আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমায়িক দুর্ব্যবহার

হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁচ্চো।

হেঁড়েল হক মিয়া সাহেবের নাসিকায় নস্যিগমনের অ্যাকশনের সাউন্ড বহিঃপ্রকাশ। আবাল বাথান গ্রামের হেঁড়েল মিয়াকে অত্র এলাকায় কে না চেনে? গ্রামের নাম আবাল বাথান, কিন্তু এই গ্রামে গাভীর গোয়ালও আছে। হেঁড়েল হকের কণ্ঠস্বর হাঁড়ির আওয়াজ থেকে সংগৃহীত। ইয়া মোটা নাদুসনুদুস শরীরে ধামাসমতুল্য ভুঁড়ি।

হেঁড়ো কণ্ঠস্বরের কারণেই ওনার আসল নামটি নিখোঁজের নামতায় হারিয়ে গিয়ে এখন জনাব হেঁড়েল। তবে সঙ্গে হক মিয়া সাহেব উল্লেখ না করলে উনি মাইন্ড করে বিস্ফোরিত মাইন হয়ে যান। ঘড়েলের মতো হাত দুটো শরীরের অগ্রভাগে সাঁতার কেটে চলেন বলে লোকটিকে অনেকে ঘড়েল মিয়া সাহেবও বলে। ঘড়েল বলার আরও একটি সূত্র বর্তমান। ওনার ট্যানটেনে শরীরের ক্যানক্যানে স্বভাবের সহধর্মিণীর ঝাঁজালো কণ্ঠবিন্যাস বিষ মরিচের মতোই ঝালাক্ত।

বিয়ের সময় হেঁড়েলকে একটি হাতঘড়ি যৌতুক দেওয়া হয়েছিল। স্ত্রীর কোর্টের রায়তুল্য আদেশে লোকটি সব সময় সেই ঘড়িটি হাতে রাখে। ঘড়ি হাতে রাখা থেকে ঘড়েল। একদিন তার বিবি লতাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- স্বামীর প্রতি তার এমন অর্ডার কেন? লতারুননেছার উত্তর- বিয়ের ঘড়ি হাতে থাকলে তার তেলের ড্রামতুল্য স্বামীটি আর অন্য কোনো লেডিসের দিকে তাকাতে খায়েশ পাবে না।

পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া হেঁড়েল সাহেব এক সময় চাকরি করতেন।

কিন্তু কী একটা নষ্টিফষ্টির কারণে সে চাকরিটি চলে যায়। তবে তার মধ্যে করে নিয়েছেন অনেক। একতলা বাড়ি, বাড়ির পাশে ফলের বাগান, ছেলে-মেয়ে দুটোকে কলেজে পাঠানো। মেয়েটি কলেজে পড়তে পড়তে ফুড়ুৎ। এক মস্তানের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে আবার চার বছর পর সে সন্তানসহ পিত্রালয়ে ফিরে এসেছে।

ছেলেটি চাকরি খুঁজতে চরকার মতো ঘুরে ঘুরে অবশেষে বাসস্ট্যান্ডে স্টাটার। ঘড়েল সাহেব বাজারের পাশে সরকারি জমিতে বেশ কয়েকখানা ঘর তুলে সেই দোকানগুলোর মাসিক ভাড়া আদায় করেন। সঙ্গে থাকে একখানা অতিবৃদ্ধ সাইকেল। তাতে চড়ে হাট-বাজারে কলা, কচু, পেঁপে, আম, কাঁঠাল, পাকা গাব ইত্যাদি ব্যাগে ঝুলিয়ে নিয়ে নিজে হাঁটু ভেঙে বসে ধরাধরি করে বিক্রি করেন। তবে তার দুটি বিশেষ অভ্যাস আছে।

বইপড়া আর স্থানীয় ক্লাবে গিয়ে প্রতিদিন খবরের কাগজ মুখস্ত করা। কিন্তু কেউ হেঁড়েলকে বই পড়তে দিতে চায় না। কেননা বইয়ের স্থানবিশেষ কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করে পাশে কলম দিয়ে মন্তব্য করা ওই লোকটির অন্যতম বিশ্রী অভ্যাস। আর ক্লাবে খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ উনি কাগজগুলো আটকিয়ে রাখেন। কেউ পড়তে চাইলে ভীমগর্জনে তেড়ে ওঠেন।

