গরু চোরাচালানের সময় বিএসএফ এর গুলিতে প্রাণ হারনোর খবর প্রায়ই দেখি কিন্তু ফেনসিডিল বা অন্যকোন পণ্য চোরাচালানের সময় এরকম কোন ঘটনার কথা কখনও শোনা যায় না। আবার গরু চোরাচালান প্রতিদিনই হয় কিন্তু গুলি প্রতিদিন হয় না। তাহলে যখন গুলি হয় তখন কেন হয় আর যখন হয় না তখন কেন হয় না, কেন ফেনসিডিল, সাইকেল, মসলা, কাপড় ইত্যাদি পণ্য বাদ দিয়ে শুধু গরু চোরাকারবারির সাথে যুক্ত, তাও আবার যারা কেবল বাংলাদেশের নাগরিক, সেই মানুষগুলোই সময় সময় বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে প্রাণ হারায়, নির্যাতিত হয়- এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের সন্ধানে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, ঠাকুরগাও, পঞ্চগড়ের বিরামপুর, ফুলবাড়ি, হরিপুর, মাড়েয়া, বেরুবাড়ি, তেতুলিয়া সংলগ্ন বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষ, গরু-ফেন্সিডিল চোরাকারবারী, মহাজন, লাইনম্যান, ব্ল্যাকদার, গরুর পাইকার, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা হয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে এই লেখাটি তৈরী করা হয়েছে।
চোরাচালানের সাধারণ রীতি: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে চোরাচলানের সময় কেন মাঝে মাঝে হত্যা কান্ড ঘটে তা বুঝতে হলে আগে সীমান্ত ব্যাবস্থাপনা ও চোরাচালানের স্বাভাবিক প্রকৃয়াটি বোঝা দরকার। কিছু বিরোধপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চল ছাড়া বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বেশিরভাগ অংশই কাটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে ভারত।
কাটাতারের বেড়া সীমান্ত রেখা থেকে ভারতের কয়েকশ গজ ভেতরের দিকে স্থাপন করা হয়েছে। বেড়ার ভেতরের দিকে প্রশস্ত রাস্তা তৈরী করা হয়েছে যে রাস্তা ধরে বিএসএফ পায়ে হেটে, সাইকেল, মোটরসাইকেল বা গাড়িতে করে সীমান্ত পাহারা দেয়। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর রয়েছে উজ্জ্বল আলোর লাইট পোষ্ট। সেব স্থানে সীমান্ত রেখা ভেদ করে নদী প্রবাহিত হয়েছে সেখানে ভারী তিন স্তর বিশিষ্ট কাটাতারের বেড়াটিকে কালভার্টের উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, কালাভার্টের নীচে থাকে অপেক্ষাকৃত হালকা বেষ্টনী, গরুচোরাচালানের একটা বড় অংশ এই ধরণের কালভার্টের নীচ দিয়ে হয়। এছাড়া কাটাতারের বেড়ায় গেট রয়েছে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর যা ব্যাবহার করে ভারতীয় কৃষকরা বিএসএফ এর অনুমোদন নিয়ে কাটাতারের বেড়ার বাইরে কিন্তু ভারতের সীমানার মধ্যকার আবাদি জমি চাষাবাদের কাজ করতে আসে।
নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর একজন/দুইজন করে বিএসএফ সদস্য সাইকেলে করে বা হেটে সীমান্ত পাহারা দেয়, নির্দিষ্ট সময় পর পর তাদের শিফট পরিবর্তন হয়, মাসে মাসে ডিউটির স্থানও তাদের বদলে যায়। কালভার্টের উপর সাধারণত একজন করে বিএএসএফ সদস্য সার্বক্ষণিক মোতায়েন থাকে। সাধারণ বিএসএফ সদস্যরা ঠিক মতো পাহারা দিচ্ছে কি না তা সুপাইরাভাইজ করার জন্য উর্ধ্বতন কর্মকতারা গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ায়, আবার মাঝে মাঝে স্পেশাল পেট্রোল পার্টিও পাঠানো হয়। বাংলাদেশের নিজস্ব কোন কাটাতার নাই, ফলে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিজিবি’র কাটাতার রক্ষার কোন দায় নেই, তারা সীমান্ত রেখা বরাবর হেটে বা সাইকেলে করে পাহারার কাজটি করে।
