আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় বীরগাঁথা



বাইখোরা বেইস ক্যাম্প। শারীরিক কসরত, রাজনৈতিক ক্লাস, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং উপর্যুপরি ট্রেনিং। প্রায় ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের রন্ধন নিজেরাই করে। একেক দিন একেক গ্রুপ। আসামের তেজপুরে উচ্চতর গেরিলা ট্রেনিং শেষে ক্যাম্পে এভাবে প্রায় ২ মাস কেটে গেল।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভিতরে ঢোকার জন্য, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। এরই মধ্যে হঠাৎ করে নভেম্বর মাসের ৭/৮ তারিখের দিকে সিনিয়র লিডার মঞ্জুরুল আহ্সান খান (সিপিবি প্রধান ছিলেন) জানালেন : আমরা ঢুকছি বাংলাদেশে এবং সেটা ১১ নভেম্বর। যোদ্ধাদের আনন্দ যেন আর ধরে না। কেমন যেন একটা ঈদ ঈদ ভাব। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে উচ্চতর গেরিলা ট্রেনিং শেষে শত্রু নিধনে দেশে ফিরছে।

সবাই যার যার মতো করে মনে মনে পরিকল্পনা করছে, কিভাবে পাকসেনা খতম করবে, কিভাবে যুদ্ধ করবে, কিভাবে দেশ স্বাধীন করবে। যাই হোক, অবশেষে এসে গেল ১১ নভেম্বর। ৭৫ জনের গেরিলা বাহিনী। ঢাকা জেলার রায়পুরার দুইটি গ্রুপ, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের একটি গ্রুপ ও ঢাকা সিটি স্কোয়াড, মোট ৪টি গ্রুপ ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিবে। কারণ ঢাকার ওপর আখেরি চাপ দিতে হবে এবং ঢাকাকে মুক্ত করতে হবে।

একাত্তরের ১১ নভেম্বর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুমহান গৌরবগাথায় যুক্ত হয়েছিল একটি উজ্জ্বল রত্নকণিকা। সেদিন দেশপ্রেম ও সাহসের রক্তিম আল্পনায় আত্মদানের এক অমর অধ্যায় রচিত হয়েছিল কুমিল্লার বেতিয়ারায়। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন – এই তিনটি বামপন্থি সংগঠনের যৌথ কমান্ডে পরিচালিত ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’র একটি সশস্ত্র যোদ্ধা দলের সঙ্গে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর এক তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা অনেকটাই ‘হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট’-এর মতো মুখোমুখি সেই যুদ্ধে গেরিলা দলের বীরযোদ্ধা কমরেড আজাদ, মুনীর, বশির, দুদু মিয়া, শহীদুল্লাহ, আওলাদ, কাইউম, সফিউল্লাহ ও কাদের – এই ৯ জন শহীদ হয়েছিলেন। অমৃতের এই বীর সন্তানরা সেদিন বেতিয়ারার শ্যামল মাটিতে বুকের রক্ত ঢেলে এক অমর বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস রচনা করেছিলেন।

নভেম্বরে পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও প্রবলভাবে সংঘাতময় হয়ে ওঠে। আগরতলা শহরেও পাকিস্তানি বোমা পড়তে শুরু করে। চলাচলের জন্য সীমান্ত এলাকা ভয়ানক অনিরাপদ হয়ে ওঠে। সীমান্তের উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সবারই ছদ্মবেশ ধারণ করে ইনডাকশনের সনাতন পদ্ধতির কিছুটা ব্যত্যয় ঘটানো হয়। তবে ট্রপ মুভমেন্টের কনভেনশনাল পদ্ধতিও পুরোপুরি প্রয়োগ করা হয় না।

