'যে আমাকে দুঃখ দিল, সে যেন আজ সুখেই থাকে' একটি কবিতার একটি চরণ। এই কবিতার চরণ থেকে শুনতে পাই কবির একটি প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস এবং এটাই প্রেমিকার প্রতি আশীর্বাদ। যে প্রেমিকা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেছে, যে প্রেমিকা তাকে হয়তো বলেছিল, দেখা হবে ঝাউতলা রোডে, চন্দ্রিমা উদ্যানে, অথবা বকুল তলায়, অথবা যে কোনো আইস পার্লারে, মিথ্যা আশ্বাসে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে কেটেছে সময়। জীবনের প্রথম প্রেম গঙ্গায় নিমজ্জিত প্রেমিকপ্রবর কোনো রকমে প্রেমগঙ্গা থেকে সাঁতরে কূলে উঠেই প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাসের পর ভেজা চোখে, ভেজা কাপড়ে কবি লিখেছিলেন, তার সেই অমর বাণী। 'যে আমাকে দুঃখ দিল সে যেন আজ সুখেই থাকে।
'
এই দুঃখ, এই বেদনা এবং সুখ বিতরণ না করেই যে কবি তার প্রিয়তমাকে, দয়িতাকে পেয়েছেন হৃদয়ের মধ্যগগনে সেই কবি, সেই প্রেমিক সার্থক, যেমন গোলাম মওলা রনি (সংসদ সদস্য) তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন অন্ধপ্রেমিক। অন্ধ প্রেমিকদের পথ চলতে গেলে, বিভিন্ন সময় পথে-প্রান্তরে হোঁচট খেতে হয়। কটূবাক্য-শ্লেষমিশ্রিত বাণী, কৃপাদৃষ্টিতে না দেখে কুদৃষ্টিতে প্রেমিকার স্বজনরা দেখলেও প্রেমিক-প্রেমিকা সলিলে-সলিলে ভেগে যেতে চান, বরিশালের সুগন্ধা, পায়রা এবং ধানসিঁড়ি নদীর নরম সলিলে। যেমন গিয়েছিলেন ওই বরিশালের কবি জীবনানন্দ দাশ, ধানসিঁড়ি পায়রা এবং সুগন্ধা পেরিয়ে দূরের নাটোরের বনলতার কাছে।
মাঝপথে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, এমনকি চলনবিলও জীবনানন্দকে নিশ্চয়ই পাড়ি দিতে হয়েছিল।
প্রেম যে অন্ধ, প্রেমিকও তেমন অন্ধ, প্রেমিকার ক্ষেত্রটি বোধকরি অন্ধ নয়, কারণ হিসেবে কার্যকারণে, আমাদের প্রেমিকারা বাড়ির উঠোন ছেড়ে, শিউলিতলায় আসতে তার ভীষণ ভয়, পিছে কেউ যদি দেখে ফেলে, মিস সেন এই অবেলায় ভালোবাসার টানে হাতে সামান্য কাপড়ের পুটলি নিয়ে কার কাছে, কোন দিকে যাচ্ছে, খবরটি নিতে হয় পাড়ার ছেলেদের। দিতে হয় সেন পরিবারের প্রধানকে। কবি হয়তো বসে আছেন নাটোর রেল ইস্টিশনে, দয়িতার অপেক্ষায় ইতোমধ্যে তিনি স্বপ্নজগতে দেখতে পেলেন, মিস সেনের কালো চুলের খোঁপা। দেখতে পেলেন চড়ুই-বাবুই পাখির বাসার মতো দুটি চোখে, দুর্ভাগ্য কবি প্রেমভুবন থেকে, স্বপ্নজগৎ থেকে দেবতাদের পদাঘাতে ফিরে এলেন কণ্টকময় ধুলাধূসরিত হিংসা-দ্বেষ, সংঘাত, রাজনীতিবিদদের মিথ্যাচার, অশিক্ষা, কুসংস্কার, পরচর্চা, পরনিন্দা এবং কপট এক বাস্তবতার ভিড়ে, ... কোনো কবি, কোনো প্রেমিক কোনো দিনই বলেনি, কিন্তু মিস সেন, কবিকে কথা দিয়ে মন্দির না ভাঙলেও পারতেন। কবি হয়তো অপ্রকাশ্যে কেঁদেছেন- দয়িতার ব্যবহারে তিনি হয়তো মর্মবেদনায় ভুগেছেন, সেই মর্মবেদনার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে কবির জীবনে, ট্রামের নিচে।
গোলাম মওলা রনি ভীষণ ভাগ্যবান, ইতোমধ্যে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের লাখো-কোটি তরুণ-তরুণী, প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য দুনিয়া কাঁপানো প্রেমবিষয়ক তথ্যাদি জানিয়েছেন, জানিয়েছেন রাজা-বাদশাদের হেরেম কাহিনী, ইতিপূর্বে এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা জানতেন কিনা- তাদের না জানারই কথা। যেহেতু ইন্টারনেট, মোবাইল, কম্পিউটার এবং অন্যান্য সাইবারে ইতিহাস অনুপস্থিত। উপরন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম থাকার সুবাদে অনেক শিক্ষার্থী ইতিহাস, ভূগোল-বিমুখ। দোষ এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীর নয় বলেই আমার বিশ্বাস। ক্লাস-কেজির [কিন্ডারগার্টেন শব্দটি জার্মানি] তিন-চার বছরের একটি শিশুকে ব্যাগভর্তি বই-খাতা, খাবার, পানির বোতলসহ প্রায় দুই থেকে তিন কিলোর মতো ওজন বহন করতে হয়।
