আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষের যন্ত্রণা এবং সৌরভের সৌরভ ছড়ানো

এনামুল হকের ডাকনাম বিজয়। ওয়াটলিং এটি জানলে নির্ঘাত তাঁকে ‘মিতা’ বানিয়ে ফেলবেন। ‘বিজয়’ তো কিউই উচ্চারণে ‘বিজে’-ই হয়ে যায়। ওয়াটলিংয়ের নামের শুরুতেও ‘বিজে’—ব্র্যাডলি-জনের সংক্ষিপ্ত রূপ।
মিল আছে আরও।

এনামুল এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দলে নির্ভেজাল ওপেনার হয়ে থাকলেও আসলে উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম কিপিং গ্লাভস খুলে রাখায় নিউজিল্যান্ড দলে ওয়াটলিং-ও এখন তা-ই। তবে আদতে তিনিও ওপেনার। টেস্ট অভিষেকও এই ভূমিকাতেই। প্রথম আট টেস্টের পাঁচটিতেই ওপেন করেছেন।


চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিন কাকতালীয়ভাবে আরেকটি জায়গায় মিলিয়ে দিল দুজনকে—ভাগ্য। ক্রিকেটে শুধু ভাগ্য দিয়ে কিছু হয় না, এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি, ব্যাটিং-বোলিং-অধিনায়কত্ব সবকিছুতেই সফল হতে ভাগ্যের একটু ছোঁয়া লাগে। এতটাই যে সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক বলে বিবেচিত রিচি বেনো অধিনায়কত্ব নিয়ে বলেন, ‘অধিনায়কত্ব ১০ ভাগ স্কিল আর ৯০ ভাগ ভাগ্য। ’ তবে আউট হয়ে ফিরে যেতে যেতে আবার ফিরে আসার ভাগ্য ব্যাটসম্যানের কদাচিৎই হয়। কাল যেটি হলো ওয়াটলিং ও এনামুলের।

মিলটা এখানেই শেষ। আবার আসছেন রিচি বেনো। অধিনায়কত্বকে ১০ ভাগ দক্ষতা আর ৯০ ভাগ ভাগ্য বলার পর যিনি যোগ করছেন, ‘দোহাই লাগে, ওই ১০ ভাগ ছাড়া এটা চেষ্টা করতে যেয়ো না। ’ ভাগ্যের ‘৯০ ভাগে’ ওয়াটলিং আর এনামুলের মিল থাকল, কিন্তু দক্ষতার ‘১০ ভাগে’ কাল অন্তত আকাশপাতাল তফাত। রুবেলের বলে গালিতে ক্যাচ দেওয়ার পরও টেলিভিশন রিপ্লে সেটিকে নো বল ঘোষণা করার পর ফিরে এসে ওয়াটলিং সেঞ্চুরি করে ফেললেন।

আর ব্রেসওয়েলের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে একই রকম ‘নো বল ভাগ্যের’ পরশ পেয়ে এনামুল যোগ করতে পারলেন আর মাত্র ২ রান।

কাকতালীয় এই মিল-অমিল নিয়ে এতগুলো শব্দ খরচ করে ফেলার কারণ আছে। এই টেস্টে যে এটির অসীম প্রভাবশালী হয়ে দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা। রুবেলের নো বলটি না হলে ২৯০ রানে নিউজিল্যান্ডের অষ্টম উইকেট পড়ে যায়। যেটি পড়ল গিয়ে আরও ৪৯ রান যোগ হওয়ার পর।

রুবেলের আত্মদহনের গল্পে এটি ভূমিকা মাত্র। মূল আখ্যানভাগ শুরু নিউজিল্যান্ড ৯ উইকেটে ৩৪২ হয়ে যাওয়ার পর, যখন ট্রেন্ট বোল্টকে সঙ্গী করে বাংলাদেশের বুকে শেল হানতে শুরু করলেন ওয়াটলিং।

এ বছরের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ উইকেটে এই দুজনের ৫৯ রানের জুটি আছে। মে মাসে নিল ওয়াগনারের সঙ্গে মিলে ইংল্যান্ডকে ৫২ রানের ‘শেষের যন্ত্রণা’ উপহার দিয়েছেন বোল্ট। তবে কাল যা হলো, সেটিকে একটু বাড়াবাড়িই বলতে হয়।

মমিনুলের বাঁহাতি স্পিনে ওয়াটলিংয়ের স্টাম্পিংয়ের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ডের ইনিংস যখন শেষ হলো, দশম উইকেটে টেস্ট ইতিহাসে সপ্তম সর্বোচ্চ জুটিটি (১২৭) হয়ে গেছে।