ছবি: সীমান্তের কাটাতারের বেড়া ও ভারত ও বাংলাদেশের আবাদী জমি
ছবি:সীমান্তের লাইট পোস্ট ও কাটাতারের বেড়া
সীমান্ত পাহারা দেয়ার ভারতীয় আয়োজন সম্পর্কে এই তথ্যগুলো যদি মাথায় রাখি তাহলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না যে, বিশেষ করে ভারতীয় বিএসএফ এর সহযোগীতা ছাড়া, বিএসএফ এর অজান্তে দিনের পর দিন গরু, সাইকেল, ফেনসিডিল ইত্যাদি কোন কিছুই ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকানো সম্ভব না।
বাস্তবে উভয় দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে ম্যানেজ বা লাইন করেই চোরাকারবারিরা এই কাজটি করে থাকে। এজন্য দুই দেশের ব্যাবসায়ীদের নিয়োগ করা লাইনম্যান যার যার অংশের সীমান্তরক্ষীদেরকে ম্যানেজ করে। বাংলাদেশের অংশে গোটা থানা বা ক্যাম্প ম্যানেজ করার কথা শোনা গেলেও বিএসএফ এর ক্ষেত্রে একেকটি ক্যাম্পে যেহেতু বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর বিএসএফ সদস্য থাকে এবং ঘন ঘন রেটেশান হয় সেজন্য গোটা ক্যাম্প ম্যানেজ করার বদলে, বিশেষ করে গরু চোরাচালানের সময়, ডিউটিতে থাকা একজন বা দুইজন বিএসএফ সদস্যকে ম্যানেজ করা বা “লাইন খাওয়ানো” হয়। একমাত্র বড় গরু ছাড়া বাকি সমস্ত পণ্যই কাটাতারের উপর দিয়ে পার করা যায় । বিশেষ করে ফেনসিডিল পার করার ব্যাপারে বিএসএফকে কখনই বাধা দেয়ার কথা শোনা যায় না বরং সীমান্তের ওপারের কারখানা থেকে আনা ফেন্সিডিল বোতল প্রতি মাত্র ৫টাকা লাইন চার্জের বিনিময়ে কাটাতারের উপর দিয়ে খুব সহজেই বস্তায় করে বাংলাদেশ অংশে নিক্ষেপ করা যায়।
হয়তো কাটাতারের উপর দিয়ে নিক্ষেপ করার সুবিধার জন্যই কাচের বদলে ইদানিং প্লাস্টিকের বোতলে ফেনসিডিল বাজারজাত করা হয়!
লাইন করে গরু পাচার এবং নিরাপদ ‘পেপসি ডিল’: ভারতের বিভিন্ন হাট থেকে সস্তায় কেনা গরু ভারতীয় মহাজন বা গরু ব্যাবসায়ীরা সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামের বিভিন্ন অংশে জড়ো করে বাংলাদেশের গরু ব্যাবসায়ী বা মহাজনকে খবর দেয়। সাধারণত বাংলাদেশের মহাজন লোক পাঠিয়ে রাতের অন্ধকারে সীমান্তের ঐ পার থেকে গরু নিয়ে আসে কারণ ভারতীয় লোক দিয়ে এইপারে গরু আনার খরচ বেশি পড়ে। গরু পাচার সবচেয়ে ঝুকি পূর্ণ কারণ বড় গরু অন্যান্য পণ্যের মতো কাটাতারের উপর দিয়ে পার করা যায় না, কাটাতার কেটেই বাংলাদেশে ঢোকাতে হয়। বিএসএফ এর সদস্যদের উপর যার যার ডিউটি স্থলের কাটাতারের অখন্ডতা রক্ষার দায় থাকে এবং কাটাতার কাটা অবস্থায় ধরা পড়লে শাস্তি হয়। ফলে বড় গরু পাচারের “লাইন খাওয়া” বিএসএফ এর জন্য ঝুকি পূর্ণ ।
কিন্তু গরু ছোট হলে হাতপা বেধে বস্তায় ভরে কাটতারের বেড়া বা গেটের উপর দিয়ে পার করে দেয়া যায় বলে গরু প্রতি এক হাজার রুপি’র বিনিময়ে ছোট গরু পাচারের লাইন খায় বিএসএফ। সাধারণত দুই মণ ওজন পর্যন্ত ছোট আকারের গরুকে এভাবে বস্তায় ভরে কাটাতারের উপর দিয়ে পাচার করা হয়। এভাবে সহজে পাচার যোগ্য গরুকে চোরাকারবারীদের অনেকেই “পেপসি” বলে ডাকে। চোরাকারবারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এই ‘পেপসি’ পাচার ফেনসিডিল পাচারের মতোই নিরাপদ এবং এক্ষেত্রে হত্যা বা নিপীড়নের ঘটনা কখনই ঘটেনা।