কয়েকজনের হাতে গুলিভর্তি খোলা অস্ত্র, কিন্তু অন্য সবার ক্ষেত্রে ছালায় প্যাক করা অস্ত্র-গোলাবারুদ সহযোগে সিঙ্গেল ফাইলে মুভ করার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যাওয়ার পথঘাট ও আশপাশের পরিস্থিতি আগে থেকে গেরিলা দল দ্বারা নিজস্বভাবে ‘রেকি’ (আগাম অনুসন্ধান) করে নেয়া হয় না। শত্রু বাহিনীর উপস্থিতি ও চলাফেরার সময়সূচি ইত্যাদি জেনে নিয়ে সেই ভিত্তিতে ইনডাকশনের প্ল্যান তৈরির বদলে পথ দেখানোর জন্য একজন ‘প্রফেসনাল গাইডে’র ওপর নির্ভর করা হয়। তাছাড়া আগে থেকে ভারতীয় বাহিনীর ভারী কামানের শেলিংয়ের সাহায্যে ‘ফায়ার কাভার’ দিয়ে ইনডাকশন রুটকে নিরাপদ করার কার্যক্রমেও অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের অভাব ঘটে। নিজামুদ্দিন আজাদ ৭৫ জনের বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার তৎকালীন বুয়েটের ভিপি এবং বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, প্রখ্যাত লেখক শওকত ওসমানের ছেলে এবং ডেপুটি কমান্ডার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা, মেধাবী ছাত্র এবং বার্মায় নিযুক্ত পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত কামরুদ্দিন আহমেদ সাহেবের ছেলে নিজাম উদ্দিন আজাদের নেতৃত্বে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু পরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রাকে করে মুক্তিযোদ্ধারা রওনা করলেন সীমান্তের দিকে।

সন্ধ্যার দিকে সীমান্তের খুব কাছাকাছি এসে জঙ্গলে সাময়িক অবস্থান, তারপর সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর ভারতের শেষ সীমান্ত ভৈরব টিলায় এসে অবস্থান নিলেন। এটা বাংলাদেশের সীমান্ত গ্রাম বেতিয়ারার খুব কাছে। ওই অন্ধকারে পাহাড়ের টিলায় বসে গাছ গাছালি ও জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে বাংলাদেশকে খোঁজার চেষ্টা করছেন। কী সুন্দর আমাদের মাতৃভূমি, প্রাণভরে দেখছেন, অন্তর জুড়িয়ে যায়, মনে হচ্ছে মা তাঁর আঁচল বিছিয়ে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। শহীদ আবদুল কাইয়ুম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

বাড়ি চাঁদপুর জেলার হাইমচরে। বিশেষ গেরিলা বাহিনীর ঝুঁকিপূর্ণ মুভমেন্ট গাইডের ভূমিকা নিতে কার্পণ্য করেন নি এই অকুতোভয় বীর। ১১ নভেম্বর গভীর রাতে যোদ্ধারা সেখান থেকে মার্চ আউট করে। ভৈরবটিলা থেকে নেমে তারা সমতলের ক্ষেত-খামারের আইলের পথ ধরে এগোতে থাকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে সিঙ্গেল ফাইলে এগিয়ে যেতে থাকে গেরিলা দল।

সবচেয়ে সামনে লোডেড স্টেনগান নিয়ে লিডার নিজামউদ্দিন আজাদ। তার পরপরই অস্ত্র রেডি পজিশন নিয়ে কয়েকজন যোদ্ধা। তাদের পেছনে লম্বা লাইনে প্যাকিং করা অস্ত্রের বোঝা কাঁধে নিয়ে অন্য সব যোদ্ধা। অল্পক্ষণের মধ্যেই সীমান্ত অতিক্রম করে গেরিলারা বাংলাদেশের ভূখন্ডে প্রবেশ করে। গ্রামের সেই পথ ধরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার বেতিয়ারা গ্রামের পাশ দিয়ে সিঅ্যান্ডবি রোড ক্রস করা হবে – এটাই ছিল পরিকল্পনা।

