............................................
আমাদের বাড়িতে ছোটবেলায় একটা পাগল থাকতো। তার নাম ছিল সাহেব আলী। সে সারাক্ষণ বকবক করতো। কোন কাজ করতো না। খাওয়ার সময় শুধু এসে খাওয়া দাওয়া করতো।
কিন্তু মাঝেমাঝে পথেঘাটে এলাকার ছোট ছোট বদ ছেলেমেয়েরা দল ধরে তাকে খুব ডিস্টার্ব করতো। এজন্য সে মাঝেমাঝে ঐসব বদ ছেলেমেয়েদের তাড়া করতো।
ছেলেমেয়েরা দল ধরে তার পিছন পিছন গিয়ে বলতো, “সাহেব আলী মুরগী চোর, বেড়া ভেঙ্গে দিলো দৌড়”।
সাহেব আলী এটা শুনেই ক্ষেপে গিয়ে হাতে ইটের বড় টুকরা নিয়ে ঐ দলের দিকে তেড়ে যেতো আর বলতো, “জোতা দিয়া দিমু ”!!
কিন্তু ইটের টুকরো হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করলেও কখনোই সে ইট দিয়ে কারো মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি করতো না!
একবার তাকে দেখা গেল চড়ুই পাখি মেরে সেটা দিয়ে ভাত রান্না করে বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরকে খাওয়াচ্ছে। আমাকে আর আমার একটা কাজিনকেও খেতে দিয়েছিল।
আর আমাদেরও খুব ইচ্ছা ছিল খাওয়ার। কিন্তু আমাদেরকে খেতে দেয়নি বড়রা।
আমার আব্বু আম্মুর কোনো এক কারণে সাহেব আলীর প্রতি খুব মায়া ছিল। আব্বুর তার প্রতি এই মায়াটা একটু বেশি ছিল। সাহেব আলী সবসময়ই খালি পায়ে থাকতো।
প্রতিবার শীতকালে সাহেব আলীকে দেখা যেত খালি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন আব্বু খুব চিল্লাচিল্লি করতো কেন এই অসহায় মানুষটাকে কোনো স্যান্ডেল কিনে দেয় নাই! তারপর আব্বু টাকা দিয়ে লোক পাঠিয়ে তাকে দোকানে নিয়ে যেতে স্যান্ডেল কিনে দিতো। স্যান্ডেল পরে সাহেব ফিরে আসতো ঠিকই। কিন্তু তার পর দিনই তাকে দেখা যেত আবার খালি পায়ে ঘুরছে! আর তার মুখে সিগারেট। পরে জানা যেত সে স্যান্ডেল বিক্রি করে সিগারেট কিনেছে।
সিগারেট মনেহয় তার অনেক ভাল্লাগতো
ঈদের সময়েও দেখা যেত তাকে লুঙ্গি দিলে সেটা সে বিক্রি করে সিগারেট কিনতো!!
তাকে সবাই নাম ধরে ডাকতো। আমরা ছোটরাও তার নাম ধরে ডাকতাম আর তুমি করে বলতাম। এজন্য আমাদেরকে মাঝেমাঝে বকা দিতো বড়রা। আমি তার সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাকে যা-ই জিজ্ঞেস করতাম, তাতেই সে “হেহেহেহে” করে হেসে বলতো “আবেডিস, আবেডিস”!! তখন অনেক রাগ লাগতো
ছোটবেলায় আমার ছবি আঁকতে খুব ভালো লাগতো।
অবসর সময়ে আমার কাজ ছিল ছবি এঁকে রং করে বাড়ির বিশেষ বিশেষ জায়গায় টেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখা। আমার মা-খালারাও ভীষণ ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। তবে তাঁরা আমার মতো পচা ছবি আঁকতেন না। তাঁদের আঁকাআঁকি বেশ ভালো। আমার ছোটখালা অনেক সৌখিন মানুষ।
উনি এইসব বেশি করতেন। খালাকে দেখতাম শাড়ি কিনে তাতে ফেব্রিক দিয়ে অনেক সুন্দর হ্যান্ড পেইন্ট করতেন। তারপর সেগুলো সবাইকে গিফট দিতেন।