বড় গরু পাচার এবং ভয়ংকর ‘ফগ ডিল’: বড় গরু পাচার দুই ভাবে হতে পারে: বিএসএফ এর সাথে লাইন করে এবং লাইন না করে।
গরু পাচারের বেলায় ভারত ফেনসিডিলের মতো ‘উদার’ না হওয়ার কারণে এবং বড় গরু পাচারের বেলায় সাধারণত কাটাতার কাটা পড়ে বিধায় বড় গরু পাচার ঝুকি পূর্ণ। তবে অনেকসময় ক্যাম্প কমান্ডার ম্যানেজ হলে কাটতারের গেট খুলেও গরু পাচার হয়। কিন্তু এই ধরণের লাইন ম্যানেজ করা কঠিন ও খরচ বেশি হওয়ার কারণে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ বিএসএফ সদস্যকে কে লাইন করে বা লাইন না করেই ঝুকিপূর্ণ ভাবে কাটাতার কেটেই গরু পাচার করা হয়। লাইন না করে বিএসএফকে ফাকি দিয়ে গরু পাচারের কাজটিকে বলা হয় “ফগ ডিল”। তবে লাইন করলেও ঝুকি থাকে কারণ নির্দিষ্ট বিএসএফ সদস্য লাইন খেলেও, সে ছাড়া অন্য বিএসএফ সদস্যের জেনে যাওয়া, বড় অফিসারের হঠাৎ গাড়ি করে হাজির হওয়া কিংবা বিশেষ পেট্রোল পার্টির আবির্ভাব হওয়ার আশংকা থেকেই যায়।
আবার লাইন ম্যানেজ না হলে কাটাতার কেটে ভারত থেকে গরু আনতে যাওয়া “ব্ল্যাকদার” বা গরুর রাখালদের জন্য ভীষণ ঝুকি পূর্ণ। সীমান্তে যখন কড়াকড়ি চলে তখন বিএসএফ এর সদস্যদের জন্য লাইন খাওয়া কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু তাতে তো আর গরুর মাংসের চাহিদা কমে না, ভারত ও বাংলাদেশের গরু ব্যাবসায়ীর মুনাফার প্রয়োজনও ফুরায় না। ভারত থেকে ৫/১০ হাজার রুপিতে কেনা গরু একবার কোনমতে সীমান্ত পার করতে পারলে খুব সহজেই ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করা যায়। তাছাড়া মূল ঝুকি তো বাংলাদেশের গরীব ব্ল্যাকদারদেরই জীবন দিয়ে বহন করতে হয়, মহাজনদের তো কেবল আর্থিক ঝুকি, কোন মহাজনের জীবন যাওয়া তো দূরের কথা এমনকি আইনগত ঝামেলাও পোহাতে হয় না কোন দেশে।
ফলে সীমান্তের ‘সস্তা’ মানুষদেরকে জোড়া প্রতি তিন থেকে চার হাজার টাকার বিনিময়ে ভারতে পাঠানো হয় গরু আনতে। যে দেশের প্রধান শিল্প(গার্মেন্টস) এর মজুরি মাসে তিন হাজার টাকা, যে দেশে একজন শ্রমজীবির সারা বছরের কাজের নিশ্চয়তা থাকে না সে দেশের সীমান্তে এক রাতে জোড়া প্রতি তিন/চার হাজার টাকার বিনিময়ে জীবন নিয়ে এভাবে জুয়া খেলার মানুষের অভাব হয় না।
ছবি: সাধারণত এরকম স্থানে কালভার্টের নীচ দিয়ে বেশি গরু আনা হয়
সাধারণত একটি দুটি করে গরু আনা হয় না, একেকবারে দশ থেকে একশ জোড়া পর্যন্ত গরু আনা হয়। যদি চল্লিশ জোড়া গরু আনতে হয় তাহলে সাধারণত জোড়া প্রতি একজন করে চল্লিশজন ব্ল্যাকদার রাখাল পাঠানো হয়। এদের সামনে থাকে “ক্যারিং পার্টি” যাদের কাজ হলো জোড়া প্রতি পাচ/ছয় হাজার টাকার চুক্তিতে কাটাতারের বেড়া কাটা, বিএসএফকে ফাকি দিয়ে রাখালদেরকে পথ দেখিয়ে ভারতীয় মহাজনের রাখা গরুর কাছে নিয়ে যাওয়া, তারপর সময়-সুযোগ বুঝে লাইন খাওয়া বিএসএফ সদস্যের সিগনাল অনুযায়ী অথবা লাইন না খেলে বিএসএফকে ফাকি দিয়ে ব্ল্যাকদার বা রাখালদেরকে নেতৃত্ব দিয়ে এক দৌড়ে কাটাতারের কাটাস্থান বা কালভার্টের নীচ দিয়ে গরু নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকা।
