কেবল শারলটটাউন নয়, হয়তো পুরো পিইআইতেই (রাজ্য) বাংলা ভাষাভাষী পরিবারের সংখ্যা মাত্র ‘নয়’। এই নয় পরিবারের মধ্যে দুই পরিবারের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের আর আমরা বাকি সাতের পূর্বপুরুষ তো বটেই, প্রায় সবারই জন্ম, বেড়ে ওঠা, এমনকি জীবনের বেশ বড় একটা সময় কেটেছে বাংলাদেশে। তবে দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রায় সবারই জন্ম এ দেশে অথবা অন্য কোনো দেশে।
কেমন আছি আমরা, জন্মভূমি ছেড়ে? ফেলে আসা পরিজনদের জন্য মন খারাপের বিকেলগুলো জমে যেন ভারী না হয়, সাধ্যমতো সেই চেষ্টায় থাকি সবাই। ছুতোনাতায় সুযোগ পেলেই একসঙ্গে হই; কিডনি বিনের ভর্তাকে কাঁঠাল-বিচির ভর্তা ভেবে চেটে-পুটে খাই।
স্মেল্টকে ভাবি বাটা মাছ। সরষে বাটা দিয়ে স্যামন রেঁধে চোখ বুজে মায়ের হাতের সরষে-ইলিশের স্মৃতি মাখাই। কচিৎ চায়নিজ দোকানের সদয় মালিক আমাদের জন্যে কাচকি, কাজলি, রুই, ইলিশের জোগান দেন। সংখ্যায় আমরা কম, কিন্তু প্রতি সপ্তাহেই আমাদের কেউ না কেউ তাঁকে দেশি মাছের তাগাদা দেয় নিয়ম করে। বেচারি মিষ্টি হেসে ভাঙা ইংরেজিতে ভোগী-ভোগ্যের অর্থনীতির জটিল অনুপাত বোঝান।
আমরাও বাঙালি কায়দায় তাঁকে আনুপাতিক লাভের সহজ ঐকিক হিসাব শেখাই।
আমাদের কোনো সংগঠন নেই। সংগঠন ছাড়াই আমরা সংগঠিত। জাতীয় দিবসগুলো আমরা ভাগাভাগি করে পালন করি। আমাদের বাচ্চারা একাত্তর জানে, জানে ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার ইতিহাস।
খাওয়াদাওয়া, পোশাক, গান, কবিতা এককথায় বাংলা সংস্কৃতির চর্চা আমরা নিয়তই করি। তাই আনিকা কিংবা প্রজ্ঞা পারমিতা শাড়ি সামলায় এমনই স্বাচ্ছন্দ্যে, যেন শাড়িই ওদের নিত্যদিনের পোশাক। রাইয়ান ‘ওই দেখা যায় তালগাছ’ ছেড়ে মা-বাবার মতো গানে মনোযোগী এখন। অয়োময় তো ‘ঝড় এল এল ঝড়’ গাওয়ার সময় কড়া ‘র’ লাগায় এমন জোরে, মনে হয় সত্যিই ঝড় এল বলে। আর ছোট সামিয়ান কারও অনুরোধের তোয়াক্কা না করেই ভাইয়ের গানে অবলীলায় ঢুকে পড়ে স্বকীয় সুরে।
অর্জুন আর অর্ণব ইউটিউব ঘেঁটে নতুন বাংলা গান তোলে গলায়। তিন ছুঁই ছুঁই জয়িতা হাত নেড়ে পাকা বুড়ির মতো যখন বলে, ‘চিনি শেষ’, তখন আমাদের ফেলে আসা ছেলেবেলা ওর খেলাঘরে লুটোপুটি খায়। ক্লাস এইটে দেশছাড়া নোভা ‘বাংরেজি’ নয়, শুদ্ধ বাংলাতেই কথা বলে। আবার সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই পড়াশোনা, সংসার, চাকরি সামলে শুঁটকি রেঁধে খাওয়ায় আর আমরা স্বপ্ন দেখি, আমাদের ছেলেমেয়েরাও ইংরেজিতে বাংলা লিখে নয়, নোভার মতোই বাংলা বর্ণমালাতেই বাংলা পড়বে অনায়াসে কোনো একদিন।
আমাদের কিংবা আমাদের বাচ্চাদের ছোট-বড় যেকোনো কৃতিত্বে আমরা সবাই মাতি সমান উচ্ছ্বাসে।
আসলে মিছিমিছি মাসি, খালু, কাকু, জেঠু, ভাই, দিদি, ভাবি, বউদি হতে হতে নিজেদের অজান্তেই আমরা সবাই বিনি সুতার জটিল এক মায়ার জালে আটকে গেছি। তাই কৃষ্ণাদি যখন সবার নজর এড়িয়ে আমার জন্য বাড়তি নিমকি তুলে রাখে, তখন আমার ফেলে আসা দুই দিদির চেয়ে কম ভালোবাসারজন মনে হয় না তাকে। মঞ্জু ভাবিকে আমার বাড়ির কেউ নয় ভাবার সুযোগই নেই। আমার অতিথিদের অন্তত এই বাড়িতে নিমন্ত্রণ নিশ্চিত। আর মৌমিতা কিংবা দিহান আমার না-থাকা ছোট বোনটি হয়ে গেছে সেই কবেই।
আমাদের সব ছোট ছোট সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে আমরা শারলটটাউনের বাঙালিরা ভালো আছি। অন্তত মন খারাপের বিকেলগুলো গলির মোড়েই থমকে দেওয়ার চেষ্টায় আছি।
শারলটটাউন পিইআই, কানাডা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।