চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি নভেম্বর ২০১২ তে ইজরায়েল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অজুহাত তুলে প্যালেস্টাইনের ওপর যে নক্কারজনক হামলা চালাল, বিশ্বের প্রগতিশীল, শান্তিকামী জনগণের তীব্র ধীক্কার এর পাশাপাশি প্রত্যাশিতভাবেই তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সমর্থন পেয়েছে। স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বক্তব্যকে ইজরায়েল তাদের আক্রমণের স্বপক্ষে ব্যবহার করতে পেরে স্বাভাবিক ভাবেই উল্লসিত। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার দায়সারা শান্তির কথা বলে ইজরায়েলের আগ্রাসী চেহারার সমালোচনা এড়িয়ে গেছে, যা দেখিয়ে দেয় অর্থনীতির মত বিদেশ নীতির প্রশ্নেও ক্রমশ সে তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে কীভাবে ক্রমশ মার্কিন অনুগামী হয়ে উঠছে। মিশরের মধ্যস্থতায় আপাতত সীমান্ত যুদ্ধ স্থগিত থাকলেও ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইন তথা আরব দুনিয়ার মধ্যে চলমান ধারাবাহিক সংঘর্ষের কোনও স্থায়ী সমাধান এখনো দুর্ভাগ্যজনকভাবে চোখে পড়ছে না। উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে প্যালেস্টাইন আরব জাতিসত্তার দীর্ঘকালীন আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণের প্রশ্নটি।
ইতিহাসের দিকে ফিরলে আমরা দেখতে পাই ১৯৪৮ এ ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকেই তা প্যালেস্টাইন তথা আরব দুনিয়ার সাথে [মার্কিন ও ন্যাটোর মদতে] বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। অথচ বিশ শতকের প্রথম দিকেও প্যালেস্টিনিয় ও ইহুদী জাতিসত্তার আন্দোলনের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ১৯২০ র ফ্রান্স সিরিয়া যুদ্ধে সিরিয়ার পরাজয়ের পর এই শান্তি ক্রমশ বিঘ্নিত হতে শুরু করে। প্যালেস্টিনিয় জাতিসত্তার আন্দোলনের এই পর্বের অন্যতম রূপকার হজ আমিন আল হুসেইনি প্যালেস্টিনিয় আরবদের নিজস্ব দেশের দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন। এই সময়েই ইউরোপে ফ্যাসিস্তদের ইহুদী বিতাড়ণ ও নিপীড়ণের অধ্যায় শুরু হলে তারা প্যালেস্টাইনে চলে আসতে থাকেন।
প্যালেস্টাইনে বাড়তে থাকা ইজরায়েলি জনসংখ্যার চাপের প্রেক্ষিতে আরব প্যালেস্টিনিয়দের নিজেদের দেশের দাবি সঙ্কটজনক হয়ে উঠছে বিবেচনা করে আমিন হুসেইনি ইহুদী জাতিসত্তার আন্দোলনকে আরব প্যালেস্টিনিয় জাতিসত্তার আন্দোলনের প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন। বিভিন্ন আরব দেশে আরব প্যালেস্টিনিয় জাতিসত্তার আন্দোলন এর সমর্থন তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই প্যালেস্টানিয় ইহুদী ও প্যালেস্টিনিয় আরবদের মধ্যে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে জার্মানী সহ নাৎসী ও ফ্যাসিস্তদের দ্বারা বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাপক ইহুদী বিতাড়ণ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পরই ইউরোপ এর নানাদেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদীদের পুনর্বাসনের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে।
