'সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল_ তুলে নিল দ্রুত রথে'- রবিঠাকুরের 'শেষের কবিতা' উপন্যাসটি প্রবাসী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ভাদ্র, চৈত্র ১৩৩৫ সনে। উপন্যাসটি অসংখ্যবার পুনর্মুদ্রণ হয়েছে এবং রবিঠাকুরের শেষ বয়সের এই উপন্যাসটি ১৩৩৬ সনের ভাদ্র মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসে প্রেম, ভালোবাসা, পাওয়া-না পাওয়া, এমনকি সুখ-দুঃখ চরিত্রগুলোর প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস সহৃদয় পাঠকদের হৃদয়ে উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র লাবণ্যের একটি চিঠি, চিঠির অপর প্রান্তে দীর্ঘ একটি কবিতার পঞ্চম এবং ষষ্ঠ ছত্রের উদ্ধৃতি মাত্র।
ধাবমান কাল কখন যে কাকে জড়িয়ে ধরবে তার অদৃশ্য জালে এবং তুলে নেবে দ্রুত রথে, সেটি আমরা জানিনে, জানলেও দ্রুত রথে উঠবার আগেই উঠে যেতে পারি আমেরিকার রাইটস ব্রাদারদ্বয়ের বানানো সেই উড়োজাহাজে রথ ভেবে। কিন্তু অনেক সময় রথের রশি ধরার আগেই পুলিশের অতিথি হয়ে রথের রশির বদলে পুলিশের রশিই দেহের মধ্যভাগে পরিয়ে পুলিশরাই রথ হিসেবে টেনে নিয়ে যান বাংলার আষাঢ়-শ্রাবণে।
চারদিকে বৃষ্টি, কর্দমাক্ত চারদিক, শ্রাবণ মেঘের হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকি, কৃষ্ণবর্ণ রাত, দু এক পা করে যেন অতীতে এগিয়ে এসেছে, ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে। ভবিষ্যতের দিকে যাওয়ার আগে ধাবমান কাল কাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল সেটি দেখা যেতে পারে। যেমন দেখেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি তার একটি কবিতায় লিখেছিলেন_ চোখ বুজলে সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাই, আমার দূরেরটা স্পষ্ট...।
সেই দূরেরটাই আজকাল স্পষ্ট থেকে আরও স্পষ্টতর কেন যে হচ্ছে সেই ব্যাখ্যা দিতে গেলে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম অথবা সিনিয়র সহকারী সম্পাদক সুমন পালিত হয়তো বা পড়তে পারেন অতীত আর নয়, অথবা বলতে পারেন, অতীত না জানলে বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাঠককুল কিছুতেই জানতে পারবে না, সেসব দিনের কথাগুলো।
ধাবমান কাল কীভাবে জড়ায়ে ধরেছিল সেসব রাজনীতিবিদের কর্মকাণ্ডের ছিন্ন-বিছিন্ন ঘটনাবলী। যেসব ঘটনাবলী অত্যন্ত পীড়াদায়ক। তবে পীড়াদায়ক এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে নয়। যেহেতু তারা অতীত জানতে উৎসাহী নন, বোধকরি ভবিষ্যৎ নিয়েও তাদের চিন্তা করার সময় নেই, তারা আছে বর্তমান নিয়ে। তবু আমরা যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের কাছে অতীতের প্রাধান্যই গুরুত্বপূর্ণ।
ষাটের দশকের গোড়ার দিকে, তখন আমরা স্কুলের ছাত্র। একটু উপর ক্লাসের যারা তারা তখন শুনেছিলেন দুটি ছাত্র সংগঠনের নাম_ ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ। ছাত্র ইউনিয়নে সেকালে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা বেশি থাকার সুবাদে ছাত্র ইউনিয়নের কালচারাল উয়িংটা ছাত্রলীগের তুলনায় এগিয়ে থাকার সুবাদে অনেক ছাত্রছাত্রী ইউনিয়নের সদস্য হতে আগ্রহী হতেন। ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠনটির নাম শুনেছিলাম ১৯৬২ সালে প্রথম। ছিলাম পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিউশনের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।
একদিন হঠাৎ মাইকিং শুনতে পেলাম, পাবনার রূপকথা সিনেমা হলের মঞ্চে অগি্নকন্যা মতিয়া চৌধুরী বক্তৃতা দেবেন। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছেন সবার শফি ভাই। (শফি আহমদ ১৯৩৯-১৯৯১)। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিলেন জেনারেল সেক্রেটারি এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ও ছাত্র ইউনিয়ন পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সবার শফি ভাই।