কখনো কখনো কাগজ ভাঁজ করে চেয়ারে কোলের পরে রেখে দেন। এ জন্যে ক্লাবে লোকটিকে নিয়ে দারুণ সমালোচনা। আরও একটি স্বভাব- লোক পেলেই হেঁড়েল মিয়া তার বাগানের কাঁঠালের কাঠাবিশেষ জমির বিস্তৃতি সমপরিমাণ প্রশংসা করেন।

আমি এই উপজেলায় চাকরি নিয়ে এসেছি মাস পাঁচেক। এখানে বাজারের পাশে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকি।

এই বাড়ির সামনে দিয়েই হেঁড়েল বাজারে যাতায়াত করে। ভোরে উঠে হাঁটা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। হেঁড়েল সাহেবও ভোরে হাঁটতে বের হয়। এভাবেই আমাদের পরিচয়, আলাপ এবং ছায়া ছায়া হৃদ্যতা। লোকটি বেশ আলাপ জমাতে পারে।

সেই আলাপের মধ্যেই তার গাছের কাঁঠালের মৌখিক রসপ্রস্রবণ। শোনে শোনে মনে হয় হেঁড়েলের গাছের কাঁঠাল না খেলে জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ রসাস্বাদ অতৃপ্ত রয়ে যাবে।

সুদূর জালালপুর থেকে আমি এখানে চাকরি করতে এসেছি। গ্রামেই মানুষ আমি। গ্রামের পরিবেশেই প্রকৃত আনন্দ পাই।

এই স্থানটি গ্রাম হলেও শহরের কাছাকাছি বলে উৎকট আধুনিকতার পচন লেগে হৃদয়হীন হয়ে উঠেছে। হেঁড়েলের সঙ্গে রোজ ভোরে হাঁটতে হাঁটতে এখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার চেহারাটা তার বিশদ বিবরণে ফুটে উঠত। অপরের দুর্নাম বর্ণনা ওনার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। যেন হেঁড়েল ছাড়া আর এই এলাকায় কোনো সৎ, সুন্দরমনের, ভালো স্বভাবের মানুষ নেই। উনি নিজেই নিজের গুণগানে বিমোহিত, আর অন্য আলাপ নেই।

এ ধরনের স্বভাবের মানুষের সঙ্গে বিতর্ক বড্ড সিরিয়াস ব্যাপার! মতের মিল না হলে ক্ষেপসিরিয়াস কন্ডিশন। ধারালো ছুরি মাজায় গুঁজে রাখার মতো। তবুও লোকটিকে আমি সেধে নিজের বাসায় নিয়ে গেছি, যথেষ্ট আপ্যায়ন করেছি। এমন কী তিন চার দিন দাওয়াত করেও প্রচুর মাছ, মাংস, পোলাও পরিবেশন করেছি। আমার বাচ্চা দুটো ওনাকে 'চাচা' বলে জড়িয়ে ধরে খুশি হয় এবং বাচ্চাদের মা হেঁড়েলকে সম্মান দিয়ে কথা বলে।

কিন্তু হেঁড়েল পেটুক? না। কখনো মনের ভুলেও ওনার বাড়িতে যাওয়ার শব্দ বা বাক্যটি উচ্চারণ করে না। তা না করুক। সব মানুষের মনতো সমান নয়। অবশ্য আমার স্ত্রী একদিন কথা প্রসঙ্গে বলল- হেঁড়েল লোকটিকে খুব সুবিধাবাদী, ধূর্ত বলেই মনে হয়।

দেশ, দেশের মানুষ, সমকালের রাজনীতি, সরকার, শাসনব্যবস্থা, চলতি সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুর বিরুদ্ধেই হেঁড়েলের অসংখ্য অভিযোগ। মন্দ ছাড়া ভালো কোনোকিছুই লোকটির চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে উনি সমাজতন্ত্রের কথা তোলেন। আমি কটাক্ষ করে বলি সমাজতন্ত্রে তো ব্যক্তিগত সুবিধাবাদ ঠোক্কর খাবে মিয়া সাহেব। আপনি কি সেই মানসিকতার ঊর্ধ্বে? উনি এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে সমকালের গতানুগতিক পচনধরা রাজনীতির মুখস্ত পুঁথি বয়ান শুরু করলেন।

