জীবনের জন্যই এই সব কথামালা সদ্য প্রেম প্রস্তাবে 'হ্যা' জবাব পেয়ে ও দ্বিধায় যুবক সুনীল, আকুতি মেশানো চিঠি লিখলেন স্বাতী কে। ১৯৬৬ সালে লিখা এই চিঠি এতোদিন বাদে পড়লাম এই প্রজন্মের ক্ষুদ্র পাঠক, ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল। আমার মত সুনীল পাঠকদের আগ্রহ থাকতে পারে, তাই শেয়ার করছি।
বহরমপুর / বুধবার
২২ শে জুন ১৯৬৬
স্বাতী,
মনটা কী চমৎকার হালকা হয়ে গেছে আমার, কী যে ভালো লাগছে আজ। যে-কথাটা বলার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে ঘুরেছি এ ক'দিন, অথচ মুখ ফুটে বলতে পারিনি, বলার সাহস হয়নি, সেদিন সন্ধ্যেবেলা যখন হঠাৎ বলে ফেললুম, হাঁটুর উপর মুখ রেখে তুমি যখন আস্তে বললে 'হ্যা', সেই মুহুর্তে আমার জীবনটা বদলে গেল।
আমি তোমাকে চাই, তোমাকে চাই,তোমাকে চাই ___তোমাকে হারাবার ক্ষতি কিছুতে আমি সহ্য করতে পারবো না___ এই কথাটা প্রবলভাবে দাবি করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু ভয় ছিল যদি এ আমার স্বার্থপরতা হয়, তাছাড়া, আমি তোমাকে চাই, তুমি যদি আমাকে না চাও? সত্যিই, স্বাতী, সত্যিই তুমি আমার হবে, এবং আমি তোমার হবো? আমি তো তোমার হয়েই আছি।
তুমি আমার সম্পর্কে হয়তো অনেক কিছুই জানো না, আমি নানা রকম ভাবে জীবন কাটিয়েছি, অনেক ভুল এবং হঠকারীতা করেছি, কিন্তু কখনো কোনো অন্যায় করিনি, আমি গ্লানিহীন, আমার স্বভাবে কোনও দোষ দোষ নেই- এ কথা তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। আমি এ পর্যন্ত তোমার কাছে একটিও মিথ্যে কথা বলিনি, ভবিষ্যতেও তুমি যা জিজ্ঞেস করবে তার কোনো মিথ্যে উত্তর দেবো না। আমি তোমার যোগ্য নই, কিন্তু ক্রমঃশ যোগ্য হয়ে উঠতে পারি, হতে শুরু করেছি, তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই আমার নিজের মধ্যে একটা পবিত্রতার স্পর্শ ও বোধ পেয়েছি। তুমি আমার জীবনকে স্নিগ্ধ করে দিতে পারো।
আমি তোমাকে জানি। আমি তোমাকে দেখেই তোমাকে সম্পূর্ন জেনেছি। মানুষ চিনতে আমার কখনো ভুল হয় না, আমার চোখের দৃষ্টি কত তীক্ষ্ম তুমি জানো না। আমি তোমাকে দেখেই জেনেছি - তোমার এমন অনেক দূর্লভ গুন আছে - যা তুমি নিজেই জানো না। তুমি কি সত্যিই আমাকে গ্রহণ করবে? আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।
আমাকে গ্রহণ করলে তোমাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কিন্তু তোমাকে পেলে আমার কিছুই হারাবার নেই - বরং, আমি অশেষ সৌভাগ্যবান হবো। তুমি কি আমার জন্য সেসব ত্যাগ স্বীকার করতে চাও? পারবে, তোমার এতদিনের চেনা পরিবেশ ছেড়ে আসতে? তোমাদের বাড়ি খুব সম্ভব আমাকে স্বীকার করবে না। আমার তো কোনো চালচুলো নেই। আমি বিদেশে গিয়েছিলুম - এটা কারুর কারুর কাছে হয়তো সম্মানের বা ঈর্ষার হতে পারে - কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে তার তো কোনো মূল্যই নেই।
