নাম 'হুঙ্কার র্যালি'। সদ্য বিরোধী বনে যাওয়া বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর স্নায়ু-টানটান টানাপোড়েন। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরির মশলা মজুদ ছিল প্রচুর। পটনা তো বটেই, গোটা দেশই অপেক্ষা করছিল নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা-বিস্ফোরণ দেখার জন্য। তিনি কী ভাবে নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধেও যুদ্ধের আওয়াজ তোলেন, তা শুনতে সকাল থেকেই পটনার গাঁধী ময়দানে নেমেছিল ঢল।
কিন্তু তার আগেই অন্য বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল শহর। বা বলা ভাল, মূলত গাঁধী ময়দান। সকাল সাড়ে ন'টা থেকে দুপুর পৌনে একটা, সোয়া তিন ঘণ্টার মধ্যে পরপর সাতটি বিস্ফোরণ। যার মধ্যে পটনা স্টেশনেরটি বাদ দিয়ে বাকি সব ক’টিই গাঁধী ময়দানে। সব মিলিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ জন।
জখম কমপক্ষে ৭০।
শেষ বিস্ফোরণের পনেরো মিনিট পরে মঞ্চে উঠলেন মোদী। গোটা ঘটনায় রাজনৈতিক ভাবে যিনি লাভবান হলেন বলেই আশঙ্কা কংগ্রেসের। কারণ, এর জেরে লোকসভা ভোটের মুখে মেরুকরণ বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া, হাতে নতুন অস্ত্রও পেয়ে গেলেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী।
মোদী এ দিন সেই অস্ত্র ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত কৌশলে। গোটা সভায় এক বারও বিস্ফোরণ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেননি। উল্টে বক্তৃতার শেষে শান্তিরক্ষার আবেদন জানিয়ে বিজেপি কর্মীদের সাবধানে বাড়ি ফেরার পরামর্শ দেন। আর এই বদলে যাওয়া মোদীই চিন্তায় রাখছে কংগ্রেসকে।
বিজেপি যখন মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করেছিল, তখন কংগ্রেস শীর্ষ নেতাদের আশা ছিল যে, এ বার ভোটের মেরুকরণ হবে।
কট্টর হিন্দু ভোট বিজেপি-র থেকে যাবে ঠিকই, কিন্তু বিজেপি ঠেকানোর লক্ষ্যে উদারপন্থী হিন্দু ভোট এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘু ভোট আসবে তাদের দিকে। মতাদর্শগত ভাবে কংগ্রেস এই দুই ভোটেরই দাবিদার। কিন্তু ৮০টি লোকসভা আসনের উত্তরপ্রদেশে এবং ৪০টি আসনের বিহারে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্কে বড় ভাগ বসান মুলায়ম সিংহ, মায়াবতী, লালু প্রসাদ নীতীশ কুমাররা। কংগ্রেসের আশা, হিন্দুত্ব নিয়ে মোদী যথেষ্ট আক্রমণাত্মক হলে এই ভোট ব্যাঙ্ক বুঝবেন যে, আঞ্চলিক দলগুলির পাশে দাঁড়িয়ে আর মোদী-ঢেউ ঠেকানো যাবে না। কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় শক্তিশালী দলই দরকার।
সেই কারণে রাহুল গাঁধীরা চেয়েছিলেন, মোদীর বিরুদ্ধে হিন্দুত্ব-ইস্যুতে আক্রমণ শানিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা উড়িয়ে মেরুকরণের ফায়দা নিতে।
কিন্তু দৌড়ে নেমে মোদী উগ্র হিন্দুত্বের পথে হাঁটেননি। তিনি উন্নয়নের প্রশ্নেই কংগ্রেসের বিরোধিতা করছেন। তুলে ধরছেন ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। ফলে কংগ্রেসের কৌশল কাজে লাগছে না।
কিন্তু তাই বলে মেরুকরণের রাজনীতিও বন্ধ নেই। সেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সঙ্ঘ পরিবার। মোদী এ দিনের বিস্ফোরণ নিয়ে সরব না হলেও, সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ না-তুললেও আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেই পথে হাঁটার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়েছে। এই দ্বিমুখী কৌশলে আখেরে বিজেপি-রই ফায়দা হবে বলে মনে করছে কংগ্রেস। এর নজিরও রয়েছে।
’৯৮-এ কোয়েম্বত্তূরে লালকৃষ্ণ আডবাণীর নির্বাচনী প্রচারে জঙ্গি হামলা হয়েছিল। লোকসভা ভোটে যার ফায়দা লুটেছিল বিজেপি।
এ বারও সেই ফায়দা নিতে সাবধানে পা ফেলেছেন মোদী। নিজেকে ধর্মীয় মেরুকরণ থেকে দূরে রেখেছেন। সরাসরি বিস্ফোরণের প্রসঙ্গ তুলে নীতীশ কুমারের সরকারের বিরুদ্ধে অকর্মণ্যতার অভিযোগ আনেননি ঠিকই।
কিন্তু গোটা সভায় এক বারও নীতীশের নাম না-করে (আগাগোড়া বলেছেন, ‘আমার বন্ধু, যিনি আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী’) ঘুরপথে তীব্র আক্রমণ করেছেন তাঁকে। পাশাপাশি, যে কারণে নীতীশের এনডিএ-ত্যাগ, তাঁর সেই ধর্মনিরপেক্ষতাকেও আজ বিঁধেছেন মোদী। তাকে লোক-দেখানো বলতেও পিছপা হননি। তাঁর কথায়, “দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে আমার বন্ধু তো একসঙ্গে বসে খাবার খেতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছিলেন। পাছে ফটো উঠে যায়!”
