বিবেক বর্জিত উপার্জনঃ কিছু অসুস্থ মানুষ পুরো দেশের মানুষকে অসুস্থ করে ফেলেছে। দুঃখের বিষয় হোল যে, এরা নিজেরাই জানে না যে তারা অসুস্থ। তারা মনে করছে, তারা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। কিন্তু তারা জানে না, যে তারাই সময়কে নষ্ট করছে। এই মানুষগুলি অর্থে পিছুনে এমন দিগাম্বর হয়ে ছুটছে যে তাদের ন্যায়, অন্যায় ভাবার ইচ্ছা নেই।
তাদের দৃষ্টিও খুবই সঙ্কীর্ণ। খুব কাছেই তাদের দৃষ্টি আবদ্ধ্য। ক্ষণিকের হিসেবে তাদের অসৎ উপার্জন শান্তির বা স্বস্তির অথবা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার শক্তি হলেও, একটু দুরের হিসেবে এই উপার্জন তাদের নিরাপত্তা তো দুরের কথা, উপরন্ত ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াবে। এটি কোন অলৌকিক কার্যকরণ না। এটি একটি সরল অঙ্কের মতনই সত্যি।
আমরা যেমন সমাজের দ্বারা প্রভাবিত, তেমন সমাজও আমাদের দ্বারা প্রভাবিত। আমরাই সমাজকে তৈরি করি। আর সেই সমাজই আমাদের প্রভাবিব করে। যে কাজটি আমি আজ একা করছি, সেই কাজ কাল আরও দশজনে করবে। এক সময় একটি রীতি হয়ে যাবে।
সমাজে আমরা সবাই একটি রীতি তৈরি করি, একটি প্রচলন তৈরি করি। আজ যদি আমি এক টাকা চুরি করি কালকে আরও দশজন ৫ টাকা, ৫০ টাকা অথবা আরও বেশী চুরি করবে। আমার এক টাকা চুরি সমাজে চুরিকে যেমন স্বাভাবিক করে ফেলেছে, তেমন
একটি সময় ছিল, যখন বাংলাদেশে এতো দুর্নীতি ছিল না। খুব বেশী দিন আগের কথা না। আমার জীবনের দেখা।
যেমন আমি নিজে আট আনায় পরাটা কিনেছি। আট আনায় এক সের কেরোসিন তেল কিনেছি। আমরা সেরই বলতাম, লিটারের বা কেজির হিসেবটা তখনও শুরু হয়নি। চার টাকায় গম, আর ৬ টাকায় চিকন বালাম চাল কিনেছি, যেটি ছিল বাজারের সব চেয়ে দামী চাল। ১৫ টাকায় বিশাল আকারের ইলিশ মাছ কিনেছি, যা আজকাল টাকা হলেও মিলবে না।
গল্পের মতো লাগতে পারে অনেকের কাছে, কিন্তু সত্যি। সেই দিনগুলি আজ কোথায়? অনেকে বলবেন জনসংখ্যাই খেয়ে ফেলেছে সেই সস্তার দিন। অনেকে বলবেন সময়ের সাথে পাল্টে যাচ্ছে দুনিয়া।
কিন্তু আমি তাদের সাথে অনেকটাই ভিন্ন মত পোষণ করি। জনসংখ্যা যদি অর্থনীতিকে দুর্বল করত, তাহলে চায়না (চিন) বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে পারতো না।
ব্রাজিল বা ভারত কে নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ভাবতো না। অনেকেই হয়তো জানে না, ব্রাজিল বা ভারতের পরেই বাংলাদেশ অতি দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির সম্ভাবনাময় দেশ, আবার কোন কোন অর্থনীতিকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এদের আগে।
সময়ের সাথে দ্রব্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতি? হ্যাঁ, সেখানে একটি সুচক আছে। আমাদের মুলস্ফিতির সূচকটি অযৌক্তিক, এবং অস্বাভাবিক। আমাদের দ্রব্য মুল্য বৃদ্ধির সর্ব বৃহৎ কারন হচ্ছে, বিবেক বর্জিত উপার্জন।
একদল মানুষ খুব অল্প সময়ে, অধিক অর্থ উপার্জনে স্বপ্নে ব্যাবসার নামে, চাকুরির নামে, জনসেবার নামে শুরু করলো চুরি, ডাকাতি আর ধোঁকাবাজি। সময়ের সাথে সাথে তাদের দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে, বেড়েছে তাদের দলের আয়তন। আমাদের সময় খাদ্য দ্রব্যের প্রায় সবকিছুই দেশে পাওয়া যেত। তেমন কিছুই আমদানি করতে হতো না। আমার মনে আছে, রাতের আধারে, গোপনে শহরের এক কাপরের দোকান ভারতীয় কাপর আমদানি করতো।
এলাকার মাস্তান আর পুলিশকে সামান্য ঘুষ/চাদা দিয়ে গোপনে চলত সেই আমদানি। বিদেশী পন্য দেশীয় উৎপাদন বিনষ্ট করবে। সেই জন্যেই হয়তো আমদানিকে অনুৎসাহিত করা হতো। ধীরে ধীরে একটি দোকান থেকে দুইটি, আর দুই থেকে বহুতে চলতে লাগলো সেই চোরাই (গোপন আমদানি) মালের ব্যাবসা। আমরা অবশ্য সেই চোরাই ব্যাবসাইদেরকেও একটু ভিন্ন চোখে দেখতাম।
