বার্লিন শহরের কেন্দ্রে বার্লিন গেটসংলগ্ন বিশাল অট্টালিকায় মার্কিন দূতাবাস। সেই ভবনের ছাদেই ছিল ফোনে আড়িপাতার যন্ত্রটি। লোকের দৃষ্টি এড়াতে একটি নকল দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখান থেকেই ৮০০ মিটার দূরে অবস্থিত চ্যান্সেলর ভবনে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুঠোফোনে দীর্ঘদিন ধরে আড়ি পেতেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা।
টেলিফোন ও ইন্টারনেটে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারি দেশ-বিদেশে ঝড় তুলেছে।
কিন্তু ইউরোপে এর প্রতিক্রিয়ার ধরনটা অন্য রকম। সেখানে শীর্ষ নেতাদের ফোনে আড়িপাতা নিয়ে মার্কিন ‘জ্ঞাতি ভাইদের’ সঙ্গে সম্পর্কের ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিনিদের বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো বরাবরের সহচর। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্যের পতনের পর তা আরও বিস্তৃত হয়েছে। এর মধ্যে জার্মানির ব্যাপারটা একটু আলাদা।
বিশ্বযুদ্ধের দায়ভার ঘাড়ে থাকায় তারা সংযমী হয়ে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখে চলার নীতি অনুসরণ করে আসছে। জার্মানরা অবাক হয়ে দেখছে, তারা এ রকম শিষ্টাচার মেনে চলার পরও মার্কিনিরা গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে ভদ্রতা ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। করেনি শত্রুমিত্রের ভেদাভেদ। এ রকম আচরণ করা কাউকে আর যা-ই বলা যাক, ভালো বন্ধু বলা যায় না। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুঠোফোনে মার্কিন নজরদারির ঘটনা ফাঁসের পর জার্মান রাজনীতিক ও জনগণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটা ঠিক এ রকম।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সাবেক কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা কাগজপত্র ঘেঁটে বহুল প্রচারিত জার্মান সাময়িকী ডের স্পিগেল -এর দুই সাংবাদিক মার্শেল রোসেনবাক ও হোলগার স্টার্ক গত জুলাই মাসে এনএসএর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নম্বরসহ টেলিফোন নজরদারির একটি তালিকা পান। এই নিয়ে জুলাই মাসেই মার্কিনিদের টেলিফোনে আড়িপাতা নিয়ে ডের স্পিগেল একটি প্রচ্ছদ কাহিনি করে। পরে আরও তদন্তে দেখা যায়, সেখানে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুঠোফোনের নম্বরটিও আছে। এর সত্যতা যাচাই করতে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগের নিকোলাস বলমে ও ইয়র্গ শিন্ডলার ১৭ অক্টোবর জার্মান চ্যান্সেলরের প্রেস সচিব স্টেফান সাইবার্ডকে চ্যান্সেলরের নম্বরে আড়িপাতার কাগজপত্রগুলো দেন।
ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের পরই ২৪ অক্টোবর ক্ষুব্ধ, স্তম্ভিত আঙ্গেলা ম্যার্কেল সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ফোন করেন।
স্বল্পভাষী হিসেবে পরিচিত এ নেতা পর্যন্ত বলে ফেলেন, মিত্রদের ওপর এ ধরনের নজরদারি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এর পরের দিনই বার্লিনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন এমারসনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। একই ঘটনার কারণে আগের সপ্তাহেই প্যারিসে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। বার্লিনের পর ২৮ অক্টোবর স্পেনের মাদ্রিদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্টদূতের কপালে একই ঘটনা ঘটে। সব মিলিয়ে এখন ইউরোপ-মার্কিন বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কথা উঠছে।