এনডিএ-তে থাকার সময়েও রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ককে সঙ্গে পেতে এ ভাবেই মোদীর ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলতেন নীতীশ।
সে ব্যাপারেই খোঁচা দিয়ে মোদী দেখানোর চেষ্টা করেন, সেই সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের প্রশ্নে বিহার সরকার ব্যর্থ। তাঁর কথায়, “আমার রাজ্য থেকে মুসলিমরা হজে যেতে চেয়েও যেতে পারছে না। কারণ রাজ্যের কোটা কম। কিন্তু বিহারের কোটা বেশি থাকা সত্ত্বেও এ রাজ্যের মুসলিমরা সেই সুযোগ নিতে ব্যর্থ। কারণ তারা খরচ দিতে পারছেন না।
” তাঁর আরও দাবি, বিরোধীরা তাঁকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে তুলে ধরলেও দেশের মধ্যে কচ্ছ ও ভারুচের মতো মুসলিম অধ্যুষিত জেলায় সংখ্যালঘু উন্নয়নের সূচক সব থেকে বেশি।
আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে নীতীশের হাত মেলানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আজ নীতীশের সঙ্গে কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও আক্রমণ শানিয়েছেন তিনি। বিহারকে যে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে কংগ্রেস, তাকেই নিশানা করেন মোদী। বলেন, “কংগ্রেস আসলে টোপ দেখাচ্ছে।
বাস্তবে কিছুই হবে না। ” বিহারের মানুষের প্রতি মোদী আশ্বাস দিয়ে জানান, “আমি প্রধানমন্ত্রী হলে সুদে-আসলে বিহারের মানুষের জন্য সব ফেরত দেব। ” তাঁর বক্তব্য, “আসলে নীতীশকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে কংগ্রেস। তাই তিনি বিজেপি-র সঙ্গ ছেড়েছেন। ” মোদীর কটাক্ষ, “যিনি জেপি-র (জয়প্রকাশ নারায়ণ) শিষ্য হয়েও কংগ্রেস-বিরোধিতার নীতি ভুলে গিয়েছেন, তাঁর বিজেপিকে ছেড়ে যাওয়া এমন কী অসাধ্য কাজ।
”
তিনি সাম্প্রদায়িক এই অভিযোগ খণ্ডনেও আজ তৎপর হয়েছেন মোদী। তাঁর কথায়, “কোন গরিব হিন্দু বা মুসলিম এক অন্যের বিরুদ্ধে লড়তে চায় না। তারা লড়তে চায় শুধু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। আর আমি সেই লড়াইয়ে সব সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে এগোতে চাই। ”
আসলে মোদী জানেন, পাঁচ রাজ্যে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন তাঁর অগ্নিপরীক্ষা।
যদি ছত্তীসগঢ় এবং দিল্লিতে বিজেপি হেরে যায়, তা হলে সেই বিপর্যয়কে রমন সিংহ বা হর্ষবর্ধনের হার বলে নিস্তার পাওয়া যাবে না। কংগ্রেস প্রশ্ন তুলবে, ‘মোদী-জাদু কাজ করল না কেন?’ আবার যদি রাজ্যস্তরের গোলমালকে তুচ্ছ করে বিজেপি বিধানসভায় ভাল ফল করতে পারে, তা হলে রাজ্য নেতাদের চেয়েও কৃতিত্ব বেশি পাবেন মোদী। আর সংখ্যালঘু ভোট যদি ঝুলিতে না-ও আসে, ভাল ফল করার জন্য উদারপন্থী হিন্দু ভোট যে দরকার, সেটা মোদী ভালই জানেন। নীতীশের খাসতালুকে বিস্ফোরণদীর্ণ সভায় সেই চেষ্টাই করে গেলেন মোদী।
টুইটে লড়াই
বিস্ফোরণের আগে থেকেই চলছিল।
কংগ্রেস-বিজেপি-র টুইট যুদ্ধ জারি রইল পটনায় বিস্ফোরণের পরেও। কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ বিস্ফোরণের নিন্দা করার পাশাপাশি টুইটারে কটাক্ষ করেন, “পটনায় মোদীর আত্মপ্রকাশের আদর্শ আবহ। ” এর আগে তিনি লেখেন, “বিজেপি কি ক্ষমতাপাগল মানসিক রোগগ্রস্ত মোদীকে ছাড়া আর কাউকে পেল না? সুষমার (স্বরাজ) কী হল?” মোদীর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়া নিয়ে বিজেপির দ্বন্দ্ব এ ভাবেই ফের উস্কে দিতে চান তিনি। জবাবে সুষমার টুইট, “আমারও মনে হয় রাহুল গাঁধীর বদলে দিগ্বিজয় সিংহ অনেক ভাল প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। ”
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।