কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ
আইভরিকোস্টে থাকাকালে দেশটির বিভিন্ন শহরে যেতে হত। আবিদজান শহরটা দেশের দক্ষিণে আটলান্টিকের পাড়ে হলেও এই শহরের সাথে অন্য শহরগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভাল।
প্রায় পাঁচ দিনের জন্য দালোয়াতে যেতে হবে। প্রথমে ইয়ামাসুকুরু যেতে হবে তারপর সেখান থেকে উত্তরের অন্যান্য জনপদের দিকে রাস্তা চলে গেছে। সকাল বেলাতে যাত্রা শুরু না করলে দিনের আলো পাওয়া একটু সমস্যা হয়ে যায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নিরাপত্তার কারণে দিনে চলাই উত্তম। ভোরে আমাদের গাড়ির কাছে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে গেল।
এরা অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে গাড়ির সামনের গ্লাস পরিষ্কার করে দেয়। ৫০০ সিএফএ দিলাম গাড়ী পরিষ্কারের জন্য । গাড়ি এখন রেডি, আমরাও যাবার জন্য তৈরি হয়েছি।
সকাল নয়টার সময় ইয়মাসুকুরুর পথে রওয়ানা হলাম । আড়াই’শ কিলো মিটার পথ, আজ ভালই চালিয়েছি।
১১-২০ এর মধ্যে পৌছে গেলাম ইয়ামাসুকুরু। এখানে একটু যাত্রা বিরতি। দুপুরে লাঞ্চ খেতে খেতে দেড়টা বেজে গেল। পোলাউ,স্পাঞ্জাটি,মুরগী, সব্জী সালাদ,ফল,আপেল ও আইসক্রিম এর বিশাল লাঞ্চ। ভালই লাগল।
লাঞ্চ করে দালোয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ইয়মাসুকুরু থেকে দালোয়া প্রায় একশ পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ। পৌনে ৩টায় রওয়ানা হলাম, রাস্তা বেশ ভাল, গাড়িঘোড়া কম তাই দ্রুত ড্রাইভ করে ৪-৩০ এ দালোয়া উপকণ্ঠে চলে এলাম। ৫-২০ এর দিকে আমাদের থাকার আস্তানা হোটেল অ্যাম্বাসেডর এ আসলাম।
হোটেলটা বেশ ভাল, তিনতালা, কাঠের সিঁড়ি, রিসিপসানে আফ্রিকান ট্র্যাডিশনাল ছবি দিয়ে সাজান।
বেশ শান্ত পরিবেশ। এই এলাকা সরকারী দলের নিয়ন্ত্রনে। সুযোগ সুবিধা তাই একটু বেশি এখানে। সবসময় এখানে বিদ্যুৎ থাকে যা আরও উত্তরে বিদ্রোহীদের এলাকাতে গেলে পাওয়া দুর্লভ। সুযোগ সুবিধা সবই প্রায় আছে।
এসেই গোসল করে ফ্রেস হলাম। ডিজিটাল ক্যামেরাতে হোটেলের আশেপাশের কয়েকটা ছবি তুলালাম । কাল বাইরের কিছু ছবি তুলব। বিছানাতে একটু হেলান দিতেই চোখ বুজে এলো ৪৯৮ কিঃমিঃ ড্রাইভ সোজা কথা না। বাংলাদেশে একদিনে প্রায় অসম্ভব।
এখানে নতুন টয়োটা প্রাদো জীপ বলেই সম্ভব। টেরই পাওয়া যায় না যে কষ্ট হচ্ছে। রুমটা মোটামুটি ভাল,এ সি রুম,ডাবল বেড টয়লেট মোটামুটি। । তবে বোঝাযায় মন্দা চলছে।
ইরাকের দুর্দিনে হোটেলগুলোর এই দশাই দেখেছিলাম।
আসার পথে গাড়ি চালিয়েছি বলে আশেপাশের প্রকৃতি তেমন উপভোগ করিনি তবুও বেশ ভাল লাগল। চলার পথে নির্জন বনপথ ও মাঝে মাঝে ছোট ছোট শহর পার হলাম। অল্প মানুষ। রাস্তার পাশে গ্রামের বাজারে কাঁচা কলা নিয়ে বসেছে মহিলারা বিক্রির জন্য।
ছোট্ট দোকান, সহজ সরল জীবন, বেশ সাধারণ। তবে এরা খুব ভাল থাকতে পারে। কি নেই এদেশে, কিসের অভাব এদের- অঢেল কাঠ, উর্বরা জমি , অনেক উদ্ধৃত ফসল হবে।
সাধারন মানুষগুলোর জীবন যাত্রা
পশু পালন করার জায়গা আছে। দুধ,চামড়া,মাংশ প্রসেসিং ফ্যাক্টরী সম্ভব।
প্রচুর ফল হয় সারা বছর, বেশ সুযোগ সুবিধা আছে কিন্ত কাজে লাগায় না। যাদের টাকা আছে তারা ভোগ বিলাস করে কাটিয়ে দেয়। বাকীরা সরল জীবন যাপন করে। অনেক পরিশ্রমও করে কিন্তু পরিকল্পিত না বলে উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে এরা এখন ও দূরে আছে। রাতে এই শহরে বার ও ক্লাবগুলোতে জমজমাট আসর বসে।
আমার সাথে ভারতীয় একজন আছে সে ডিনার করেই ডিসকোতে চলে গেল। আমি রুমে আসে পরদিনের প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
শহরের রাস্তা- সুন্দর মসজিদের মিনার