মুশফিকুরদের জন্য শেষ উইকেট জুটিতে সেঞ্চুরির অভিজ্ঞতা নতুন, তবে বাংলাদেশের জন্য নয়। প্রেসিডেন্টস বক্সে বসে খেলা দেখতে দেখতে হাবিবুল বাশারের মন বারবার ফিরে যাচ্ছিল ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে। বঙ্গবন্ধুতে জহির খানকে সঙ্গে নিয়ে শচীন টেন্ডুলকারের ১৩৩ রানের শেষ উইকেট জুটির সেই দুঃস্মৃতি থেকেই অনুমান করে নিচ্ছিলেন মুশফিকুর রহিমের মনে অসহায়ত্বের আকুলিবিকুলি। ‘এসব পরিস্থিতিতে অধিনায়কের যে কী অসহায় লাগে! সেদিন মাঠে থেকে অসহায় লাগছিল, আজ মাঠের বাইরে থেকে’—রাতে বলছিলেন তখন অধিনায়ক আর এখন নির্বাচক হাবিবুল।

তামিম ইকবাল ও এনামুল হকের মনে অসহায়ত্ব বোধের চেয়েও বেশি খেলা করার কথা বিরক্তি। ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ওপেনাররা আলাদা প্রজাতির। মনমানসিকতায় যেমন আলাদা, তেমনি ব্যাটিংয়ের চ্যালেঞ্জেও। ওপেনারকুলের অন্যতম শিরোমণি সুনীল গাভাস্কার একজন ওপেনারের জন্য কঠিনতম সময় বলেছেন এটিকেই—নবম উইকেট পড়ে যাওয়ার পর যখন ব্যাটিংয়ে নামার মানসিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন, অথচ ইনিংস আর শেষ হচ্ছে না!

তামিম ইকবালের টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম গোল্ডেন ডাকে এর ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। ব্যাটিংয়ে ভালো করার উত্তেজনাতেই কিনা, ট্রেন্ট বোল্টের প্রথম বলটি মহা-ওয়াইড।

যা দেখে মনে হলো, কদিন আগে অবসর নেওয়া স্টিভ হার্মিসনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য! ২০০৬-০৭ অ্যাশেজের প্রথম বলটিই তো প্রায়!

দ্বিতীয় বলটিও অফ স্টাম্পের বাইরে। যেটিতে কপিবুক কাভার ড্রাইভ খেললেন তামিম ইকবাল। কিন্তু একটু অ্যাওয়ে সুইং সেটিকে কাভারের বদলে নিয়ে গেল গালির হাতে। বাংলাদেশ ১/১। নো বলে এনামুলের পুনর্জন্মকে ক্ষণস্থায়ী বানিয়ে ৩.৩ ওভারেই তা ৮/২।

বাংলাদেশের টপ অর্ডারে তামিমকে বাদ দিলে বাকি তিনজন টেস্ট ক্রিকেটে ‘ওরে আমার নবীন, ওরে আমার কাঁচা। ’ রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘা মেরেই আধমরাকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিলেন মমিনুল হক। সাগরপাড়ের ছেলে, এই স্টেডিয়াম থেকেও সাগর খুব বেশি দূরে নয়। কক্সবাজারের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার মমিনুল স্ট্রোক প্লের সৌরভ ছড়িয়ে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেললেন মাত্র ৩৬ বলেই। দিন শেষে ৭১ বলে ৭৭ রানে অপরাজিত, প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির সৌরভ নাকে না লেগে পারেই না।

পরপর দুই লাইনে ‘সৌরভ’ শব্দটি পুনরুক্তি মনে হবে না, যখন জানবেন মমিনুলের ডাকনাম সৌরভ। চেহারা-ছবিতে ক্রিকেটারসুলভ কোনো ব্যাপারই নেই। তবে ক্রিকেটটা যে ভালোই খেলেন, চতুর্থ টেস্টে তৃতীয় হাফ সেঞ্চুরিতে তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। মমিনুলের ১৩ চারের ছটার পাশেই অভিষিক্ত মার্শাল আইয়ুবের ১১০ মিনিটের নির্লিপ্ত কিন্তু দৃষ্টির জন্য প্রশান্তিকর উপস্থিতি।

তাতে টেস্ট বাঁচানোর আশার আলোও জ্বলল।

সেটি উজ্জ্বলতর হবে নাকি নিভে যাবে—এই প্রশ্নের উত্তর বুকে নিয়েই শুরু হবে আজ তৃতীয় দিন। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে দূরত্ব এখনো ৩৬৬ রান। চুপিচুপি ‘১৬৭’ সংখ্যাটাও জানিয়ে রাখি। ফলোঅন এড়ানোর বাতিঘরের সঙ্গে দূরত্বের কথা বলছি।

 

দ্বিতীয় দিনের শেষে

নিউজিল্যান্ড: ১ম ইনিংস: ৪৬৯

বাংলাদেশ: ১ম ইনিংস: ১০৩/২

 



সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।