আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষের পাতা - ৮

আমি বড়ই ভীতু মানুষ । পরেরদিন বিকেল চারটার সময় ঢ্যাঙা এসে দেখে আমি চ্যাপা শুটকির ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছি। দুপুরের ভাতটা খেতে কেন যেন সেদিন একটু বেশি দেরী হয়ে গেছিল। ঢ্যাঙাকে দেখে রকুর মা আরেকটা থালা দিয়ে গেল। লম্বায় তালগাছের সমান আর চওড়ায় পাঠকাঠি হলে কি হবে ওর সরু পেটে গরু আটে।

পেট ভরে ভাত খেয়ে মহানন্দে আঙুলগুলো চপাত চপাত করে চেটে একটা বিশাল ঢেকুর তুলে বলল, “চল, তোর ঘরে যাই, কথা আছে” আমি খাওয়া শেষ করে অনেকক্ষণ ধরে এঁটো হাতে ওর জন্যই টেবিলে বসে আছি। সেদিনের খবরের কাগজটা বাঁ হাতে মাঝে মাঝে একটু উলটে পালটে দেখছিলাম। বললাম, “চল” শুটকি ভর্তাটার আমেজে মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল বলে বিছানার হেডবোর্ডটায় বালিশে হেলান দিয়ে বসে হালকা একটা সুর গুনগুন করতে লাগলাম। ঢ্যাঙাও বিছানায় বসলো। কিন্তু কেন যেন, আমার গান শুনেই নাকি, ভুরু দুটো কুঁচকে চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও পরে ওর মুখের অভিব্যাক্তি আর ভাত গলধকরনের পরিমাণটার কথা চিন্তা করে আঁচ করলাম যে বাসায় বোধহয় কিছু হয়েছে, রাগ করে ভাত খায়নি। চিন্তিত হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, “কিরে তুই আজকে দুপুরে ভাত খাসনি? বাসায় কিছু হয়েছে?” কিন্তু আমার কথায় ও’ হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। চোখমুখ খিচিয়ে বলল, “ভাতের খোটা দিবিনা বলে দিলাম! তুই ইদানিং সবাইকে খোটা মেরে বেরাচ্ছিস!!” ওর কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। “কাকে আবার খোটা মারলাম?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। “আমি শিওর না কিন্তু তুই মনে হয় আটিসকে টাকার খোটা দিয়েছিস, তাই না? কিছু একটা বলেছিস।

ও আজকে মেডিকালে না গিয়ে সাতসকালে আমার ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে জিজ্ঞাসা করল যে আব্বার ক্লিনিকে কোনো চাকরি খালি আছে নাকি। আমি ত প্রথমে বুঝিনি ওর জন্য, বললাম যে আয়া লাগবে। সেটা শুনে ও’ বলল যে দোস্ত অবস্থা যেরকম মনে হচ্ছে ঐ চাকরীই আমাকে করতে হবে” কথাটা শুনে হাসি পেয়ে গেলেও হাসিটা চাপিয়ে রাখলাম। ঢ্যাঙার সামনে কোনমতেই হাসা যাবেনা, একেবারে তুলকালাম কাণ্ড করে বসবে। বললাম, “হয়তো টিউশনিতে কুলাচ্ছে না সেজন্য” “দেখ ন্যাকামি করবি না।

তুই ওর মাথায় কি ঢুকিয়েছিস? ওর পড়াশুনা এখন সব মাথায় উঠবে। আমার বাসা থেকে আবার কোথায় জানি ছুটল। চাকরি খুজছে কেন ঠিক করে বল” “দেখ, বিশ্বাস কর টাকা পয়সা নিয়ে আমি ওকে কিছু বলিনি আর ও চাকরি খুজছে কেন, আমি জানি না। আমি কি করে জানব? তোর তো প্রানের বন্ধু আমার তো শুধু বন্ধু” ঢ্যাঙা এবার আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকল। এমন সময় হঠাৎ বল্টুর গলা, “আসলাম” বলে ঘরে ঢুকে ঠাস করে কয়েকটা ফটোকপি করা পৃষ্ঠা আমার টেবিলের উপর রাখল, “ধর তোর নোট।

রাগের চটে দয়া করে আর নোট ছিড়িস না। কাপড় ছিড়, গ্লাস ভাঙ, প্লেট ভাঙ, নোটের উপর রাগ ঝারিস না” বললাম, “নোট তো দিলি, কিন্তু পড়াশুনা ত কিছু হচ্ছে না” বল্টু বলল, “আব্বা আম্মাকে বলেছি ব্যাপারটা। কাকুর সাথে দেখা করবে ভাবছে, যদি বুঝিয়ে বলতে পারে” “বুঝাতে পারলে তো ভালই, বেঁচে যেতাম, কিন্তু কোনো লাভ হবে বলে তো মনে হয় না। আব্বা যে শক্ত মানুষ। ” ঢ্যাঙা হঠাৎ করে বলে বসলো, “যা করবি বল্টু তাড়াতাড়ি কর।

সময় বেশি নাই, ঐদিকে আরেকজনের তো মাথাটা গেছে” ঢ্যাঙার মনে হয় কথাগুলো না বলতে পেরে পেট ফেটে যাচ্ছিলো। এক নম্বরের পেট পাতলা। “কার মাথা গেছে?” বল্টু জিজ্ঞাসা করল। ঢ্যাঙা আমার দিকে একবার তাকাল, তারপর বল্টুকে বলল, “এখানে না, চল বাইরে যাই” আমি বুঝলাম এবার সত্য মিথ্যা মিশানো আংশিক মনগড়া এক গল্প ফাঁদবে এই ঢ্যাঙা। পেটে যদি সামান্যতম একটা কথাও রাখতে পারে এই ছেলেটা।

