আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বচোখে দেখাঃ বাংলাদেশ ক্রিকেটদল "মিনোজ়" থেকে "জায়ান্ট" এ পরিণত হওয়া



বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলে অনেক আগে থেকেই ... বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ও উপমহাদেশের ৩ পরাশক্তির দল ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকার সাথে এশিয়াকাপ খেলে ১৯৮৪/৮৫ সিজনে। তখন থেকেই ৩/৪ বছর পর পর শুধু এশিয়া কাপেই অংশগ্রহন করে বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হবার পর নিয়মিত খেলার জন্য ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায় বাংলাদেশ। সেই স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর বাংলাদেশ কয়েকটি ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্ডেপেন্ডেন্ট কাপ [ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ], জিম্বাবুয়ে-কেনিয়া-বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ-কেনিয়া-ভারত। ১৯৯৮ সালের ঐ ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডে জয় লাভ করে।

সেইখেলা আজ়ও ভুলতে পারি নাই। চোখে পানি চলে এসেছিল। সারা রাত ঘুমাতে পারি নাই। ওপেনিং এ নেমে মোহাম্মদ রফিক ৭৭ রান করে, আতাহার আলী অর্ধশত রানের সুবাদে সেঞ্চুরী ওপেনিং পার্টনারশীপ করে। বাংলাদেশ ২৩৬ রান চেজ করে ৬ উইকেটে জয় লাভ করে।

এর পর থেকেই আমরা স্বপ্ন দেখা শুরু করি বাংলাদেশ কে নিয়ে। এর মধ্যে আর ওয়ানডে না জিতলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরী করেন মেহরাব হোসেইন অপি। মেহরাবের আগে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুতের সেঞ্চুরী করার কথা ছিল এর আগের ম্যচে; কিন্তু আম্পায়ারের ভুল সিদ্বানের কারনে ৯৫ রানে এলবিডাব্লিউ হয়ে ফিরে যায় বিদ্যুত। শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার কারণেই সেই ম্যাচে ২৫০+ রান করেও জিম্বাবুয়ের কাছে হারে ... জিম্বাবুয়ের কাছে হারে বললে ভুল হবে বলতে হবে এলিস্টার ক্যাম্পবেল এর কাছে ম্যাচ হারে! প্রথম বিশ্বকাপে বাংলাদেশ। সেই নিউজিল্যান্ডের কাছে ১১৬ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ।

বিশ্বকাপে আমাদের টার্গেট ছিল অন্তত একটি জয়। সেই অবধারিত জয়টি আসে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্বে। যদিও ম্যাচটি হাড্ডহাড্ডি লড়াইয়ের ম্যাচ হিল। আমাদের নান্নু ৬৩ রানের লাড়াকু ইনিংস খেলেন কিন্তু স্কটল্যান্ডের হ্যামিলটন ও ম্যাচ বের করে নিচ্ছিলেন। ঐ ম্যাচ আমরা জিতি।

এরপর আসে সেই বিশ্বকাপে অনেক অবিশ্বাস্য একটি জয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে আসে সেই জয়। উল্লেখ্য পাকিস্তান আমাদের সাথে খেলার আগ পর্যন্ত অপরাজিত দল ছিল এমনকি সেই বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে পাকিস্তান হারিয়েছিল ১০ রানে সেই ম্যাচের পর আমরা পাকিস্তানকে হারাই ৬২ রানের পরিস্কার ব্যবধানে! কি মিছিল করেছিলাম। গলাফাটিয়ে ... আহা। পাকিস্তানের বিরুদ্বে ম্যাচ জিতার পর জোরালো হয় আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাসের দাবী।

অবশ্য আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল কেনিয়া। পরিসংখ্যান তাই বলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ১০০ রানের নিচে অলআউট করে কেনিয়া জিতেছিল। ভারত-জিম্বাবুয়েকে হারিয়েছে একাধিকবার। আর বাংলাদেশকে তো বলে কয়েই হারাতো।

কেনিয়া বাংলাদেশের মুখোমুখি পরিসংখ্যান ছিল ৭-১ ... কিন্তু কেনিয়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছিলনা। ছিলনা ক্রিকেটের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ এবং দর্শক জনপ্রিয়তা। আর তাই সব কিছু বিবেচনায়, ততকালীন ভারতের বোর্ড প্রেসিডেন্ট জাগমোহন ডালমিয়া, বিসিবির প্রেসিডন্ট সাবের হোসেইন চৌধূরী এবং আমাদের দর্শকদের ভালোবাসায় টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে বাংলাদেশ। সেই তারিখটি আজও ভোলার নয়। ২৬ শে জুন, ২০০০ সাল।

মতিঝিল মডেল স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ি। স্কুলেই খবরটা পাই। আনন্দে এক অন্যরকম অনূভুতি হচ্ছিল। বাংলাদেশের অভিষেক ম্যাচ ১০ নভেম্বর, ২০০০ সাল। ম্যাচ দেখার জন্য স্টেডিয়ামে পর্যন্ত গিয়েছিলাম কিন্তু টিকেট না পাওয়াতে ফিরে এসেছিলাম।

এরপর অবশ্য বাংলাদেশ একের পর এক টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজ খেলেছে। ফলাফল পায়নি। বাংলাদেশের এমনই দুর্দশা চলছিল যে টানা প্রায় সাড়ে চারবছর আর ৪৭ টা ওয়ানডে জয়বিহীন ছিল। মাঝখানে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে দুর্বল কানাডাকে পেয়েও হারাতে পারে নি উলটা কোরবাণী ঈদের আগেরদিন হেরে আমাদের দুখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিল। ২০০৩ সালে আরো একটা আক্ষেপ আছে।

