বাটি চালান তখনই দিতে হয়, যখন চোর ধরার বৈজ্ঞানিক সব কৌশল অকেজো হয়ে যায়
স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর বিটি বেগুনের প্রভাবের ওপর পর্যাপ্ত গবেষণা না করেই তড়িঘড়ি করে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড (জিএম) বেগুন বাণিজ্যিকভাবে চাষের ছাড়পত্র দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কৃষকের বীজ নিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা, মানবদেহ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকির কথা বিবেচনায় না নিয়েই এ ছাড়পত্র দেয়া বাংলাদেশের কৃষিতে বহুজাতিক কোম্পানির করপোরেট আধিপত্যই প্র্রতিষ্ঠিত করবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মার্কিন কোম্পানি মনসান্তো ও ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি মাহিকোর যৌথ কারিগরি সহযোগিতায় এবং ইউএসএআইডির আর্থিক সহায়তায় ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের স্থানীয় নয়টি প্রসিদ্ধ বেগুনের জাতের জিন সিকোয়েন্স পরিবর্তন করে বিটি ব্যাকটেরিয়ার জিন প্রতিস্থাপন করার প্রকল্প হাতে নেয় বারি এবং এসব জাতের মধ্য থেকে বিটি বেগুন ১ (উত্তরা), বিটি বেগুন ২ (কাজলা), বিটি বেগুন ৩ (নয়নতারা) ও বিটি বেগুন ৪ (ঈশ্বরদী স্থানীয়) নামের এ চার বেগুন বাণিজ্যকভাবে চাষের অনুমতি দেয়া হয়েছে। বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্তো এবং তাদের ভারতীয় পার্টনার মাহিকো ২০০৫ সালে ভারতে বিটি বেগুন উদ্ভাবন করলেও ভারতের পরিবেশবিদ, প্রাণবৈচিত্র্য বিশারদ, কৃষক সমাজ এবং সচেতন নাগরিক সমাজের গণবিক্ষোভের মুখে সরকার এ বেগুনের বীজের বাজারজাতকরণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এরপর মনসান্তো-মাহিকো ফিলিপাইনে বিটি বেগুন বীজের বাণিজ্যিক ব্যবহারের প্রচেষ্টা চালালে সেখানেও গণপ্রতিরোধের মুখে পড়ে এবং ফিলিপাইনের কোর্ট বিটি বেগুনের ফিল্ড ট্রায়াল বন্ধে সরকারের প্রতি রুল জারি করলে সরকার তা বন্ধ করে দেয়।
ভারত ও ফিলিপাইনে ব্যর্থ হয়ে বহুজাতিক কোম্পানি এখন বাংলাদেশে এ বেগুন বীজের বাজারজাতকরণে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের পক্ষের বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিটি বেগুন কীটনাশক ছাড়া নিজে থেকেই পোকা দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার ব্যাপক হারে কমে যাবে এবং বেগুনের অধিক ফলন হবে। তবে বারির বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বিটি বেগুনকে বিষাক্ত বলে উল্লেখ করছেন কৃষি ও পরিবেশসংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নয় বরং বহুজাতিক বীজ কোম্পানির স্বার্থেই স্থানীয় বেগুনের জাতকে জেনেটিক্যালি বিকৃত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশী বেগুনের বিভিন্ন জাতকে জেনেটিক্যালি মডিফাই করে যে বিটি বেগুন উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার মূল উদ্দেশ্য এসব জিএম জাতের পেটেন্ট বহুজাতিক এগ্রিকালচার করপোরেশন মনসান্তো বা মাহিকোর করায়ত্তে নিয়ে আসা। ফলে এ বেগুন বীজের ওপর কোম্পানির একচেটিয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। কৃষকের বীজের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বারি দাবি করছে, বিটি বেগুন চাষ করলেও বীজের নিরাপত্তা কৃষকের হাতেই থাকবে। তাদের এ বক্তব্য সত্য নয়, কেননা জিএম বীজ উত্পাদনের প্রযুক্তি মনসান্তোর হওয়ায় এবং মনসান্তো-মাহিকোর যৌথ কারিগরি সহযোগিতায় এ বিটি বেগুন উদ্ভাবন হওয়ায় তার পেটেন্ট রাইটস কোম্পানির হাতে চলে যাবে এবং আমাদের কৃষকদের চড়া দামে পেটেন্টেড বেগুন বীজ কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হবে। বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের ফলে খাদ্যনিরাপত্তা চলে যাবে প্রাইভেট করপোরেশনের হাতে।