কিন্তু চোরের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদেরকে শিখতে হোল যে, এদেরকে ভিন্ন চোখে না, বরং অনেক সম্মানের চোখেই দেখতে হবে। কারন অর্থই যে মাপকাঠি।
এক সময় দেশের পিয়াজেই দেশ চলত। আস্তে আস্তে ভারতীয় পিয়াজ বাজারে আসতে থাকলো। কম মুল্যে বিক্রি হতো বলে অনেকেই কিনতো।
আবার অনেকে বলতো দেশী পিয়াজে স্বাদ বেশী। তাই তারা দেশী পিয়াজই কিনতো। ভারত থেকে এই পিয়াজও আসতো চোরাই পথে। নিকট দৃষ্টিতে এইসব আমদানি ততটা খারাপ কিছু না। আসলে শুরুটাই এমনই হয়।
কচুগাছ কাটতে কাটতেই একদিন ডাকাত মানুষের গলা কাটে। অন্যায় মানুষ মনে সুচ হয়ে ঢুকে, ফাল হয়ে বের হয়। একই ভাবে সমাজেও ঢুকে একজনের দ্বারা, আর ধীরে ধীরে গ্রাস করে পুরো সমাজকে। বিদেশী পন্য আমদানিই দেশের উৎপাদন ধংস করেছে। অনেকে বলবেন জনসংখ্যার সাথে চাহিদা বৃদ্ধি হয়েছে।
আর চাহিদা মিটাতেই আমদানির দুয়ার খুলে দিতে হয়েছে। আবার আমি বলবো, ধারনাটি সঠিক না। ভারতের জনসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা তাদের উৎপাদনে দেশের চাহিদা মিটায়ে, বিদেশে (বাংলাদেশে, ভূটান, নেপাল) রপ্তানি করে। আর বাংলাদেশ তার চাহিদার সিংহভাগই ভারত থেকে আমদানি করে।
উৎপাদনে মুনাফার চেয়ে আমদানিতে অধিক মুনাফা। আমদানিতে দেশের কড় (ট্যাক্স) ফাঁকি দিয়ে বিশাল একটি অর্থ চুরি করা যায়। যা উৎপাদনে পারা যায় না। ব্যাবসায়িরা তাদের মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের আইন, প্রশাসন, রাষ্ট্রনীতিকে যেমন কিনেছে, কিনেছে আইন, প্রশাসন, রাষ্ট্রনীতি তৈরিকারীদেরকে। সময়ের সাথে এই রাস্ত্রজন্ত্রের বেচা কিনা এক ব্যাবসায় রুপান্তরিত হয়েছে।
এখন একে শুদ্ধ ভাষায় বলে কর্পোরেট ব্যাবসা।
এক সময়ে একজন বিদ্যুতের মিটারের বিল লেখক ঘুষ খাবার জন্যে একজনের ২০০ টাকার বিল ৫০ টাকা করতে, নিজে ৫০ টাকা ঘুষ খেত। এতে সরকারের ১৫০ চুরি হতো। এই ১৫০ টাকার মালিক কিন্তু আপুনি এবং আমি, আমরা সবাই। এমনকি ঐ বিল লেখকও।
যে ৫০ টাকা ঘুষ খেলো, সেও যেমন এই ১৫০ টাকা চুরি করলো, তেমন যে ঘুষ দিলো সেও চুরি করলো আমাদের টাকা। সেই ঘুষখোর সময়ের সাথে ঘুষের পরিমান বাড়ানোর সাথে সাথে, অন্য বিল লেখকদেরও চুরির পথ খুলেদিল। চোরের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেল সময়ের সাথে সাথে।
আর চুরি সেই বিদ্যুতের মাঝেই থেমে থাকলো না। বিদ্যুৎ থেকে পানি, পানি থেকে গ্যাস, এক এক করে দেশের সকল ক্ষেত্রেই ঢুকে গেছে।
কোথা থেকে শুরু সেটি ব্যাপার না। সে সুচ হয়ে ধুকেছে ফাল হয়ে সমাজকে বিষাক্ত করে তুলছে। যে ঘুষ খায়, সেও কিন্তু ঘুষ দেয়। সে খায় এক স্থান থেকে আর দেয় বহু স্থানে। যত অর্থই উপার্জন করে, চাহিদা যেন শেষ হয় না।
সমাজের পদে পদেই এখন ঘুষ দিতে হয়। অথচ এই ঘুষের প্রথার জন্যে কিন্তু সমাজের প্রতি ঘুষ গ্রহিতাই দায়ী। এবং অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দাতাও দায়ী।
একজন ঘুষখোর শ্রমের তুলনায় আর একজন অসৎ ব্যাবসায়ি পুজির তুলনায় অতি অধিক অর্থ উপার্জনের কারনে তাদের বড়লোকি দেখানোর একটি স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে থাকে। এই বড়লোকি সাধারন ভালো মানুষগুলির জীবন দুরবিসহ করেফেলে।
সমাজে তারা এক প্রতিযোগিতার প্রচলন করে। যেখানে পিছিয়ে পরা মানুষগুলি মাঝে মাঝে এতো দ্রুতই চলতে চায় যে রাস্ত্রজন্ত্র পুরটাকেই কিনে ফেলে, আর হয়ে উঠে রাতা রাতি রাঘব বোয়াল। ওয়ান ব্যাঙ্ক, যমুনা, বেক্সিমক, বসুন্ধরা, ডেস্টিনি, হলমার্ক, অরিয়ন, সামিত এমন বহু রাঘব বোয়াল আমাদেরকে খেয়ে ফেলে। কিন্তু এরা কেউ কিন্তু এই সমাজের বাহিরের না। এসব রাঘব বোয়ালদের যারা জন্ম দিয়েছেন ৫০/১৫০ টাকা চুরি করে, তারাই কিন্তু আজ আক্ষেপ করে বলে আহা দেশটি গেলো।
এটিই সরল অংক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।