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জেনারেল অ্যাসেম্বলী প্যালেস্টাইনকে তিনভাগ করার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন, যার একটি হবে আরব রাষ্ট্র, একটি ইহুদী রাষ্ট্র ও আলাদা অঞ্চল হিসেবে থাকবে জেরুজালেম, যে ঐতিহাসিক শহর ইহুদী, খ্রীষ্টান ও মুসলিম – এই তিন ধর্মেরই অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান। এই ঘোষণার পরদিন থেকেই আরব ও ইহুদীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৮ এর বসন্তের মধ্যে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যায় ইহুদীরা সামরিকভাবে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠে অনেক ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে, জমি হারিয়ে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে হাজার হাজার প্যালেস্টিনিয় আরবকে। অন্যদিকে এর বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা জুড়ে প্যালেস্টিনিয় আরবদের প্রতি ব্যাপক সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে সেইসব অঞ্চলের ইহুদীদের উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসতে হয় প্যালেস্টাইনের দিকে। ১৪ মে ১৯৪৮ ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হবার পরেই আরবদের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে নবগঠিত ইজরায়েলের যুদ্ধ শুরু হয়।
১৫০০০ মানুষ হতাহত হবার পর ১৯৪৯ এ যুদ্ধবিরতি হয়। ইজরায়েল তার ভূখণ্ডের বেশিরভাগ জায়গাই নিজেদের দখলে রাখে, ওয়েস্টব্যাঙ্ক যায় জর্ডনের অধিকারে, গাজা স্ট্রিপের দখল থাকে মিশরের হাতে। পরে এই দুই ভূখণ্ড মিলিয়ে ‘সমগ্র প্যালেস্টাইন সরকার’ কে স্বীকৃতি দেয় আরব লীগ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই গাজা স্ট্রিপ ও ওয়েস্টব্যাঙ্কই বর্তমানে আরব প্যালেস্টানিয় জাতিসত্তার আন্দোলনকারীদের দখলে আছে, আর জাতিসংঘ তথা পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশ না মানলেও ইজরায়েল এ দুটিকে তাদের দেশের অন্তর্গত বলে দাবি করে চলেছে। ১৯৫৬ তে ‘সুয়েজ সঙ্কট’ এর সময় কিছুদিনের জন্য ইজরায়েল গাজা স্ট্রিপ দখল করলেও তাদের সেখান থেকে অচিরেই বিতাড়িত হতে হয়।
এর পরেই আরব জাতিসত্তার আন্দোলন একটা বড় ধাক্কার মুখে পড়ে, মিশর, আরব দেশগুলির প্রধান নেতা হিসেবে ‘সমগ্র প্যালেস্টাইন সরকার’ কে ভেঙে দিয়ে তাকে ‘সংযুক্ত আরব রিপাবলিক’ এর অংশ করে নেয় ১৯৫৯ সালে। এর প্রতিক্রিয়াতেই ১৯৬৪ তে আরব প্যালেস্টিনিয় জাতিসত্তার আন্দোলনের নতুন অধ্যায় শুরু হয় ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ বা পি এল ও গঠনের মধ্য দিয়ে। আরব লিগের বিভিন্ন দেশ পি এল ও কে সমর্থনও করে। ১৯৬৭ র ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ পি এল ও তথা আরব প্যালেস্টিনিয় জাতিসত্তার আন্দোলনের ওপর এক বড় আঘাত হিসেবে আসে, যার মধ্যে দিয়ে ইজরায়েল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা স্ট্রিপ দখল করে নেয়। পি এল ও তার সদর দপ্তরকে বাধ্য হয়ে সরিয়ে নেয় জর্ডনে।