আবার এমন অনেক সীমান্ত অঞ্চল আছে যেখানে কাটাতার না থাকলেও নিয়মিতই গুলি চলে। যেমন: দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার ভাইগর সীমান্ত এলাকায় ১কিমি অংশজুড়ে কোন কাটাতার নেই। কিন্তু সেই স্থানটি দিয়ে গরু আনতে গিয়ে নিয়মিতই মানুষ মরছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে:
১) লাইন না করে অর্থাৎ কোন অর্থ কড়ি না দিয়েই কাটাতার কেটে গরু পাচার করলে ব্যাক্তিগত ভাবে ঐ স্থানে ডিউটিরত বিএসএফ সদস্যের শাস্তির ঝুকি থাকে । ফলে এভাবে গরু পাচারের ঘটনা টের পেলেই বিএসএফ গুলি করে বা ধরে নিয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক প্রথা কিংবা খোদ ভারতীয় আইনে আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া গুলি না চলানোর বিধান যতই থাকুক, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে ভারতীয় কাটাতারের নিরাপত্তা বাংলাদেশের মানুষের জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান!
২) লাইন না করে গরু পাচার হতে থাকলে বিএসএফ গরু ব্যাবসার বখরা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। এই কারণে কাটাতার না থাকলেও বা কাটাতার রক্ষার কারণ না থাকলেও মাঝে মাঝে “শাস্তি” দিয়ে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্যও বিএসএফ গুলি চালায় বা ধরে নিয়ে যায়।
৩) বিশ জোড়া গরু পাচার করার লাইন করে তিরিশ জোড়া বা তারচেয়ে বেশি গরু পাচার করে বিএসএফ কে “বঞ্চিত” করার শাস্তি হিসেবেও গুলি চালানো হয়।
৪) লাইন খাওয়া বিএসএফ এর বদলে অন্য বিএসএফ সদস্য বা দল বা কোন উর্দ্বতন কর্তার হঠাৎ করে চোরাচালন স্থলে হাজির হলেও গুলিচালানোর ঘটনা ঘটে।
৫) সীমান্তে কাটাতার রক্ষা কিংবা চোরাচালানের বখরা নিয়ে দ্বন্দ্ব – যে কারণেই বিএসএফ গুলি চালাক, মানুষ মারুক- “আত্মরক্ষা”হিসেবে খুব সহজেই চালিয়ে দিতে পারে।
বিএসএফকে কোন সীমান্ত হত্যার জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে এরকম ঘটনার কথা খুব একটা শোনা যায় না। বাংলাদেশের নতজানু শাসক শ্রেণীও ভারতের কাছে এ ব্যাপারে জবাব দিহি চাওয়ার বদলে উল্টো হত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে থাকে। ফলে বিভিন্ন কারণে বিএসএফ অবাধে সীমান্ত হত্যা কান্ড নিয়মিতই চালিয়ে যেতে পারছে।
বাংলাদেশে গরু বৈধ করার সরকারি ‘করিডোর’: সীমান্ত হত্যাকান্ড ঘটলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব সময়ই চোরাচালানকারীদের দায়ী করা হয়। অথচ সরকার নিজেই “করিডোর” নামের এক অদ্ভুত প্রথার মাধ্যমে সেই ভয়ংকর ঝুকিপূর্ণ চোরাচালানকে রীতিমত উৎসাহিত করছে।
করিডোর প্রথা অনুসারে চোরাচালানকৃত গরুগুলোকে প্রথমে মালিকানাবিহীন দেখিয়ে “বাজেয়াপ্ত” ঘোষণা করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানায় দেখানো হয়। এরপর এই “রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাজেয়াপ্ত” গরু স্রেফ ৫০০ টাকার বিনিময়ে গরু ব্যাবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়!