বৈশাখের শেষ দিক।

হাঁটতে বেরিয়ে হেঁড়েলের মুখে তার বাগানের সুমিষ্ট সুস্বাদু সুগন্ধময় কাঁঠালের রসময় বর্ণনা। সে কাঁঠাল বাজারে নাকি খুবই উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে, প্রচুর চাহিদা। ইতোমধ্যে আমার শ্বশুরবাড়ি নাটোর থেকে কাঁচাগোল্লা এসেছিল, তা থেকে কিছুটা ওনারও বাসায় পাঠিয়েছি। কিন্তু হেঁড়েলের গাছের কাঁঠালের গন্ধ আমার বাসায় এ পর্যন্ত পেঁৗছয়নি।

কয়েকদিন পর।

হাঁটতে বেরিয়ে হেঁড়েল হাত ধরে বলল- চলেন। আমার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসবেন। সকাল বেলা। কী করা যায়? তবুও আপত্তি করলাম।

না সাদেক সাহেব, আপনার কোনো আপত্তিই শুনব না। চলুন- বলেই হেঁড়েল আমার হাত ধরে বসল।

হেঁড়েল হকের বাড়ি। ফলবাগান দিয়ে ঘেরা। বাড়ির বারান্দায় সারি সারি দিয়ে কাঁঠাল শোয়ানো।

হেঁড়েল বলল- আজ তো হাটের দিন। এগুলো হাটে যাবে। এগুলো থেকে ভালো একটি কাঁঠাল আপনাকে দেব বলে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছি। আপত্তি করলাম- থাক দরকার নেই। উনি শুনল না।

মাঝারি সাইজের একটি কাঁঠাল আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন- নিয়ে যান। আপনার ছেলেমেয়েদের জন্য দিচ্ছি। ভাবীও কাঁঠাল খেয়ে খুশি হবে। এটা আমার সবচেয়ে ভালো গাছের কাঁঠাল।

কাঁঠালের গায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বাসার দিকে ফিরছি, সঙ্গে হেঁড়েল।

কিছুটা এগিয়ে সামনে বাজার এসে গেল। হঠাৎ হেঁড়েল জিজ্ঞাসা করল, কাছে টাকা আছে? পাঁচটি টাকা খুবই দরকার। বাজার থেকে জর্দা নিতে হবে। জর্দা ছাড়া আমার বেগম পান খেতে পারে না। আমার কাছে সামান্য কিছু টাকা ছিল।

তা থেকে পাঁচটি টাকা বের করে দিলাম। হেঁড়েল টাকা হাতে নিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, হাটে বেচলে এ কাঁঠালটা ৫০ টাকার কমে ছাড়তাম না সাদেক সাহেব। তা আপনি হলেন আমার একান্ত বন্ধুজন। আপনার কাছ থেকে তো সে দাম নিতে পারব না। চক্ষুলজ্জা বলে তো একটা কথা আছে।

আপনি না হয় ৪০ টাকাই দেবেন। তা থেকে এই পাঁচ টাকা অগ্রিম নিলাম। বাকি পঁয়ত্রিশ টাকা কবে দেবেন? আমি হলাম এককথার মানুষ। কথা দিলে ঠিকই রাখি। আপনাকে কথা দিয়েছিলাম যে আমার গাছের ফাস্টোক্লাস কাঁঠাল খাওয়াবো।

এই তো। সেই কথা রাখলাম। বাকি পঁয়ত্রিশ টাকা তাহলে কবে পাব?

আমি তো অবাক? হেঁড়েলের সম্পর্কে স্থানীয়রা যে সব বিশ্রী কথা বলে সেগুলো যে মিথ্যা নয় তা আজ বুঝলাম। তবে আমিও ওকে একটু 'ওস্তাদের মার' দেখিয়ে ছাড়বো। কাঁঠালটার মাঝামাঝি ভেঙে কয়েকটি কোয়া বের করে নিয়ে হেঁড়েলের দিকে আড়চোখে তাকাতেই ও হেঁড়ে গলায় স্বরসঙ্গত শুরু করল- একি! এখন ভাঙছেন কেন? আগে বাসায় নিয়ে যান।

আমিও হেসে হেসে স্বরবিন্যাস করলাম- পাঁচ টাকার কাঁঠাল আমি বের করে নিলাম বাকি পঁয়ত্রিশ টাকার কাঁঠাল আপনি ফেরত নিয়ে যান।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।