স্বত্ব পাওয়া কোম্পানি এসব শস্য বীজ সংরক্ষণ, উত্পাদন ও বিপণন বন্ধ করে দিতে পারবে। কৃষকের নিজের জমিতে বা খামারে বীজ সঞ্চয়, নবায়নকৃত ব্যবহার এবং বিক্রি নিয়ন্ত্রিত হবে পেটেন্ট আইনের কারণে। অধিক উত্পাদনের আশায় কৃষকরা পেটেন্টেড শস্য বীজ উচ্চ দামে কোম্পানি থেকে কিনতে বাধ্য হবে। ফলে উত্পাদন খরচ বেড়ে যাবে। বেগুনের দাম বেড়ে যাবে অনেক।
বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যবহার আমাদের বেগুনের জেনেটিক বৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে। বেগুন বীজের পেটেন্ট বহুজাতিক কোম্পানীর কাছে থাকবে বলে এবং সরকারের পক্ষ থেকে অধিক ফলনের বিজ্ঞাপন দিয়ে বিটি বেগুন চাষে কৃষককে উত্সাহিত করা হলে শুধু এ জিএম বীজের চাষাবাদে কৃষক নিয়োজিত থাকবে। কৃষকরা নির্ধারিত কিছু জিএম জাতের পণ্য ফলনের দিকে নজর দেবে। ফলে ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত জাতগুলোর জায়গা দখল করে নেবে জিএম বীজ। এতে ধীরে ধীরে দেশী বীজের সংরক্ষণ ও পুনরুত্পাদনের ধারাবাহিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে এবং হরেক রকম স্থানীয় বেগুন বীজ হারিয়ে যেতে পারে।
অর্থাত্ শেষ পর্যন্ত বীজের ওপর কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না বরং প্রতিষ্ঠিত হবে বহুজাতিক কোম্পানির মনোপলি নিয়ন্ত্রণ! ফলন বৃদ্ধির নামে শেষ পর্যন্ত খাদ্যের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি হবে।
বিটি বেগুনে স্বাস্থ্যগত কোনো ঝুঁকি নেই বলে ভারতের মাহিকো ও বাংলাদেশের বারি দাবি করলেও নিউজিল্যান্ডের এপিডিমলজিস্ট লুই গালাঘের, ফ্রান্সের সেরালিনিসহ আন্তর্জাতিক অনেক বিজ্ঞানীর দাবি, বিটি বেগুন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি উপেক্ষা করে বাংলাদেশে জিএম বিটি বেগুনের অনুমোদন দেয়ার প্রচেষ্টায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ২১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত সাল্ক ইনস্টিটউট ফর বায়োলজিক্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক ডেভিড সুবার্টসহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ১২ জন বিজ্ঞানী। তাদের মতে, বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এবং বিপুল জনসংখ্যার দেশে এরকম জিএম খাদ্য পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে অনুমোদন দেয়া হলে তা মানবস্বাস্থ্যের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। জেনেটিক্যালি মডিফাইড বেগুন নিয়মিত খেলে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা আছে এবং ভারতীয় কোম্পানি মাহিকোর ৯০ দিন ধরে ইঁদুরের ওপর পরিচালিত বিটি বেগুনের টক্সিসিটি স্টাডি থেকে জানা যায়, এ জিএম বেগুন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যকৃতের ক্ষয় সাধন করে এবং পুনরুত্পাদনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
কিন্তু জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক অনুমোদন কমিটির কাছে রিপোর্ট জমা দেয়ার ক্ষেত্রে এ কোম্পানি এসব গবেষণালব্ধ তথ্য হয় গোপন করেছে নতুবা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে বলে অভিযোগ করেছে ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকা। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর স্বাধীনভাবে গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য গঠিত বিজ্ঞান পরিষদের প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞানী সেরালিনি মাহিকোর বিটি বেগুনের ওপর স্টাডিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেছেন, এ স্টাডি যথাযথ প্রোটোকল অনুসরণপূর্বক করা হয়নি এবং তাই তা গ্রহণযোগ্য নয়। সেরালিনি আরো বলেন, ‘মাহিকোর মতে, বিটি বেগুনের কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা নেই কিন্তু একই ডাটার গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানা যায়, এ বেগুন গ্রহণে প্রদাহ, প্রজনন-সম্পর্কিত রোগবালাই এবং লিভার ক্ষয় হতে পারে’। লুই গালাঘেরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিটি বেগুন ইঁদুরের অর্গান ও সিস্টেমের ক্ষয় সাধন, জরায়ুর ৫০ শতাংশ ওজন হ্রাস, প্লীহার ওজন বৃদ্ধি, বিলিরুবিনের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ইওসিনোফিলসহ শ্বেতকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী অর্থাত্ এ বেগুন প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি, লিভার ও প্লীহাসহ অর্গান ক্ষয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় (ইন্ডিয়া টুডে, ১৬ জুলাই, ২০১৩)! ড. লুই গালাঘেরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইঁদুরের ওপর ৯০ দিনের গবেষণায় বিটি বেগুনের ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় নিলে এ জিএম সবজি মানুষের ভোগের জন্য অনুমোদন দেয়া যাবে না। এসব গবেষণা যেখানে বিটি বেগুনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে, সেখানে ব্যাপক গবেষণা প্রতিবেদন ছাড়াই এ বেগুন কৃষকপর্যায়ে অনুমোদন দেয়া অন্যায়।
বাংলাদেশের বায়োসেফটি গাইডলাইন অনুযায়ী, জেনেটিক্যালি মোডিফাইড অর্গানিজম বা জিএমওর ব্যবহার যেন জীববৈচিত্র্য ও জেনেটিক সম্পদ সুরক্ষার প্রতি হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বিটি বেগুনের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, এ বেগুন প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। গ্রিনপিসের মতো আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন তার নিজস্ব গবেষণায় দাবি করেছে, এ জিএম বেগুনের চাষাবাদ পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে। গ্রিনপিসের মতে, বিটি জিন যে আশপাশের বেগুনের জাতের কাছাকাছি অন্যান্য জাত ও প্রজাতির বুনো গাছপালা, শাকসবজি, ঝোপঝাড়, লতাপাতায় ট্রান্সফার হয়ে বায়োলজিক্যাল জেনেটিক দূষণ ঘটতে পারে, সে ব্যাপারটি রিস্ক এসেসমেন্টের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। বেগুনের অন্যান্য প্রজাতি কিংবা অন্য উদ্ভিদে এ বিটি জিনের অনাকাঙ্ক্ষিত ট্রান্সফার ইকোলজিক্যাল সমস্যা তৈরি করবে।
ফলে বায়োসেফটি ও বায়োডাইভার্সিটির জন্য তা হুমকি। বিটি জিনের ট্রান্সফার বেগুনকে এগ্রেসিভ এবং প্রবলেমেটিক উদ্ভিদে পরিণত করবে। এ বিটি বেগুনের সঙ্গে বুনো প্রজাতি কিংবা চাষাবাদে ব্যবহার করা প্রজাতির ক্রসিংয়ের ফলে যে হাইব্রিড প্রজাতি তৈরি হবে, তা হবে আরো এগ্রেসিভ উদ্ভিদ অর্থাত্ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে এ অফস্প্রিং ইকোসিস্টেমের সামঞ্জস্য ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে (দি হিন্দু, ৩০ এপ্রিল, ২০১২)।
সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের কৃষিতে বহুজাতিক বীজ কোম্পানির করপোরেট আগ্রাসন দেশের কৃষি ও কৃষকের স্বার্থপরিপন্থী। সামগ্রিকভাবে কৃষকের বীজনিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা, মানবদেহ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকির কথা বিবেচনায় নিয়ে বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন প্রত্যাহার করা উচিত।
যোবায়ের আল মাহমুদ
লেখক: শিক্ষক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - See more at: Click This Link
-
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।