দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইন সংশোধন নিয়ে ক্ষুব্ধ দুদক কর্মকর্তারা। দুদকের ক্ষমতা খর্ব করায় দাতা প্রতিনিধিরাও এর সমালোচনা করেছেন। আর দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, এই আইন সংশোধন রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের গোপন আঁতাতের ফল।
এদিকে, জাতীয় সংসদে দুদক সংশোধনী আইন পাস হওয়ার পর প্রথম দিনেই স্থবির হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সব ধরনের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ।
সংস্থার চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, পাস হওয়া বিলটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকই সমান। কিন্তু এখানে ‘সরকারি ও বেসরকারি’ বৈষম্য নিয়ে আসা হয়েছে।
গতকাল সোমবার দুদক কার্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নতুন আইনটি নিয়ে সমালোচনা করছেন। দুদক
সূত্র জানায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সশ্লিষ্ট যেসব অনুসন্ধান প্রতিবেদন অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল, সেগুলো সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তার হাতে ফেরত দেওয়া হয়েছে।
যেসব নথি অনুমোদনের জন্য কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোও ফেরত দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব সরকারি তথ্য চেয়ে বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বক্তব্য নেওয়ার জন্য নোটিশ পাঠানোর কথা ছিল, তাঁর কোনোটাই ছাড়া হয়নি।
গত রোববার জাতীয় সংসদে আইনটি পাস হয়। এতে বলা আছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের বিরুদ্ধে সরকারের অনুমোদন ছাড়া দুর্নীতির মামলা দায়ের করা যাবে না।
মামলার অনুমোদন প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সরকারের যে অনুমতির কথা বলা হয়েছে, সে বিষয়টিও পরিষ্কার নয়।
পাস হওয়া বিলে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই, সরকার বলতে আমরা কাকে বুঝব? সরকারের ঠিক কার কাছ থেকে এই অনুমতি নিতে হবে?’ দুদক চেয়ারম্যান মনে করছেন, এ আইনের ফলে মামলা করা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করা হলো।
দুদক আইনের ২৪ ধারায় বলা হয়েছে, কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। অথচ সংশোধিত আইনে দুদকের স্বাধীনতাকে কার্যত খর্ব করা হয়েছে। এ কথা উল্লেখ করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইনের বিভিন্ন অস্পষ্টতার সুযোগে সরকারি সেক্টরগুলোতে দুর্নীতির মাত্রা আরও বাড়তে থাকবে। ’
সংশোধিত আইনে তদন্ত শেষ করার মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
মেয়াদের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন না হলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ দুটি অংশ নিয়েও ক্ষুব্ধ দুদক কর্মকর্তারা। নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি করেন, তাঁদের ফাইল খুঁজে পেয়ে চিহ্নিত করতেই ছয়-সাত মাস লেগে যায়, সে ক্ষেত্রে জোর করে এবং তাড়াহুড়ো করে অনুসন্ধান করার চেয়ে কিছু না করাই ভালো।
সামগ্রিক বিষয়ে গতকাল দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির মতানুসারে এ বিল পাস হয়নি, বরং এতে করে সব ধরনের দুর্নীতিবিরোধী প্রক্রিয়া ঝুলে যাবে। ’ উদাহরণ হিসেবে তিনি আরও বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দুর্নীতি হয়।
দেখা যায় আর্থিক লাভবানের উদ্দেশ্যে পারস্পরিক যোগসাজশ করেই সরকারি দু-তিনজন কর্মকর্তা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এখন ওই সব কর্মকর্তাকে বাঁচাতে গিয়ে ওই দুর্নীতি সম্পর্কে দুদকের কিছুই করার থাকল না। ’
টিআইবির বিবৃতি: গতকাল এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মেয়াদের শেষ পর্যায়ে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এই সংশোধনী পাস শুধু হতাশাজনকই নয়, সরকারের জন্য আত্মঘাতীমূলক। দুদকের যাও ক্ষমতা ছিল, তাও খর্ব করায় জনগণের কাছে সরকারের এই পদক্ষেপ প্রতারণামূলক হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে পূর্বানুমতি নেওয়ার এই বিধান সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক এবং বৈষম্যমূলক।
কারণ, সংবিধানমতে একই অপরাধের জন্য কোনো বিশেষ শ্রেণীর জন্য বিশেষ মাপকাঠি প্রয়োগের সুযোগ নেই।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, বিষয়টি শেষ অধিবেশন পর্যন্ত ঝুলিয়ে, সংশ্লিষ্টদের অন্ধকারে রেখে একতরফাভাবে তড়িঘড়ি করে এ ধরনের নেতিবাচক বিধান রেখে আইনটির সংস্কার করা দুরভিসন্ধিমূলক। এতে আরও প্রমাণিত হলো, সরকার তার পূর্ণ মেয়াদকালে আইনটির সংশোধনী ঝুলন্ত রেখে দুদককে শুধু মনস্তাত্ত্বিক চাপের মধ্যেই রাখেনি, বরং একে সম্পূর্ণ অকার্যকর করার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করল। দুর্নীতিবান্ধব এই সংশোধনীর ফলে দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারসহ বড় বড় বক্তৃতা ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কোনোভাবে দেখার সুযোগ থাকল না। সংশোধিত দুদক আইনটি এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের গোপন আঁতাতের সুযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশে দুর্নীতির গতিকে আরও বেগবান করবে।
উন্নয়ন-সহযোগীদের আপত্তি: এদিকে দুদক আইনের সংশোধন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে কাজ করা উন্নয়ন-সহযোগীদের সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় পরামর্শক গ্রুপ (এলসিজি)। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনইসি সম্মেলনকক্ষে এলসিজির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার ছিলেন বিশেষ অতিথি।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘রোববার দুদক আইনের সংশোধনী বিল পাস হয়েছে। এটি নিয়ে তাঁরা (উন্নয়ন-সহযোগী) শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এটি নিয়ে এখন দেখতে হবে।
’ জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নেইল ওয়াকার বলেন, দুদক আইনের সংশোধন নিয়ে বৈঠকে আপত্তি তোলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বেশি সোচ্চার ইইউ।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে বৈঠকে প্রশ্ন উঠেছে কি না, জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো আলোচনা হয়নি। কে কী অনুমান করবে? কেউ তো কিছু জানে না। ’ অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কয়লানীতি, স্থানীয় সরকার, ভর্তুকি এবং স্বাস্থ্য খাতের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি বলে তাঁরা কথা তুলেছেন।
তবে কিছু বিষয়ে আমরা ভালো করেছি’ বলেও স্বীকার করেছেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।