১৯৭০ এ জর্ডন প্যালেস্টাইন বিতর্ক ও গৃহযুদ্ধের পর পি এল ও র সদর দপ্তর আবার সরে আসে দক্ষিণ লেবাননে। আশির দশকে লেবাননে গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষিতে আরাফতের সিদ্ধান্তে পি এল ও র সদর দপ্তর আবার সরে আসে তিউনিশিয়াতে। এই সময় আন্তর্জাতিক দুনিয়া ইজরায়েল প্যালেস্টাইন সংঘর্ষ বিরতিতে হস্তক্ষেপ করে, যার ফলে ১৯৯৩ তে খানিকটা শান্তিপ্রক্রিয়া ‘ওসলো চুক্তি’ র মাধ্যমে সংগঠিত হয়। পি এল ও তিউনিশিয়া থেকে ফিরে আসে গাজা স্ট্রিপ ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এ এবং সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশানাল অথরিটি’। প্যালেস্টিনিয়দের কোনও কোনও অংশ এই শান্তিচুক্তি মানতে পারেনি, তারা প্যালেস্টিনিয় সরকার এর নীতির সমালোচনা শুরু করে, চালাতে থাকে ইজরায়েলের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ।
এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে হামাস। গাজা স্ট্রিপে তারাই প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে। ২০০০ সাল থেকে ইজরায়েল প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব ক্ষণিক বিরিতির পর আবার নতুন করে জাগ্রত হয়। প্যালেস্টাইনের অভ্যন্তরেও পি এল ও-র প্রধান অংশ ফতেয়া ও হামাস এর অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ শুরু হয়, তা ২০০৭ সাথে গাজা যুদ্ধের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে। ছোটখাট বিতর্ক সংঘর্ষ সত্ত্বেও ২০০৯ এ তাদের মধ্যে একটি শান্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
২০১১ তে প্যালেস্টাইন অথরিটি জাতিসংঘে [ইউনাইটেড নেশনস] সদস্যপদের আবেদন ইজরায়েল ও তার মিত্র দেশগুলির প্রবল বিরোধিতায় বাতিল হয়। এই ঘটনা নতুন সংঘর্ষের জন্ম দেয়। হামাস নেতৃত্বাধীন গাজা স্ট্রীপ থেকে ইজরায়েল এর বিরুদ্ধে রকেট হানা চলতে থাকে। ২০১২ তে ইজরায়েলের আগ্রাসী আক্রমণে শুরু হওয়া যুদ্ধকে সে এরই প্রতিক্রিয়া বলে ব্যক্ত করতে চেয়েছে।
এটা স্পষ্ট আরব প্যালেস্টিনিয় জাতিসত্তার পূর্ণ মর্যাদা ছাড়া এই চলমান যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের কোনও স্থায়ী সমাধান থাকতে পারে না।
ইজরায়েল মার্কিন ন্যাটো অক্ষ কিছুতেই স্বাধীন ভূখণ্ড ও জাতিসংঘে সদস্যপদ সহ আরব প্যালেস্টিনিয়দের দীর্ঘকালীন ন্যায্য দাবিকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এই প্রত্যাখ্যানই নানা জঙ্গী আক্রমণের দিকে প্যালেস্টিনিয় জাতিসত্তার আন্দোলনকে ঠেলে দেয় ও তাকে অজুহাত করে ইজরায়েল ন্যাটো মার্কিন অক্ষের সমর্থনে পালটা হামলা চালায়। বস্তুতপক্ষে ইজরায়েলের মধ্য দিয়ে আরব দুনিয়ায় মার্কিন অক্ষ নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কৌশল হিসেবেই ইজরায়েল প্যালেস্টাইন সংঘর্ষকে জিইয়ে রেখেছে।
এই কালো দিকের পাশাপাশি কিছু আশার আলোও শেষপর্যন্ত আমাদের সামনে এসেছে। আমরা দেখলাম রাষ্ট্রসংঘে অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পেল প্যালেস্টাইন।
আমেরিকা এবং ইজরায়েল এর প্রবল বিরোধিতা স্বত্ত্বেও রাষ্ট্রসংঘে বিপুল ভোটে প্যালেস্টাইনের এই আবেদন জয়লাভ করে। প্যালেস্টাইনের পক্ষে ভোট পড়ে ১৩৮ টি, বিপক্ষে মাত্র ৯ টি। প্যালেস্টাইন এর স্বীকৃতির পাশাপাশি নির্বাচনের ফলাফলে আর একটা জিনিস স্পষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরূত্বপূর্ণ নানা প্রশ্নেই আমেরিকা তার আধিপত্য ও সমর্থন আগের তুলনায় অনেকটা হারাচ্ছে, যার বিকাশ একমেরু বিশ্বের জায়গায় বহুমেরু বিশ্বের সম্ভাবনাকে ক্রমশ স্পষ্ট করছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।