সেই মুলতান টেস্ট। মাত্র ১ উইকেটে হারে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে। সেই ম্যাচে যতটা না ইনজামাম এর কৃতিত্ব তার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব ছিল শ্রীলংকার আম্পায়ার "অশোকা-ডি-সিলভার"। সেই টেস্ট ম্যাচ আজও ভুলতে পারি নাই। এরপর আসল সেই ক্ষন।

জিম্বাবুয়ের সাথে ২০০৪ সালের সিরিজে আশরাফুলের দুর্দান্ত ফিফটিতে বাংলাদেশ জয়লাভ করে। সেই সিরিজে ছিল মানজার রানা। কোনও একম্যাচে ওপেনিং করেছিলেন এবং ভালো বল করেছিলেন। দুর্ভাগ্য এক ক্রিকেটার যিনি বাইক এক্সিডেন্টে মারা যান। সেই বছরেই ভারতকে এবং পরের বছর শ্রীলংকাকে হারায় বাংলাদেশ।

এরপর থেকে বাংলাদেশ স্বল্পবিরতিতেই জিততে থাকে। বাংলাদেশ ১ম টেস্ট ম্যাচ ও সিরিজ জিতে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ব। জিম্বাবুয়েকে, কেনিয়াকে হোয়াইট ওয়াশ; ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার কঠিন বোলিং লাইনআপের সামনে আশরাফুলের দুর্দান্ত সেঞ্চুরী এবং জয়। ইংল্যান্ডর সাথে লড়েছিল কিন্তু জিততে পারেনি কিন্তু সেই ম্যাচে আশরাফুলের ৫০+ বলে ৯৪ রানের সেই ইনিংস আজও মনে পরে। ২০০৭ সালে আবার ভারতকে হারিয়ে ১ম রাউন্ড থেকেই ভারতকে বিদায় করেদেয়।

বারমুডাকে হারিয়ে ২য় রাউন্ডে উঠে। ২য় রাউন্ডে সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়ে এক চমক দেখা বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গায়ে তখন "আন্ডারডগ" লেভেল থেকে "জায়ান্ট কিলার" তকমা লেগে যায়। সেই চমক তারা ধরে রাখে ১ম টি-২০ বিশ্বকাপেও। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ২য় রাউন্ডে উঠে।

এরপর ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ে-শ্রীলংকা-বাংলাদেশ এক ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশ গ্রুপ ম্যাচে জিম্বাবুয়ের কাছে হারে কিন্তু শ্রীলংকাকে রানরেটে পরাজিত করে ফাইনালে শ্রীলংকার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। শ্রীলংকাকে বাগে পেয়েও হারাতে পারেনি অল্পের জন্য। অনেক কস্ট পেয়েছিলাম সেই হার দেখে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্বে টেস্ট ও ওয়ানডে হোয়াইট ওয়াশ করে বাংলাদেশ। যদিও বি গ্রেডের টিম ছিল কিন্তু রেকর্ড বুকে তো আর লেখা থাকবে না কে বা কারা ছিল সেইদলে।

ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সব টিমকেই হারিয়েছিল শুধু ইংল্যান্ডের বিরুদ্বে জয়টা বাকীছিল সেই জয়ও চলে আসে ২০১০ সালে। ২০১০ সালটি ভোলার নয়। জিম্বাবুয়ে-কেনিয়া-আয়ারল্যান্ড বাদে এই প্রথম টেস্ট র‌্যাংকিং এর উপরের সারির কোনও দল নিউজিল্যান্ডকে বাংলাদেশ হোয়াইট ওয়াশ তথা বাংলাওয়াশ করল। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ মিশ্রিত অনুভুতি। ইংল্যান্ডকে যেমন হারিয়েছে আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও সাউথআফ্রিকার বিরুদ্বে লজ্জাজনক ভাবে পরাজিতও হয়েছে।

তবে সবচেয়ে আলোচিত এশিয়াকাপ ২০১২। এইপ্রথম বাংলাদেশ সুপার ফেভারিট ছিল। ভারত-শ্রীলংকাকে তারা বলে কয়ে হারিয়েছে। ফাইনালে সেই ২ রানের আক্ষেপ পুড়িয়েছে বাংলাদেশকে। ২-রানের জন্য হতে পারেনি এশিয়াকাপ চ্যাম্পিয়ন।

এর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্বে সিরিজ জয়, শ্রীলংকার সাথে সিরিজ ড্র এবং জিম্বাবুয়েতে হেরে আসে। কিন্তু আবারও নিউজিল্যান্ডকে পর পর দুই ওয়ানডেতে হারিয়ে বাংলাদেশ বুঝিয়ে দিয়েছে যে ২০১০ সাল ফ্লুক ছিলনা। বাংলাদেশ আর "মিনোস" নয় জায়ান্ট কিলারও নয়। এখন বাংলাদেশ জায়ান্ট দল। যেকোনও দল বাংলাদেশের নামার আগে স্ট্র্যাটেজিগত ১০০ দিক ভাববে।

ভাবতেই ভালো লাগে দল একজনের উপর নির্ভরশীল নয়। বাংলাদেশ এখন "টিম বাংলাদেশ"। দলের ১ নম্বর খেলোয়াড় হাসপাতালে তাকে ছাড়াই দল অনায়াসে জিতে। সবচেয়ে ভালো লাগছে বাংলাদেশ দলের "মিনোজ" লেভেল থেকে "জায়ান্ট" লেভেলে আসা পুরোটাই আমি বা আমাদের জেনারেশন স্ব-চোখে দেখতে পেল। স্বপ্ন পূরন হবে যদি এই জীবনে বিশ্বকাপ জয়টা দেখে যেতে পারি।

Find/Follow me on Facebook: http://www.facebook.com/neelchy

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।