ছবি: গরু করিডোর করার রসিদ
বাস্তবে গরু চোরাকারবারীর কাছেই থাকে, চোরকারবারীর কাছ থেকেই গরু ব্যাবসায়ী ৩০ হাজার বা ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে গরু কেনে, এর মাঝে সরকারকে ৫০০ টাকা দেয়ার বিনিময়ে গরুর মালিকানার ৪ দিন মেয়াদি একটি বৈধ রসিদ পায় যে রসিদের নাম্বারটি গরুর গায়ে রঙ দিয়ে লিখে ট্রাকে ওঠানো হয়। গরু ব্যাবসায়ী এক রসিদ দিয়ে যেন একাধিক চালানের গরু বৈধ করতে না পারে সে জন্য মালিকানার রসিদের মেয়াদ ৪ দিন বেধে দেয়া হয়।
ছবি: চোরাচালানকৃত গরুর গায়ে লাল রঙ দিয়ে করিডোরের নম্বর দেয়া হচ্ছে
ছবি: করিডোর করা গরু ট্রাকে তুলবার সুবিধার জন্য উচু পাকা স্থাপনা
এভাবে বাংলাদেশের সরকার উভয় দেশের চোরাকারবারি, মহাজন বা গরু ব্যাবসায়ীর মুনাফা নির্বিঘ্ন করার জন্য করিডোর প্রথা চালু করে গরু চোরাচালানকে উৎসাহিত করছে কিন্তু সেই চোরাচালান করতে যাওয়া সীমান্তের অভাবি মানুষগুলোর নিরাপত্তার কোন দ্বায়িত্ব নিচ্ছে না। ভারত সরকারও দিনের পর দিন সীমান্ত এলাকায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গরু নিয়ে এসে জড়ো করা ও বাংলাদেশে বিক্রি করার সুযোগ দিচ্ছে ভারতীয় গরু ব্যাবসায়ীদের কিন্তু সেই গরু নিতে ভারতে যাওয়া মানুষগুলোকে কাটাতার কাটা, অবৈধ অনুপ্রবেশ, হামলা ইত্যাদির অযুহাতে বিএসএফ কে দিয়ে গুলি করে মারছে, নিপীড়ন করছে।
ভারত ও বাংলাদেশের গরু ব্যাবসায়ী ও তাদের দোসরদের মুনাফা নিশ্চিত করা এবং বাংলাদেশের মানুষের গরুর মাংসের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে যারা জীবন দিচ্ছে তারা যেন চোর, অপরাধী, যেন মৃত্যু আর নির্যাতনই তাদের উচিত পাওনা। অথচ এই মানুষগুলো ভারত থেকে গরু চুরি করে আনে না, ভারতের গরু ব্যাবসায়ী গরু বিক্রি করে বলেই এদেশের গরু ব্যাবসায়ীর হয়ে তারা ভারতে যায় গরু আনতে। এভাবে গরু আনা যদি অপরাধ হয় তাহলে তার শাস্তি গরু আনতে যাওয়া বাংলাদেশের গরীব মানুষটির কেন হবে, তাও আবার একেবারে জীবন দিয়ে? এই কারবারের মূল আয়োজন তো সে করেনি, মূল সুবধিা ভোগীও সে নয়। এই চোরাকারবারের দায় তো ভারতের গরু বিক্রেতার, গরু বিক্রেতাকে সীমান্ত এলাকায় গরু নিয়ে আসা ও বিক্রি করার অবাধ সুযোগ দেয়া ভারত সরকারের, দায় লাইন খাওয়া ভারতীয় বিএসএফ ও বাংলাদেশের বিজিবি’র, দায় তো বাংলাদেশের গরু ব্যাবসায়ীর এবং গরু চোরাচালনকে করিডোরের মাধ্যমে উৎসাহ দেয়া বাংলাদেশ সরকারের।
সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের মতামত হলো, সীমান্ত হত্যাকান্ড বন্ধ করতে হলে বাংলাদেশের সরকারকে ভারতের উপরে চাপ প্রয়োগ করতে হবে যেন বিএসএফ সীমান্তে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নিপীড়ন চালাতে না পারে, যেন হয় ভারতের সীমান্ত অঞ্চলের ব্যাবসায়ীদের গরু বিক্রি করা বন্ধ হয় অথবা সীমান্ত হাট বা অন্যকোন উপায়ে বৈধভাবে গরু রপ্তানি করা হয়।
সীমান্ত হত্যা বন্ধে ভারতের উপর কার্যকর চাপ প্রয়োগের এই ভূমিকা পালন না করে করিডোরের মাধ্যমে চোরাচালানকৃত গরুর বৈধতা দিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো ভারতের ও বাংলাদেশের গরুর মহাজন ও তাদের ক্ষমতাবান দোসরদের মুনাফা নিশ্চিত করতে গিয়ে সীমান্তের অভাবী মানুষদেরকে নিয়মিত কোরবানি দেয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।