সকাল বেলা উঠে হোটেলের আশেপাশে হাঁটলাম। বেশ সুন্দর পরিবেশ। ফ্রেশ বাতাস, নীল আকাশ , সবুজ প্রকৃতি সবই আছে এখানে।
নাস্তা করে শহরের দিকে চললাম। সাধারন শহর। মানুষজন তেমন নেই, মোটামুটি শান্ত শহর। কোন কিছুতেই আবিদজানের ধারেকাছেও যেতে পারবে না এই শহর। গ্রাম টাইপ বলা চলে।
এখানকার মাটি লাল। রাস্তা মাঝে মাঝে খারাপ হলেও তেমন খারাপ না। দালোয়াতে ঢোকার সময় চার রাস্তার মোড়ের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। শহরে ঢোকার মুখেই কিছু দোকানপাট, রাস্তার দুধারেও আমাদের দেশের মত দোকান রয়েছে। গান বাজনা চলছে এগুলোতে, আফ্রিকাতে এই গান বাজনা প্রায় সব জায়গাতেই আছে।
লোকজন বিকাল হতে না হতে এদেশে বানানো সলিব্রা বিয়ার নিয়ে বসে - উঁচু ভলিউমে আফ্রিকান সংগীতে বুঁদ হয়ে থাকে। শহরে দোকানপাট বেশ জমজমাট। সব জিনিসপত্র এখানে পাওয়া যায়। বেশ বড় আর সুন্দর মসজিদ দেখলাম, এই শহরে অনেক মুসলমান আছে। যতই উত্তরে যাওয়া যায় ততই মুসলিম প্রধান এলাকা চোখে পড়ে।
একটু বাইরে আসলেই মাটির রাস্তা আর ঘন বন। মানুষের বাড়িঘর অতি সাধারন, মাটি দিয়ে বানানো। তারপরও এরা মনে হল সুখি। তেমন কোন অভিযোগ নেই, দেশে যুদ্ধ চলছে একদিকে আর এরা তাদের জীবন নিয়ে যুদ্ধ করছে।
শহর ঘুরে হোটেলে ফেরত এলাম ২টার দিকে।
রুমে গিয়ে কি করব তাই হোটেলের পেছনের সুইমিং পুলের দিকে গেলাম। রিসিপশন ডিউটিতে যে দুইজন ছিল এখানে তারা লাঞ্চ খাচ্ছে। কাসাভা দিয়ে বানানো কসকুস -ভাতের মত, আর মাছের রোষ্ট। ভারতীয় চোপড়া এদের সাথে ফেঞ্চে কতক্ষণ কথা বলল। সে ফ্রাঞ্চ ভাষা শিখেছে এখানে এসে, এখন মনের ভাব প্রকাশের মত কথাবার্তা ভালই জানে।
কথা চালালো দুজনের সাথে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম সোলান্জ। আবিদজানের রিভেরাতে বাসা । সেখান থেকে এই হোটেল চাইনে চাকুরী নিয়ে বন্দুকুতে ছিল তারপর চার মাস হলো দালোয়া হোটেল এমবেসেডরে এসেছে।
মা বাবা আছে চার বোন চার ভাই সে তিন নম্বর। চোপড়া কথা চালিয়ে গেল। মেয়েটা টার্মিনাল পরীক্ষা পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে একটু ইংরেজী জানে। বুড়ো মানুসটা চুপচাপ, সময় কাটাচ্ছে। সোলাঞ্জের তিন বছরের একটা মেয়ে আছে।
সে এখন সোলাঞ্জের মার কাছে, আবিদজানে থাকে। তবে মেয়েটার কিন্তু বিয়ে হয়নি। বিয়ে ছাড়া বাচ্চা এখানে কমন ঘটনা। হোটেল এর ডিউটি যারা করে তাদের গেস্টদের রুমে যাওয়া নিষেধ। এদের ডিউটি আজকের মত শেষ, চোপড়া মেয়েটাকে বিকেলে তার সাথে দেখা করবে কিনা জিজ্ঞাসা করল।
মেয়েটা রাজি হয়ে গেল এবং সময় জানতে চাইল । ৪ টা পর্যন্ত ডিউটি শেষে সে চলে যাবে।
সকালে যখন সুইমিং পুলে যাই তখন ইয়ং পেট্রিওটের সদস্যরা গোসল ও সাতার প্রাকটিস করছিল। ছবি তুলতে গেলাম। এরা মানা করল তাই রুমে চলে এলাম।
চোপড়া মেয়েটার টেলিফোন নম্বর নিয়ে নিয়েছে। এদেশিদের সাথে কথা বলতে বলতে সে ভালই ফেঞ্চ শিখেছে। আবিদজানে একটা লেবানিজ নাকি আছে তার বেশ ভাল বন্ধু,সব সময় তার সাথে যোগাযোগ রাখে।
এই শহরে বেশ কিছু ভারতীয় আছে। আজ রাতে চোপড়ার সম্মানে পার্টি দিবে ভারতীয়রা।
আমার যেতে ইচ্ছে করছিলনা আজকে। ভাষা সমস্যার কারণে কথা বোঝা যায়না। তাই রাতে নতুন অচেনা কোন জায়গাতে, অচেনা পরিবেশে না যাওয়া ভাল। রাতে হোটেল ও নিস্তব্ধ। এখানে তেমন জনসমাগম নেই সব যেন থমথমে।
অবশ্য কথা বুঝতে পারলে জানা যেত কি কারণ বা কি হচ্ছে। সরকারী বাহিনী এখান থেকে আরও উত্তরের এলাকাতে গিয়ে বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ করে আসে। তাই এখানেও মানুষজন বেশি নিরপদ না। প্রতি আক্রমনের ভয় থেকেই যায়। দালোয়াতে কয়েকটা দিন এভাবে কেটে গেল।
শেষ দিন সকাল বেলা দালোয়া থেকে আবিদজানে যেতে ইয়ামাসুকুরুর পথে রওয়ানা হলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।