যে স্থান দিয়ে সিঅ্যান্ডবি রোড অতিক্রম করার কথা, তার এক-দুই কিলোমিটার উত্তরেই জগন্নাথ দীঘি এলাকায় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। তাছাড়া সিঅ্যান্ডবি রোড দিয়ে হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র মোবাইল প্যাট্রল গাড়ির রুটিন যাতায়াত থাকত। ‘প্রফেশনাল গাইডে’র কথা অনুসারে পথ তখন নির্বিঘ্ন থাকার কথা। সামনের পথ দেখা যায় না, এমন কুচকুচে অন্ধকারের মধ্যেই নিঃশব্দে এগিয়ে চলে গেরিলারা। [শহীদ আবদুল কাদের (ছবি সংগ্রহ নেই): কুমিল্লার গুণবতী স্টেশনের নিকটবর্তী সাতবাড়িয়া গ্রামের সন্তান শহীদ আবদুল কাদের।

হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের ভেতরে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করতেন এই বীর যোদ্ধা। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি জীবন দান করেন। ] শহীদ সিরাজুম মুনির ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তুখোড় রাজনৈতিক সংগঠক। উনসত্তরের গণ আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কৃষক এলাকার ছেলে।

কৃষকদের অবস্থার করুণ চিত্র তাঁর মনকে নাড়া দিত। তাই কৃষকদেরকে সংগঠিত করার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এরই মধ্যে পূর্বের পরিকল্পনা অনুসারে দলের চৌকষ ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা, ট্রাংক রোডের পূর্ব পাশে দুই ভাগে ভাগ করে বসানো হয়েছে। ডানদিকে এবং বামদিকে। তাদের মাঝ দিয়ে একটি সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে পাকা রাস্তা পার হয়ে যাবে।

এরই মাঝে শত্রু এসে পড়লে ডানদিকের বাহিনী- ডানদিকের আক্রমণ ঠেকাবে এবং বামদিকের আক্রমণ বামদিকের বাহিনী ঠেকাবে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে এগুচ্ছে। বাঁশঝাড় ও গাছ-গাছালিতে ভরা। ঘুটঘুটে অন্ধকার, চারদিকে নীরব নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। জোনাকিরা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রায় রাস্তার কাছে এসে গেছে। বড়জোড় ২০ গজ। সামনে একটি কালভার্ট। কালভার্টটি পার হলেই পাকা রাস্তা এবং পাকা রাস্তা পার হলেই গ্রামের পথ ধরে পূর্বনির্ধারিত নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া। সামনে দুইজন গাইড, তারপর আজাদ এবং পিছনে বিশাল বাহিনী।

গাইড দুইজন গ্রামের পথ দেখিয়ে নির্ধারিত নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবে। গাইড এবং আজাদ কালভার্টের উপরে যেইমাত্র পা রেখেছে সঙ্গে সঙ্গে আকাশ বাতাশ প্রকম্পিত করে সঙ্গে সঙ্গেই গোটা দলের ওপর শুরু হয়ে যায় বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ। শহীদ শহিদুল্লাহ সাউদ ছিলেন বেতিয়ারার কনিষ্ঠতম শহীদ। তখন তিনি পড়তেন নবম শ্রেণীতে। বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকার গোদনাইলে।

তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন গোদনাইল হাই স্কুল শাখার সাধারণ সম্পাদক। শহিদুল্লাহর পিতা জনাব জাবেদ আলী ছিলেন স্থানীয় কারখানার একজন শ্রমিক। সবাই হতচকিত। সামনে থাকা কমরেড আজাদ সঙ্গে সঙ্গে তার স্টেনগান থেকে পাল্টা ফায়ার শুরু করেন। তার স্টেনগান গর্জে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খোলা অস্ত্রবহনকারী অন্য গেরিলারাও তাদের হাতে থাকা রাইফেল ও এলএমজি থেকে ফায়ারিং শুরু করেন।

শত্রু সেনাদের দিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলির মুখে গেরিলারা লাইং পজিশনে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই ক্ষেতের আইলের পেছনে বা যেখানে পারে কাভার নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এরপর আরও প্রচন্ডভাবে গুলি আসতে থাকে তিন দিক থেকে। এ অবস্থায় কোন রকমে ‘রিট্রিট’ চিৎকার দিয়ে সবাইকে ক্রল করে পিছিয়ে আসতে বলা হয়। পেছনের সহযোদ্ধা সাথী কমরেডরা যেন নিরাপদে পিছু হটতে পারে সেজন্য আজাদসহ অস্ত্রবহনকারীরা শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত গুলি চালিয়ে যান। এর ফলে শত্রুর প্রচন্ড ফায়ারিংয়ের মুখেও পেছনের যোদ্ধারা ক্রলিং করে প্রাণ নিয়ে পিছু হটতে সক্ষম হন।