হাঁসফাঁস করেও রক্ষা নেই। প্রতিদিন ভোর বেলায় শিশুটি পাখির ডাক, ফোঁটা ফুল, গ্রীষ্ম, নাকি বর্ষা এসব দেখার এবং জানার সুযোগ হয় না তার। আমার প্রতিবেশীর বাচ্চা বাচ্চা শিশুদের ওপর অমানবিক অত্যাচার দেখে মনে পড়ে- যখন ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়েছি, কোনো দিনই ব্যাগে টিফিন, পানির বোতল টানতে হয়নি মফস্বলের ছাত্রছাত্রীকে। আমরা তখনই জেনেছি বাংলাদেশের হরেক রকমের ফলের নাম, এই দেশে কয়টি ঋতু জেনেছি, স্কুলের পণ্ডিত, গুরুমশাইদের কাছ থেকে। আজকাল নাকি শিশুর মা-বাবাকে গুরুমশাইরা ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিং এবং হাউসটিউটরের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
দিন কয়েক আগে জামালপুর জেলার ইসলামপুরের কূলকান্দি ইউনিয়নে গিয়েছিলাম ঢাকা থেকে কয়েকজন যমুনা নদীর ভাঙন দেখতে। প্রায় ২৫ বছরের অব্যাহত ভাঙনে ১৩টি গ্রামের ১২টিই ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। যমুনার পূর্ব পাড়ে জামালপুর জেলা, পশ্চিমে গাইবান্ধা, সারিয়াকান্দি। ২০-২৫ হাজার মানুষ ভিটেমাটি, স্কুল, মাদ্রাসা এমনকি ১৫০-২০০ বছর আগের পাকা মসজিদটির অস্তিত্ব বিলীন করে দিয়েছে যমুনার ভাঙন। ইতোমধ্যে হারিয়েছে ইউপি ভবনসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
কথা প্রসঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ ফরিদুল খান দুলাল জানালেন, ইউনিয়নটি রক্ষাকল্পে ১৯৯৫-৯৬ সালে ফ্যাপ প্রকল্পের আওতায় জার্মানি ও ফ্রান্সের আর্থিক সহযোগিতায় যমুনা নদীর কূলকান্দি এলাকায় নির্মিত হয় ৫০ কোটি টাকায় একটি হার্ডপয়েন্ট। এ বছর প্রচণ্ড পানির চাপে মুহূর্তেই নিঃশেষিত হয়ে যায় যাবতীয় বাড়িঘর, মন্দির, মসজিদ, বিদ্যালয়গুলো।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সদয় পাঠকরা হয়তো প্রশ্ন করবেন, জনাব রনি এবং কবি জীবনানন্দের বাড়ি বরিশাল। দুজনই যাচ্ছেতাই রকমের প্রেমিক, অন্ধপ্রেমিক। তাদের প্রেমের বাগানে হঠাৎ জামালপুরের ইসলামপুরের কূলকান্দি ইউনিয়ন, যমুনার ভাঙন, এসবের প্রবেশ কেন? এই কেন-র-এর উত্তর দেওয়া যাবে।
তার আগে সবিনয়ে ফিরে যেতে চাই সেই কূলকান্দি গ্রামে। যে গ্রাম একদা সূবর্ণ গ্রাম ছিল। যে গ্রামে পাওয়া যেত যমুনার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, পাখির কলকুঞ্জন, ঈদে আনন্দ, পুজোয় ঢাকের বাদ্যি। স্কুলে, মাদ্রাসায় ছাত্রছাত্রীর যাতায়াত, নৌকাবাইচ, চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রকৃতির মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা।
সেই প্রেম, সেই ভালোবাসায় বাদসাধলেও যমুনা নদী, গ্রাম থেকে গ্রামান্তর দিনের আলোয়, কৃষ্ণপক্ষের রাতে, কালপেঁচার রাতভর ডাকাডাকি, রাতের নিশাচর প্রাণীদের অপহরণ, শেয়াল পণ্ডিতের অবাধ বিচরণ, কলেরা, বসন্ত, উলাওঠা শুক্লপক্ষের-কার্তিকের কাকচক্ষু জোছনার ভেতরে-বুড়ো ইঁদুর মনের আনন্দে কৃষকের সোনার ধান নিঃশেষ করে যখন এসেছে গোলার বাইরে- হয়তো তখনই গুইসাপ তার রাতের আহার সম্পন্ন করলেন সেই ধাড়ি ইঁদুরকে দিয়ে।
আজ সেই কূলকান্দি গ্রামের মানুষজন নিঃস্ব, দিশাহারা। তবে প্রেম নিঃশেষ হয়নি- শত-সহস্র দুঃখ-কষ্টের ভেতরেও। মানবপ্রেম প্রাচীন থেকে প্রাচীনতর বলেই গ্রামপুলিশ সদস্য শ্রী মানিক, জনাব রফিক এবং জনাব বরকতের কাছ থেকে জানতে চাই তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা। তিনজনই জানালেন, মর্মান্তিক কথা। (১) গ্রাম পুলিশের সরকারি বেতন সারা মাসে মাত্র ১১০০ টাকা।
