৩২ তার বিখ্যাত প্রোয়েটিক কাব্যড্রামা ফাউস্ত। যেখানে তিনি নিজ আত্দাকে ইবলিশের কাছে বন্ধক দিয়েছিলেন জ্ঞান অর্জনের জন্য।

ফাউস্ত ছিলেন মধ্যযুগের জাদুকর)। বিখ্যাত একটি কথা আমাদের দেশের সব রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে হোমিওপ্যাথির সেই চিকিৎসকও জানেন, জানেন সরকারি আমলা, নব্য ধনী, শুধু জানেন না এ দেশের গণ্ডমূর্খেরা, বিশ্বখ্যাত কবি গ্যাটে বলেছিলেন, যে বিদেশ যায়নি সে স্বদেশের স্বরূপ চিনতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যে গেলে নিজ অপরাধ স্খলনের একটি সুযোগ থাকে পবিত্র হজব্রত অথবা ওমরাহ ব্রতের মধ্যে। তাই সংসদ অধিবেশনে কোরাম পূরণ হয় না। উভয় দলের সংসদ সদস্যরা থাকেন দেশের বাইরে- গ্যাটের ওই কথাটি মনে রেখে।

আবার এমনটিও হয়তো হতে পারে, রাজনীতিবিদরা হয়তো ভাবতে পারেন, এ দেশ চলেছে উদ্ভট উঠের পিঠে, এক সময় সেই ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে উঠের পিঠ থেকে উঠ চালক নেমে যাওয়ার আগে-পরে অনুভব করেছিলেন, কবি শামসুর রাহমান, 'উদ্ভট উঠের পিঠে চলেছে স্বদেশ' কবি দেখলেও, দেখেনি আমাদের রাজনীতিবিদরা।

দেখলে নিশ্চয়ই দল বিশেষের উগ্রতা, ধর্মালয়ে আক্রমণসহ চাঁদে মানুষের মুখ দেখা- কথাটিকে মিথ্যার নিগড়ে না বেঁধে স্পর্ধান্ধিত না করে বরং নিরুৎসাহিত করতে পারতেন আমাদের শ্রদ্ধেয় সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ এবং মধ্যরাতের টেলিভিশনের 'টক'-বাজরা। টক-বাজসহ গণমান্যগণ মানবতা নিয়ে যারা গগনবিদারী চিৎকার করেন, তারা সবাই বিশ্বাস করছেন, চীনা দার্শনিক 'কনফ্যুসি'ওর- সে কথাটি। যেটি এ কালে, সেকালে এবং দ্রাবিড়, হুন আর্য-অনার্যদের কালেও সরকারবিরোধীরা চীনা দার্শনিকের বাণীটি জনসম্মুখে, উৎসাহে, উল্লাসে, বারবার বলেছেন, বাঘ হতে ভয়ঙ্কর অরাজক দেশ। ' আসলে কি তাই? আমার মনে হয় জুজুর ভয়ে যারা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রিটেনে বাড়িঘর কিনেছেন, কিনছেন- তারা নিশ্চিত হয়েছেন চীনা দার্শনিকের সেই বেদবাক্যে নির্বোধ আমরা, রাজনীতিবিদদের মিষ্টি কথায় ভোট শেষে দেখছি সব ধরনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তারা বাড়িঘর কিনছেন, লুটপাট কোটি কোটি টাকা, খরচ হচ্ছে ভোটাররা জানতে পারছি না।

এমনকি শেরেবাংলা নগরের সুরম্য ভবনের স্থাপতি লুই কানের সুদৃশ্য ভবনটি তাদের ডাকছে, 'আয় সংসদ সদস্য আয়, ঘরের ছেলে ঘরে আয়। '

কে শুনবে কার কথা, বিত্ত-বৈভব আগে, পরে দেশ-জাতি, ভোটাররা। সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে জীবনে আমার দুবার দেখা হয়েছিল, একদিন ঢাকার নিউমার্কেটে। একদিন শাহবাগের তৎকালীন বেতার ভবনে। সৈয়দ সাহেব আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাকে সবিনয়ে অনুরোধ করতাম, প্রিয় লেখক, আপনি দ্বিতীয়বার চাচাকাহিনী লিখুন, আমাদের নিয়ে।

লেখক : কবি।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.