সামনের কয়েকজনও প্রাণে বেঁচে যান। রাস্তার পাশেই শহীদ হন কমরেড নিজামউদ্দিন আজাদ। সেই সঙ্গে শহীদ হন গেরিলা যোদ্ধা আওলাদ হোসেন, বশির মাস্টার, শহীদুল্লাহ সাউদ, মো. দুদু মিয়া, মো. শফিউল্লাহ ও আবদুল কাইউম। এই ৭ জন গেরিলা যোদ্ধা ছাড়াও শহীদ হন পার্টির নেতা ও যে এলাকায় এই গেরিলা দলের যাওয়ার কথা সেখানকার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কমরেড সিরাজুম মুনীর এবং প্রফেশনাল গাইড আবদুল কাদের। এলাকাবাসীর কাছ থেকে পরে জানা গেছে, তারা গুলির আওয়াজের মাঝেই স্লোগান শুনতে পেয়েছে- ‘জয় বাংলা, জয় সমাজতন্ত্র, দুনিয়ার মজদুর এক হও!’ বেতিয়ারা যুদ্ধের বীর শহীদদের কণ্ঠ থেকে এগুলোই ছিল শেষ আওয়াজ! শহীদ আওলাদ হোসেনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনাচরা গ্রামে।

ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এস সি’র ছাত্র। উনসত্তরের গণ আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান আওলাদ হোসেনের পিতা জনাব আলমাছ উদ্দিন খান ছিলেন সাধারণ দোকানদার। হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে কয়জন হতাহত হয়েছিলেন জানা যায়নি। অ্যামবুশের ঘটনার পর বর্ডারের এপার-ওপার প্রচন্ড শেলিং শুরু হয়ে যায়।

মর্টার ও দূরপাল্লার কামানের গোলা, হেভি মেশিনগান, গোলাগুলি ও শেলিংয়ের মধ্যে পড়ে কোন রকমে ক্রলিং করে জীবিত ও আহত যোদ্ধারা পিছু হটতে থাকেন। এভাবে ক্ষত-বিক্ষত হওয়া যোদ্ধারা একে একে ফিরে আসতে থাকেন চোত্তাখোলায়। একজন যোদ্ধাও তার অস্ত্র ফেলে আসেননি। প্রত্যেকেই বিধ্বস্ত, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অমিত তেজে দীপ্ত। শহীদ বশির মাস্টার এর বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরায়।

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। উনসত্তরের গণ আন্দোলনে তিনি একজন সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতি সচেতন বশির মাস্টার ছিলেন স্থানীয় সকল ছাত্রের শ্রদ্ধাভাজন। দুই একজন করে বিধ্বস্ত দেহে বিধ্বস্ত চেহারায় সাথীরা ফেরত আসছে। মাঝে মধ্যে হঠাৎ করে জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বের হয়ে আসছেন।

সবাই তাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরছে। যে ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশে অ্যামবুশ করা হয়েছিল, যে ক্ষেত্রে কম করে হলেও ৮০ বা ৯০ শতাংশ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ডেজার্শন বা বাহিনী থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও প্রচুর ঘটে। কিন্তু বেতিয়ারা বাহিনীর ক্ষেত্রে এমন একটি ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার ২ দিন পর বাওয়ানির শ্রমিক মকবুল প্রায় সম্পূর্ণ উলঙ্গ ও বিধ্বস্ত অবস্থায় চোত্তাখোলার মিটিং স্পটে ফিরে আসেন।

অপরিচিত ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আচমকা হামলার মুখেও কীভাবে এত সংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন এবং জলা ও পাহাড় ডিঙ্গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে বা মিটিং পয়েন্টে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, তা নিয়ে ভারতীয় বাহিনী পরে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। শহীদ দুদু মিয়া ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। তাঁর বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরায়। কৃষকদের বাঁচার সংগ্রামে তিনি ছিলেন উদ্যোগী। রাজনীতিতে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একজন কর্মী।