জটিল পরিস্থিতিটা যে আর কত ঘোলা করবে কে জানে। কিন্তু আটিস? আটিস এ কি করে বেড়াচ্ছে। নিঃস্বার্থতার কথা বলে আমি নিজে স্বার্থপরের মত এ কি বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি ওর উপর। কি জানি হয়তো এই বিয়ে থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য প্রকৃত ভালবাসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের স্বার্থকেই শুধু বড় করে দেখেছি। আটিসকে এক টুকরো খড়কুটোর মতো আঁকরে ধরে ডুবন্ত এই অসহায়ত্ব থেকে বাঁচতে চেয়েছি।

কিন্তু কিসের বিনিময়ে? ছোটবেলায় ওর বাবা মা মারা যাওয়ার পর কাকার বাসায় থেকে কি যে কষ্ট করে বড় হয়েছে, অথচ সব সময় ওর মুখে হাসি লেগে থাকে। কাউকে কখনো ওর কষ্টটা বুঝতে দেয়না। বাস্তবের সাথে লড়াইটা ওর শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। আর এখন আমিই হব সে মানুষটি যে কিনা ওর সমস্ত কষ্টের ফল, সমস্ত আশা এক নিমিষে ধুলোয় মিশিয়ে দিবে? সে তো হতে পারে না। ভীষণ দোটানায় পড়লাম আমি।

যতই ওর কথা ভাবি, ততই যে ও’ আমার মনের আরো গভীরে আমার এক নিজস্ব জগতে প্রবেশ করে সমস্তটুকু দখল করে নেয়। এ যে চরম সীমালঙ্ঘন। এ জগৎটা যে একান্তই আমার। এমন ভাবনার মাঝে নতুন সন্ধান পাওয়া এক অসাধারণ ভাল লাগায় চোখদুটো বুজে ফেলি। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে যে শুধুই ও’।

ওকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছা করে না, একদিনও না দেখে থাকার কথা চিন্তা করলে বুকটা মুচড়ে উঠে কান্না চলে আসে। আমি কিছু চাই না, শুধু প্রতিদিন একটিবার করে ওর চোখে চোখ রাখব, আর কিছু না। এটা কি আমার খুব বড় বেশী চাওয়া। বিছানার চাদরটা জোরে আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেললাম। এত কষ্ট লাগছে কেন? বুঝলাম আমার সরে আসা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে আটিস এলো। চুলগুলো উসকো খুসকো, মুখটা শুকনো। ঘামে শার্টটার বেশ খানিকটা অংশ ভিজে উঠেছে। কপালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমাকে দেখে হেসে জিজ্ঞাসা করল, “আজকে কোনো খবর আছে?" আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে উলটে জিজ্ঞাসা করলাম, “খেয়েছ আজকে?” “খেয়েছি” “কি?” “এই টুকিটাকি” “টুকিটাকি কি ?” “সিঙ্গারা টিঙ্গারা” “সারাদিনে শুধু সিঙ্গারা খেয়ে আছ?” আটিস মাথাটা নিচু করল, ওর মুখে সুক্ষ লজ্জা মাখানো হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

“একটা মানুষের আর কতটুকু খাবার লাগে?” “রকুর মাকে ভাত দিতে বলি? দুপুরের চ্যাপা শুটকির ভর্তাটা মনে হয় কিছুটা আছে, ওটা দিয়ে খেয়ে নেও?” “না সোহানা, আমার খিদে নেই” একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলাম, “সারাদিন আজ কি করেছ?” “একটু কাজ ছিল” “আমার কাছ থেকে কেন কথা লুকাও? আমাকে চিন্তায় ফেলতে চাও না, আঘাত দিতে চাও না, এই তো?” ও’ অসহায় এক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। বললাম, “তুমি সারাদিন চাকরি খুজে বেরিয়েছ, কলেজে যাওনি, ক্লাস করনি, সারাদিন না খাওয়া, তুমি কি ভেবেছ? আমি তো চাইনা তুমি এমন কর” ওর মুখটা আরো মলিন হয়ে গেল। বলল, “বাস্তবটা বড় কঠিন সোহানা। কোনো কিছুই কষ্ট ছাড়া পাওয়া যায় না” “সত্যিই বলছি আমি তোমাকে এভাবে দেখতে চাই না। জীবনে এতখানি পথ এগিয়ে এসে তুমি সব শেষ করে দিবে, এ আমি চাই না আটিস” আটিস এবার খুব ক্লান্ত স্বরে বলল, “এতদিন ধরে যাকে নিয়ে আমার সমস্ত স্বপ্ন, সে-ই যদি আমার না থাকলো তাহলে আমি আমার বাকিটুকু পথের জন্য আর চিন্তা করিনা সোহানা” আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম।

কি অধিকারে বলব ‘তুমি অনেক বড় হও, অনেক অনেক বড় হও, তোমাকে যে আমি অনেক বড় একজন মানুষ হিসাবে দেখতে চাই’ চুপচাপ দুজন দুইদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। একটু পরে ওর দিকে চেয়ে দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষায় কখনো কারো এত কষ্ট দেখিনি। আর পারলাম না, চোখদুটো বন্ধ করে ফেললাম। “সোহানা যাই” চোখ বন্ধ করেই রইলাম।

আমি ওর চলে যাওয়ার দৃশ্য সহ্য করতে পারব না। .................চলবে ১ম পর্ব ২য় পর্ব ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।