ইউনিয়ন পরিষদ বেতন ৮০০ টাকা। ইউনিয়ন পরিষদের যে বেতন ৮০০ টাকা ধার্য করা হয়েছে, সেটি তারা নিয়মিতভাবে কোনো দিন পান না। কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কা.বি.খা) কর্মসূচির কিছু অর্থ কাজকর্ম শুরু হলে স্থানীয় কূলকান্দি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মিসেস সেলিনা আলম দয়া পরবশ হয়ে দিয়ে থাকেন। একইভাবে কিছু অর্থ অফিস কেরানি আফসার আলীও পেয়ে থাকেন। তিনজন গ্রাম পুলিশের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম সামান্য ১১০০ টাকায় আপনাদের সংসার চলে কেমন করে? তিনজনই জানান, বাপ-দাদার কিছু জমি-জমা আছে, সঙ্গে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পুষি।
প্রতি হাটে সারা দিন ডিউটি করলে মহাজনরা খুশি হয়ে যে যা দেন। একজন সাপুড়ে জানালেন, গ্রামে সাপ-নেউলও নেই। ভেসে গেছে যমুনার স্রোতে। শ্রী মানিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ছেলেমেয়ে কটি- বলল দুটি, স্কুলে পড়ে। বরকত জানালেন, তার ছয়টি মেয়ে, একটি ছেলের অপেক্ষায় আছে।
আহারের কথা, বিদ্যার কথা জানতে চাইলে, বরকত জানালেন, সে সবের দায়িত্ব আল্লাহর। মুখ দিয়েছেন যিনি, আহারও দেবেন তিনি, তার যুক্তি অকাট্য। ভাঙনের শব্দ শুনছি, ভাঙন দেখছি স্বচক্ষে। যমুনার প্রচণ্ড স্রোতের ঘূর্ণাবর্তে একটি নৌকাকে দেখলাম চোখের সামনে ডুবে যেতে। খারাপ লাগল।
দুই একজন যাত্রী ছিলেন, তারাও ভেসে গেলেন, নাকি ডুবে মারা গেলেন বুঝে ওঠার আগেই দেখি ১ নম্বর কূলকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিনা আলম। তাকে গ্রামপুলিশ এবং কেরানির বেতন-ভাতার কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি জানালেন, যদিও ১৭৫ ভোটে জিতেছিলাম এবং অনেক কথাই দিয়েছিলাম আমার ইউনিয়নবাসীকে, কথা রাখতে পারিনি। আর আমিই এই জামালপুরের প্রথম মহিলা ইউপি চেয়ারম্যান। ভোট হয়েছিল গত বছর ২১/৫/১২ তারিখে।
১নং কূলকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আপার কথায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টান লক্ষ্য করায় তাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
তিনি জানালেন, তার বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানে। তখনই জানতে চাইলাম, সুদূর চট্টগ্রামের রাউজান থানার মেয়ে এখানে এলেন কি করে? সুশ্রী-সুন্দরী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আপা মৃদু হেসে সলাজ মুখে জানালেন, চলে এলাম ওর টানে, ওর সঙ্গে কি করে কিযে হলো- বুঝতেই পারলাম না। অর্থাৎ প্রেমের মরা জলে ডুবে না।
গোলাম মওলা রনি, কিংবা জীবনানন্দের নন্দিনী, মিস সেন এবং সেলিনা আলম কেউ-ই মুক্ত হতে পারেনি রবি ঠাকুরের প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবন থেকে। সব কবিকেই আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে পরখ করি।
পরখ করি তাদের রচনা, মওলা যে পদ্য লেখেন সেটি জানলাম ১০/৭/১৩ এর বাংলাদেশ প্রতিদিনের জনৈক ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা পদ্যটির প্রথম চরণ পড়ে। ভাগ্যিস তিনি লেখেননি, সেই লেখাটিকে নিয়ে-। বেশধারী, সাদা চুল, গোঁফ সাদাভুষণ নিয়ে- যে আমাকে দুঃখ দিলো সে যেন আজ আমাদের প্রেমের ভুবনে, ভাঁওতাবাজির জাল না বিছিয়ে রাখে- বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক জনাব নঈম নিজামকেও ধন্যবাদ। তিনি তার পত্রিকার মাধ্যমে আমাদের জানাচ্ছেন প্রেম অমর, অদ্বিতীয়। লেখক : কবি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।