বেতিয়ারায় হানাদারের বুলেট বুকে নিয়েও তিনি ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে শহীদ হন। [শহীদ শফিউল্লাহ (ছবি সংগ্রহ নেই) ছিলেন নোয়াখালীর সন্তান। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক। সংগ্রামী জীবন ছিল তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই প্রতিরোধ সংগ্রামে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যান।

তিনি তাঁর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের শক্তভিত্তি গড়ে তুলেন। এই ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করার প্রত্যয়ে যখন দেশে আসছিলেন সেই মুহূর্তেই আকস্মিক আঘাতে শহীদ হন। ] যুদ্ধে কমান্ডারসহ কয়েকজন কমরেডকে হারিয়েও রণক্লান্ত গেরিলা যোদ্ধারা দ্রুতই তাদের মনোবল ফিরে পান। সপ্তাহ কয়েক পর আরও বড় সংখ্যায় গেরিলা দল একই পথে দেশে প্রবেশ করে। প্রত্যেক যোদ্ধার হাতে তখন খোলা অস্ত্র, আগে থেকে সবকিছু রেকি করা।

দিনের আলোতেই হেঁটে গেল এবারের দল। শহীদ আজাদ, মুনীর, আওলাদ, বশির, কাইউম, শহীদ, দুদু, শফিউল্লাহ ও কাদেরের লাশ পেছনে ফেলে তাদের রণক্লান্ত কমরেডরা দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যান বেতিয়ারার পাশ দিয়ে গুণবতী রেলস্টেশন অতিক্রম করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রুকে মোকাবিলার জন্য। সিঅ্যান্ডবি রাস্তায় ওঠার মুখেই সবাই চেয়ে দেখেন ক্ষেতের আলের পাশে পায়ে হাঁটা পথের ধারে তাদের কমরেডদের সমাধি। গ্রামবাসীই এখানে তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে দাফন করেছেন কয়েকদিন আগে। শহীদ কমরেডদের সমাধির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যোদ্ধাদের গেরিলা দলটি মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে শহীদ সহযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাল।

উচ্চারণ করল- ‘কমরেডস, তোমাদের কথা কোন দিন ভুলব না, মুক্তিযুদ্ধ চলছে চলবে। ’ এই উচ্চারণ ছিল সমগ্র জাতির বিবেকের উচ্চারণ। আজও প্রতি নিঃশ্বাসে ধ্বনিত হচ্ছে সে কথা- ‘তোমাদের ভুলি নাই, ভুলব না, মুক্তিযুদ্ধ চলছে চলবে। ’ বেতিয়ারার বীর শহীদ ভায়েরা তোমরা মৃত্যুঞ্জয়ী। তোমাদের স্বপ্ন সার্থক করতে আজো যুদ্ধ চলছে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বেতিয়ারার যুদ্ধ এক বিশাল ঘটনা, এক বিশাল প্রেক্ষাপট। এমনই অসংখ্য গেরিলা যুদ্ধ, সম্মুখ যুদ্ধ, মিত্র বাহিনীর সাথে সম্মিলিত যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্নসমর্পন ও ঐতিহাসিক সশস্ত্র বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ বিগত পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির জীবনে শ্রেষ্ঠ অর্জন। গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। একটা জাতির জীবনে হাজার বছরেও যে সুযোগ আসে না, সেই সুযোগ এসেছিল বাঙালির লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধার জীবনে।

গভীর শ্রদ্ধার সাথে অভিবাদন, কুর্নিশ আর স্মরণ করি তাঁদের। *রেফারেন্স: বেতিয়ারা যুদ্ধের গৌরবগাঁথা – কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বেতিয়ারায় সহযোদ্ধার লাশ – ইয়াফেস ওসমান ও দৈনিক সংবাদ *ছবি সংগ্রহ অন্তর্জাল থেকে

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.