আমাদের দেশ থেকে সবাই বিদেশে যায় উঁচু ডিগ্রী নিয়ে আসতে বা চাকরীর উন্নতি করতে - আমি শুধু ছন্নছাড়ার মত গিয়েছিলাম খেয়াল খুশীমতো জীবন কাটাতে। তা ছাড়া, বড় চাকরি করা বা খোঁজার চেষ্ঠা হয়তো আমার দ্বারা আর ইহজীবনে সম্ভব হবে না। আমি এক ধরনের স্বাধীনতা, অর্থাৎ লেখার স্বাধীনতা ভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের পরিবার যদিও নির্ঝঞ্ঝাট কিন্তু কিছুটা নিম্ন মধ্যবিত্ত, তুমি যে-ধরনের জীবন যাপনে অভ্যস্ত- তাতে হয়তো তোমার খানিকটা কষ্ট হবে - অবশ্য জানি, জীবনের ক্ষেত্রে এসব কিছুই না, এতে কিছুই যায় আসে না - তবু, অভ্যেস বদল করা সত্যিই কষ্টকর। কিন্তু তুমি যদি এসব সহ্য করতে পারো - তবে বাকিটা আমি তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দিতে পারি।
আমি এতদিন খানিকটা অবিশ্বাসী হয়ে গেছিলুম, আমি ভেবেছিলাম আমার পক্ষে এ জীবনে কারুকে ভালোবাসা সম্ভব হবে না, কিন্তু আমি হঠাৎ বদলে গেলাম, তোমার জন্যে আমার এক বুক ভালোবাসা রয়েছে। আগে অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছে, কিন্তু তোমার মত কঠিন সরলতার সম্মুখীন হইনি আগে। আমি এরই প্রার্থী ছিলাম। তুমি আমাকে এত বেশি সম্মান দিলে প্রথমেই, আমার সামান্য অকিঞ্চিতকর জীবনকে তুমি এমন মূল্যবান করে তুললে যে আমি অভিভূত হয়ে পড়লুম। আমি ক্লান্ত ছিলাম।
আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম, কেউ এসে আমাকে ডাক দিক। সেই সময় তুমি এলে। আমি তোমাকে ভেবে দেখতে বলেছি। তুমি খুব ভালো করে ভেবে দেখো। অন্য কারো কথা না শুনে, তুমি নিজেই ভেবে দেখবে।
তোমার মনের দিক থেকে সামান্যতম দ্বিধা থাকলে - আমি বিদায় নিয়ে চলে যাবো। এবং ভেবে দেখবে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে- আমার প্রতি কোনো দয়া বা ভদ্রতাবোধ যেন দৃষ্টি আচ্ছন্ন না করে, কারণ প্রশ্নটা যে সত্যিই খুব বড়ো। তোমার যে-কোনো একটু ইঙ্গিতে আমি দূরে সরে যেতে পারি। আর, যদি তুমি রাজী থাকো, তবে কোনো বাধাই আর বাঁধা নয়, সব বাধাই তখন তুচ্ছ, তখন আমি জোর করে তোমার ওপর আমার অধিকার দাবি করে নিতে পারবো। সেদিন তোমার বান্ধবীর বাড়ির কাছে যখন তুমি নেমে গেলে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত নাড়ালে, সেই মুহুর্তে তোমাকে খুবই দূর্বল, অসহায় আর উদভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।
তোমার মনের মধ্যে একটা দারুন ওলোট পালোট চলছে তখন- মুখ দেখেই বোঝা যায়। একটু পরেই আমার মনে হলো - তোমাকে ও-রকম ভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি আমার, তখন তোমার রাস্তা পার হবারও ক্ষমতা ছিল না, আমার উচিত ছিল তোমার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ থাকা, তোমাকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌছে দেওয়া। কিন্তু তখন আমি খানিকটা দূরে চলে এসেছি, ফিরে গিয়ে আর তোমাকে পাবার উপায় নেই। কেন যে ঠিক সময়ে আমার ঠিক কথাটা মনে পড়ে না! কিন্তু এবার থেকে আর ভুল হবে না।
এখানে বন্ধু-বান্ধবরা খুব হৈ-হল্লা করছে।
আমি কী লিখছি জানার জন্য অনেকেরই কৌতুহল ও ব্যাগ্রতা। কিন্তু আমি একটুও জানাতে চাই না। কালকেই দুপুরে কলকাতায় ফিরবো। আশা করছি ফিরেই তোমার একটা চিঠি পাবো। সেদিন বাড়িতে কি খুব বেশী বকুনি দিয়েছে?
সুনীল
পাদটীকাঃ সব কিছুই পেলাম 'পরমা' তে।
আমি অতি আগ্রহে টাইপ করে দিলাম মাত্র। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।