"সাকরাইন" পুরান ঢাকার আদি ঢাকাইয়াদের পৌষ সংক্রান্তির ঘুড়ি উড়ানোর ঐতিহ্যবাহী উৎসব। সেই ভোর থেকেই শুরু হবে ছাদে ছাদে ঘুড়ি উড়ানো আর আকাশ থাকবে ঘুড়িদের দখলে।
পিঠা-পুলি, বিরিয়ানি, কাবাব আর নানা আনন্দের মধ্যে পালিত হবে এই দিনটি। কালক্রমে এটি এখন সবারই আনন্দের দিনে পরিনত হয়েছে।
সাকরাইন নিয়ে আবু সায়ীদের সুন্দর এই লিখাটি আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম
সাকরাইন: ঢাকাইয়াদের পৌষ সংক্রান্তির ঐতিহ্যবাহী উৎসব
==================================
চৌদ্দ জানুয়ারী পুরান ঢাকার আকাশ থাকবে ঘুড়িদের দখলে।
আকাশ জুড়ে নানান রং আর বাহারের ঘুড়িদের সাম্যবাদ। গত এক সপ্তাহ ধরে পুরান ঢাকার বাহান্ন রাস্তা তেপান্ন গলির অধিকাংশ গলিতে আর খোলা ছাদে চলছে সুতা মাঞ্জা দেওয়ার ধুম। রোদে সুতা শুকানোর কাজও চলছে পুরোদমে। যদিও মাঞ্জার স্থান দখল করে নিচ্ছে রক সূতা নামের এক ধরনের সূতা। শীতের উদাস দুপুর আর নরম বিকালে আকাশে গোত্তা খাচ্ছে নানান রঙের ঘুড়ি।
ঘুড়িতে ঘুড়িতে হৃদ্যতামূলক কাটা-কাটি খেলাও চলছে। অহরহ কাটা-কাটি খেলায় হেরে যাওয়া অভিমানী ঘুড়ি সুতার বাধন ছিড়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে।
চৌদ্দ জানুয়ারী পৌষ মাসের শেষ দিন। পৌষ সংক্রান্তির দিনই পালিত হয় পুরান ঢাকার এবং আদি ঢাকাইয়াদের ঐতিহ্যের সাকরাইন উৎসব। ভোরবেলা কুয়াশার আবছায়াতেই ছাদে ছাদে শুরু হবে ঘুড়ি ওড়ানোর উন্মাদনা।
ছোট বড় সকলের অংশগ্রহনে মুখরিত থাকবে প্রতিটি ছাদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়বে উৎসবের জৌলুস। আর শীতের বিকেলে ঘুড়ির কাটা-কাটি খেলায় উত্তাপ ছড়াবে সাকরাইন উৎসব। এক দশক আগেও ছাদে ছাদে থাকতো মাইকের আধিপত্য। আজ মাইকের স্থান দখল করেছে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম।
উৎসবের আমেজ থাকবে পুরান ঢাকার সর্বত্র। গেন্ডারিয়া, তাঁতীবাজার, লক্ষীবাজার, চকবাজার, লালবাগ, সূত্রাপুর মাতবে ঐতিহ্যের এই উৎসবে। আকাশে উড়বে ঘুড়ি আর বাতাসে দোলা জাগাবে গান। মাঝে মাঝে ঘুড়ি কেটে গেলে পরাজিত ঘুড়ির উদ্ধেশ্যে ধ্বনিত হবে ভাকাট্টা লোট শব্দ যুগল।
সাকারাইন উৎসব এখন আর শুধু ঢাকাইয়াদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
সাকরাইন পুরান ঢাকায় বসবাসকারী সকল মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। পুরান ঢাকার এই সকল ঐতিহ্যগুলো সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে সচেতন এবং ঐতিহ্যগুলো পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, পুরান ঢাকার সার্বজনীন উৎসব ঈদ মিছিল, বৈশাখী মেলা আর সাকরাইন উৎসব। আশার কথা এই যে, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবন, সংরক্ষন এবং জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বর্তমান প্রজন্ম সচেতন।
অতীতে সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো ছিলো অবশ্য পালনীয় অংগ।
ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হতো আত্নীয়-স্বজন এবং পাড়ার লোকদের মধ্যে। নীরব প্রতিযোগিতা চলতো কার শ্বশুরবাড়ি হতে কত বড় ডালা এসেছে। আজ এই সব চমৎকার আচারগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। আদি ঢাকার বসবাসকারী সকল মানুষ এই ঐতিহ্যগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করেন। নতুন প্রজন্মকে শোনান সেই সব মুখরিত দিনের কথা।
মনের খুব গভীরে পরম মমতায় লালন করেন ঐতিহ্যের পরম্পরা। স্বপ্ন দেখেন এই সকল প্রাণময় ঐতিহ্যগুলো আবার পুনরুজ্জীবিত হবে।
তাঁতী বাজার, সূত্রাপুর আর লালবাগে চলছে ঘুড়ি বানানোর শেষ সময়ের ব্যস্ততা। নাটাই কেনবার পালা শেষ। পুরান ঢাকা অপেক্ষা করছে ১৪ই জানুয়ারীর শীত সকালের।
শুরু হবে উৎসব। আর সন্ধ্যায় আধার ঘনাবার সাথে সাথে পুরান ঢাকা সকল জঞ্জাল আর কালিমা পুড়িয়ে ফেলার আর আতশবাজীর খেলায় (ইংরেজীতে যাকে বলে ফায়ার ওয়ার্কস) মাতবে। রাতে কেউ কেউ উড়াবে ফানুস। সাকরাইন এমনই সুন্দর আর অর্থপূর্ণ ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব।
পুনশ্চ:
১.ঢাকাইয়াদের ভাষায় ঘুড়িকে বলে ঘুড্ডি বা গুড্ডি।
ঘুড়ি উড়ানোর জন্য সূতাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ধারালো করা হয়। ধারালো করবার এই প্রক্রিয়াকে বলে মাঞ্জা । ঘুড়ির কাটাকাটি খেলায় কোন ঘুড়ি কেটে গেলে বলা হয় বাকাট্টা লোট। বিভিন্ন রকমের/ডিজাইনের ঘুড়ি পাওয়া যায় যেমন চোখদার, মালাদার, ঘায়েল, দাবা প্রভৃতি। এইবার যুক্ত হয়েছে রংধনু মার্কা।
২. সাকরাইন শুধু ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব নয়। পুরান ঢাকার ঘরে ঘরে চলবে মুড়ির মোয়া, ভেজা বাখরখানি আর পিঠা বানানোর ধুম।
৩. গত কয়েক বছর যাবত ছোট আকারের লাটাই পাওয়া যাচ্ছে। এই ছোট আকারের লাটাই হাতে নিয়ে সাকরাইনের উন্মাদনায় ঢাকার আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধিরা জানান দিবে তাদের উচ্ছাস ও আনন্দ।
---------------------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------------------------------- ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।