মনে করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ৬৮ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জার্মানির (একটা অধ্যায় ধরে পশ্চিম জার্মানির) ‘নতজানু’ পররাষ্ট্রনীতি, একধরনের যুদ্ধের দায়ভার শোধ। জার্মানির রাজনীতিকদের মধ্য একটি প্রথা চালু আছে, সেটা হলো, উঁচু গলায় যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের সমালোচনা না করা। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর লাখ লাখ ইহুদি নিধনের কারণে অপরাধবোধ এবং নাৎসিবাদের কবলমুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা এই নীতির কারণ। এই প্রথার অর্গল ভাঙতে চেয়েছিলেন প্রখ্যাত জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস। গ্রাস ২০১১ সালে তাঁর এক আলোচিত কবিতায় ইসরায়েলকে আগ্রাসী দেশ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
বিশ্বের অনেক স্থানেই তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসিত হলেও জার্মানিতে তিনি একঘরে হয়েছিলেন।
বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্র বাহিনীর চার শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ফ্রান্সের সেনারা দীর্ঘ দিন ধরে বিভক্ত দুই জার্মানি জুড়ে অবস্থান করে। দুই জার্মানি এক হওয়ার পর সবাই জার্মানি ত্যাগ করে। কিন্তু মার্কিন সেনা দল ও তাদের সামরিক বিমানঘাঁটি এখনো জার্মানিতে বহাল তবিয়তে রয়েছে।
সাবেক পশ্চিম জার্মানিকে মার্কিনিদের নানা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতার কথা বিবেচনায় রেখে যুদ্ধসহ নানা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হয়েছে জার্মানি।
সন্ত্রাসবাদবিরোধী জোটে একসঙ্গে কাজ করেছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে ধকল পোহানো জার্মান জনগণ এখন প্রচণ্ড যুদ্ধবিরোধী হলেও দেশটির অতীতের সরকারগুলো মার্কিনিদের নানা ‘আগ্রাসী’ যুদ্ধের সঙ্গী হয়েছে।
কিন্তু সময় দ্রুত পাল্টাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর তৃতীয় প্রজন্মের জার্মান তথা ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা মার্কিনিদের ‘বিশ্ব পুলিশের’ ভূমিকা বা সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনের নামে সব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সহযোগী আর হতে চাইছেন না। আর এই মনোভাবের মধ্যে জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের মুঠোফোনে নজরদারির ঘটনা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো ঘটনা।
মার্কিনিদের ব্যাপারে জার্মানির রাজনীতিকদের উঁচু গলায় সমালোচনা না করার ঐতিহ্যও ভেঙে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ঐক্য ক্রমশ দৃঢ় হওয়ার ফলে ইউরোপীয় রাজনীতিকদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীলতা ক্রমে কমছে। নানা বন্ধু দেশেও আড়িপাতার ঘটনায় আটলান্টিকের অন্য পাশের এই শক্তিশালী মিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় দেখা দিয়েছে।
আড়িপাতার ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে জার্মানির সব রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনা করছে। আগামী ১৮ নভেম্বর জার্মানির পার্লামেন্টে এই ঘটনার জন্য আলোচনার দিন ঠিক করা হয়েছে।
স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অধিবেশনেও ইউরোপ তথা বিশ্বজুড়ে মার্কিন নজরদারির ঘটনার নিন্দা হয়েছে। ইতিমধ্যে সন্ত্রাসবাদী দমনে ১৯৯৮ সালে করা ‘সেফ হারবার প্যাক্ট’ চুক্তি বাতিল বা পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আলোচনার পর ভোটাভুটিতে পরিবর্তনের পক্ষে ২৮০ এবং বিপক্ষে ২৫৪টি ভোট পড়ে।
ইউরোপের সাধারণ মানুষ মহাদেশজুড়ে আড়িপাতার এ ঘটনাকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে। ইউরোপের অনেক শহরেই আড়িপাতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।
পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে ভবিষ্যতে ওবামা সরকার বিশ্বজুড়ে তাদের গোয়েন্দাগিরির নখর সংযত করার কথা বলতে বাধ্য হয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।