শফি আহমদ ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন এবং মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষ অবলম্বন এবং রাজশাহীতে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কালো পতাকা প্রদর্শনে সাহসী ভূমিকা ও নেতৃত্ব প্রদানের জন্য পুলিশের লাঠিচার্জে গুরুতরভাবে আহত হন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ১৯৬৬-৬৭ সালে ডাকসুর জেনারেল সেক্রেটারি এবং ছাত্রলীগের তৎকালীন ছাত্র নেতাদের সঙ্গে ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকসহ পাবনা জেলা ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন ১৯৭২ অবধি।
আমার প্রিয় মাতুল রোকোনালী প্রায়শই জিজ্ঞাসা করেন, জানতে চান, তোরা ক'ভাই কেন যে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলি আমি এখনো বুঝতে পারি না। আমাদের জিন্নাহ সাহেব এবং ব্রিটিশ সাহেবরা অনেক ভালো ছিল তোদের নৌকাওয়ালাদের চেয়ে। একদিন ক্ষেপে গিয়ে প্রিয় রোকোনালীকে বললাম, 'আমরা বাঙালিরা অন্যের পদতলে, পদলেহনে থাকতে ভালোবাসি'।
যেমন আপনি এবং আপনার স্বজনেরা পদতলে থাকতে ভালোবাসেন। আপনার প্রিয় ইংরেজদের কীর্তিকাহিনী বাংলায় ছড়িয়ে থাকলেও ইতিহাস বলে অন্যকথা। মাতুলকে জানালাম, ইংরেজরা ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বুধবারে সিরাজউদ্দৌলাকে নামিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার সিংহাসন থেকে ঘরের শত্রু বিভীষণ দিয়ে। যেমন_ ১৯৭১ সালে আপনার দলের লোকেরা ছিল আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘরের শত্রু বিভীষণ। অথচ গত শতকের ত্রিশের দশকে বাংলার যুব বিদ্রোহের সময় তিন বাঙালি যুবক ১. বিনয় বসু ২. বাদল গুপ্ত ৩. দিনেশ গুপ্ত পিস্তল নিয়ে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে (আজকের মহাকরণ) ঢুকে পুলিশের হেড কনস্টেবল/ইন্সপেক্টর জেনারেল/মহাপরিদর্শক কর্নেল এনএস সিম্পসনকে তার অফিসকক্ষে হত্যা করেছিলেন।
কোনো বাঙালি যুবক যদি রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হতেন সিম্পসন তার ওপর চরম অত্যাচার করতেন। বিনয় দেহরক্ষীদের গুলিতে শহীদ হন। বাদল ধরা পড়ার পূর্ব মুহূর্তে সায়ানাইড খেয়ে আত্দহত্যা করেন। আর দিনেশের ফাঁসি হয়। এক সময় ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছিল বড় লাটকে মারতে গিয়ে।
১৯৭১ সালে ঢাকার উত্তরায় দক্ষিণখান ইউনিয়নের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন। আপনাদের প্রিয় গভর্নর মোনায়েম খান তার বনানীর বাড়িতে মোফাজ্জলের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। মোনায়েম খানের বাড়িতে মোফাজ্জলকে যেতে হয়েছিল গরুর রাখাল সেজে। আপনাদের স্বজনরা পাবনার রিদ্দিক, বাদলসহ অজস্র তরুণকে ধরে এনে ক্যাপ্টেন জায়েদীর হাতে তুলে দিয়ে শহরের রাধানগর থেকে জনৈক খোন্দকারের নির্দেশে নতুন ব্রিজের পূর্বপ্রান্ত থেকে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ' বলতে বলতে এগিয়ে যেতে দেখেছি স্বচক্ষে। সেই খোন্দকারও রেহাই পাননি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম, ইকবাল হোসেন, রফিকুল ইসলামের হাত থেকে।
কেননা, অত্যাচারীরা কখনই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেন না। ইতিহাস অন্তত তাই বলে। ক্যাপ্টেন জায়েদী পালিয়ে গেলেও, পালাতে পারেনি অনেক পাকিস্তানপ্রেমী। ব্রিটিশ শাসনের প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতাকামীদের ফাঁসি, হত্যা, গুম, দ্বীপান্তর। বগুড়ার বিখ্যাত বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী অত্যাচারিত হওয়ার আগেই সায়ানাইড পানে আত্দাহুতি দিয়েছিলেন সম্ভবত সেই ত্রিশের দশকে।