খালাকে দেখে আমারও মনে সাধ জাগলো আমিও কাপড়ে পেইন্ট করবো। আম্মুকে বললাম আমাকে একটা টিশার্ট আর ফেব্রিক কিনে দিতে।
আম্মু কিনে দিলে আমি টিশার্টের উপর একটা মেয়ের ছবি এঁকে কালার করে ফেললাম। উল্টা পাল্টা আঁকিবুঁকি করে তার উপর কালার করলে এমনিতেই ভালো লাগে দেখতে। আমার টিশার্টটাও দেখতে বেশ ভালো হলো। আর তখন ছোট ছিলাম, আমি যা করতাম সেটাতেই অনেক প্রশংসা করতো সবাই
উল্লেখ্য যে, তখন শীতকাল ছিল। আমি বাইরে একটা পাটি বিছিয়ে তার উপর বসে কাজ করেছিলাম।
আঁকাআঁকি করে কালার করার পর টিশার্টটা একটা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে ওটা বাইরে মেলে দিলাম। যদিও নিয়ম হলো, ঠান্ডা বাতাসে ওটা শুকাতে হবে। কিন্তু আমি জানতাম না। আমি ওটা কড়া রোদে তাড়াতাড়ি শুকাতে দিয়ে চলে আসলাম। তারপর বোধহয় নানীবাড়িতে চলে গেছিলাম বেড়াতে।
প্রায়ই এক দেড় ঘণ্টা পর এসে দেখি আমার সেই টিশার্ট যেখানে ছিল, সেখানে নাই। বাড়িতে ঢুকতেই দেখি বারান্দায় বসে আমার সেই সাধের টিশার্ট পরে সাহেব আলী ভাত খাচ্ছে
আমি চিৎকার করে বললাম, তুমি এইটা কি করেছো বলো তো???
তাকে জিজ্ঞেস করলে তো সে কোনো উত্তরই দিতো না। সে ভাত খেতে খেতে হাসতে হাসতে বললো, আবেডিস আবেডিস!!
আমি বললাম, আমি কি এইটা তোমার জন্য বানিয়েছি যে এইটা তুমি পরেছো??
সে ভাত খেতে খেতে হাসতে লাগলো।
আর আমি রাগে দু:খে কেঁদেই ফেললাম। কেঁদে কেটে সবাইকে গিয়ে বলতে লাগলাম আমার দু:খের কাহিনী।
কিন্তু কেউ আমার দু:খটা বুঝলো না। সবাই ব্যাপারটায় খুব মজা পেল
আমার ঐ টিশার্ট পরে তাকে বেশ কয়েকদিন ঘুরতে ফিরতে দেখতাম আর গজগজ করে বলতাম, এটা আমি কত কষ্ট করে বানিয়েছি, তুমি বোঝো!! তুমি চাইলেই আমি তোমাকে এটা দিতাম!! তুমি এভাবে এটা নিয়ে নিয়েছো কেন
সাহেব আলী শুধু হাসতো!!
সাহেব আলী মানসিক ভারসাম্যহীন একজন নিখোঁজ ব্যক্তি ছিল। কিছুদিন পর তার বউ আর মেয়ে এসে তাকে নিয়ে গেল। ১ মাসের মাথায় সে পালিয়ে আবার আমাদের বাড়িতে চলে আসলো। তাকে কেউ খুঁজতে আসছে, এটা শুনলেই আবার সে পালিয়ে যেত।
তারপর অনেকদিন তার কোনো খোঁজ খবর ছিল না। এরপর একদিন সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে সবাইকে দেখা করতে আসলো। আমরা পুরো অবাক তাকে দেখে!! পুরো ভদ্রলোক!!
অনেকদিন পর কে যেন বলেছিলো তার মাথা আবার খারাপ হয়ে গেছিল তারপরে সে মারা গেছে।
আজকে আমি চিন্তা করলাম, আমি অনেক বড় হয়ে গেছি, সত্যি। কিন্তু আমার আঁকাআঁকির মোটেও উন্নতি হয়নি।
আগে যেমন আঁকতাম, এখনও তেমন আঁকি। সেইদিন আমি একটা টিশার্ট কিনেছি। এই টিশার্টটার উপরেও একটা মেয়ের ছবি। এবং ছবিটা আমি যেরকম টাইপ আঁকি, সেরকম টাইপেরই!! ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগলো। আমার আবার আগের মতো আঁকাআঁকি করতে ইচ্ছা করছে।
আঁকাআঁকি আসলেই অনেক আনন্দের একটা ব্যাপার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।