কিন্তু আপনাদের স্বজনেরা মুক্তিকামী মানুষদের, মুক্তিযোদ্ধাদের কখনো বাঘের খাঁচায়, কখনো জয়পুরহাটের নবম শ্রেণীর ছাত্র- মুক্তিযোদ্ধাকে স্বহস্তে গুলি করে মারতে দ্বিধাবোধ করেনি। এমনকি আপনাদের তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের কোথাও হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গাপূজা তো দূরে থাকুক, পাবনার আরিফপুর গোরস্তানের ঈদের মাঠ থেকে এবং আরিফপুরের হাজীরহাটে যাওয়ার পথে দোহারপাড়া থেকে জনাকয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেই আলীমুদ্দি আকন্দ। যাদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল তারা আর কোনোদিন ফিরে না এলেও আপনারা এখনো সেই পাকিস্তানের স্বপ্ন, সেই ইংরেজের শাসনের স্বপ্ন দেখছেন। প্রিয় মাতুল প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ১৯৭১ সালের বছরটা ছিল 'গণ্ডগোলের বছর'। সে বছর পূজা হতে না দিলেও ২০১৩ সালে, পাবনা শহরে ও আশপাশের উপজেলায় তো দুর্গাপূজা মালাউনেরা করেছে, হয়তো হাতে গুনলে ১০ থেকে ১২টির বেশি হবে না।
মাতুলকে থামিয়ে দিয়ে একটি পরিসংখ্যান দিলাম। পাবনা জেলায় ৩২০টি, পাবনা সদরে ৪৯টি, আটঘড়িয়া উপজেলায় ১৪টি, ঈশ্বরদীতে ২৫টি, ভাঙ্গুড়ায় ১৭টি, চাটমোহরে ৪৭টি, ফরিদপুর উপজেলায় ১৫টি, বেড়ায় ৫৩টি, সুজানগরে ৫৯টি এবং সাঁথিয়ায় ৪১টি। পাবনার ৮টি উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস এখনো ১৯/২২ পার্সেন্ট। তথ্য প্রদানকারী বাংলাদেশ বেতারের পাবনা প্রতিনিধি শ্রী সুশীল তরফদার।
মাতুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, সাঁথিয়াই ছিল আমাদের এক মহান নেতার বাড়ি।
যার নির্দেশে আমরা জ্বালিয়েছি, পুড়িয়েছি, হত্যা, ধর্ষণ সবই করেছি। তারপরও দেশে এখনো এত মালাউনের বসবাস, তোরা নৌকাওয়ালারা ভুলে গিয়েছিস সেই লড়কেলেঙ্গের ১৯৪৬ সালে কলকাতায়, বিহারে পাঞ্জাবের মুসলিম নিধনের কথা জানালাম, তখন আমার জন্মই হয়নি। মৃদু হেসে রোকোনালী বললেন, আমাদের সঙ্গে তোরা ক'ভাই না থাকলেও আছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া এমনকি চট্টগ্রামের হাটহাজারী। আমাদের নেতার নির্দেশের বাইরে আমরা কোথাও যাই না। যদিও সাঁথিয়ার সেই নেতা এখন বাইরে নেই, ১৪ শিকের ভেতরে।
প্রিয় মাতুল রোকোনালী বাক্যটি শেষ করলেন ভেজা কণ্ঠে, ভেজা চোখে।
কথোপকথন শেষ করে বাইরে এসে শুনলাম জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। আরও শুনলাম এ সব তরুণ জিন্দাবাদীদের অগ্রে এবং পশ্চাতে ছায়ার মতো লেগে আছে সেই পরাজিতরা, যারা ১৯৭১ সালে ছিলেন তাদের প্রিয় পাকিস্তানের জন্য অন্তঃপ্রাণ। আর আজকাল সেই অন্তঃপ্রাণীদের প্রায়শই দেখি মধ্যরাতের টেলিভিশনে, মাঝেমধ্যে শুনি তাদের বাণী। বাণীদাতারা যে সুবিধাবাদী সেটি যে নিশ্চিত তা তারা জানেন।
ওই বাণীদাতাদের একজনকে আশির দশকের একটি বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিকে চাকরির সুবাদে তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশন অফিস কলকাতায় প্রেসের দায়িত্ব দিয়ে কলকাতা মহানগরে পাঠিয়েছিলেন। সেই নীতিবাগিশ, নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়ার পর বাংলাদেশ সরকার ফেরত আনতে বাধ্য হয়েছিল। সংবাদটি ছাপা হয়েছিল কলকাতার বহুল সমাদৃত পত্রপত্রিকায়। ছিলাম কলকাতায় অন্নদা শংকর রায়ের বাড়িতে। তাকে দেখি, তিনি মধ্যরাতে বাণী বিতরণ করছেন।
গণতন্ত্র নিয়ে দোষ-নিন্দায় মগ্ন, অতীতের চেয়ে বর্তমান নিয়ে। কিন্তু তিনি এবং মধ্যরাতের বাণী বিতরণকারীরা একবারও হয়তো কখনো কোনোদিন পড়েননি রবিঠাকুরের শেষের কবিতার ওই কবিতাটি। যেখানে কাল ধাবমান। ওইসব সুবিধাবাদী, পালক বদলকারীদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে না। ধাবমান কাল।
লেখক : কবি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।