কানাডার রাজধানী অটোয়ার ন্যাশনাল আর্ট সেন্টারের থিয়েটার হলে ১৪-১৬ নভেম্বর মঞ্চস্থ হলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক আকরাম খানের নৃত্যনাট্য দেশ (মাতৃভূমি বাংলাদেশ)। উল্লেখ্য, তিনি বর্তমান সময়ে বিশ্বের অন্যতম কোরিওগ্রাফার। তাঁর এই কনটেম্পোরারি একক নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে অটোয়া ন্যাশনাল আর্ট সেন্টারের শাখা এনএসি ডেন্স। এর আগে আকরাম খান অটোয়া আর্ট সেন্টারে আরও কয়েকটি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। তবে এটিই ছিল তাঁর প্রথম একক নৃত্যানুষ্ঠান।
তিন দিনে অটোয়ার অভিবাসী বাঙালিসহ প্রায় দুই হাজার ৪০০ দর্শক নৃত্যনাট্যটি উপভোগ করেন।
আকরাম খানের এবারের প্রযোজনা বাংলাদেশকে ঘিরে। দেশ নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে তিনি শিকড়ের কথা, স্মৃতিচারণাসহ নিজ পরিবারের কথা বলেছেন। আমরা যাঁরা অভিবাসী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বাস করছি, তাঁদের দৈনন্দিন জীবন, নতুন আবাসন, সংকটের কথা, এককথায় পুরোনো আর নতুনের পারস্পরিক সংঘর্ষের কথা নৃত্যের তালে তালে তুলে ধরেছেন।
অটোয়ায় আকরাম খানের দেশ নৃত্যনাট্য এমন এক সময়ে মঞ্চস্থ হলো, যখন আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতি আমাদের কাছেই কুয়াশাচ্ছন্ন।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বসবাসকারী বাঙালিরা হিন্দি সিনেমা, সিরিয়াল, নাচ, গানকে বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধা করছেন না। কেউ কেউ মনে করেন, এই বিজাতীয় সংস্কৃতিই হলো আভিজাত্যের প্রতীক। প্রতিকূল এমন এক সময়ে বাংলা ভাষা আর নিজস্ব সংস্কৃতিকে ঘিরে আকরাম খানের এ পরিবেশনা অটোয়াপ্রবাসী বাঙালিসহ সবার মনে দাগ কেটেছে। অটোয়া এবং টরন্টোর নামীদামি দৈনিক পত্রিকা এবং বোদ্ধা দর্শকেরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
একজন অভিবাসী বাঙালি হিসেবে আমি যখন নৃত্যনাট্যটি দেখছিলাম, তখন নিজেকে খুব গর্বিত মনে হচ্ছিল।
একবারও মনে হয়নি যে সমস্যাসংকুল একটি দেশে আমার জন্ম হয়েছিল। সেই দেশ থেকেই একদা এখানে এসেছি। আকরাম খান আমাকে তা মনে করতে দেননি। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শকেরা অবাক বিস্ময়ে তাঁর নৃত্য এবং পর্দায় আলোকরশ্মির মাধ্যমে তৈরি বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটির মানুষ আর তার জীবনযাত্রা চাক্ষুষ করল।
এ পরিবেশনা কি শুধু তৃতীয় বিশ্বের বাংলাদেশ নামক একটি দেশের কাহিনি, না লন্ডনে অভিবাসন নেওয়া একটি বাংলাদেশি পরিবারের কাহিনি? তা মনে হয়নি।
আমরা যদি বর্তমান সময়ের আলোচিত কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের পরিবেশিত দেশ নৃত্যনাট্যের কাহিনির ভেতরে একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করি, তাহলে দেখা যাবে সেই সত্যটি। নৃত্যানুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা শেষ হতে না হতেই পুরো হল নীরব-নিস্তব্ধ।
অন্ধকার আর পিনপতন নিস্তব্ধতার মাঝে মঞ্চে একটু একটু করে রাতের আকাশের রং ফোটে। মঞ্চে রাখা একটা ঢিবি, অনেকটা দেখতে কবরের মতো তার ওপরে আলো। ঢিবির ভেতরে একটি ছোট গাছের চারা আর তার পাশে একটা কুঠার।
অন্ধকার রাতের আঁধার ভেদ করে একটি জ্বলন্ত লেমটন হাতে আকরাম খান মঞ্চে এলেন। মনে হলো রাতের অন্ধকারে তিনি কিছু খুঁজছেন। তার পরে ঢিবির পাশে রাখা কুঠার দিয়ে ঢিবিকে আঘাত করতে লাগলেন।
এই জায়গাতেই দেশ (মাতৃভূমি বাংলাদেশ) নৃত্যনাট্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিদ্যমান। একদিকে মনে হচ্ছিল আকরাম খান কাজ করছেন, অন্যদিকে মনে হলো তিনি কিছু খুঁজছেন।
পরিবেশনাটি শেষ হওয়ার পরই জানা গেল, আকরাম খান খুঁজছিলেন পুরোনোকে, নিজের অস্তিত্বকে। হলভর্তি দর্শক-শ্রোতা সেই তাগিদেই আত্মমগ্ন হয়ে যান দেশের কাহিনিতে।
আকরাম খান যখন নিজের চকচকে টাকে নাক-মুখ-চোখ এঁকে সেই টাকটাকে মাথা হিসেবে দেখিয়ে আরেকজন মানুষ হয়ে গেলেন, বাবা হয়ে গেলেন। আকরামের বাবা, আমাদের যে কারও বাবা, আমাদের পিতৃপুরুষ। ছোটখাটো মানুষ, শ্রমের ভারে কুঁজো আর গরিমাময়।
সেই পিতৃপ্রতীক উপস্থিত শ্রোতাদের বলে যান তাঁর জীবনযুদ্ধের কথা; বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামের কথা, গ্রামে দুই-চার শ লোককে রেঁধে খাওয়ানোর কথা।
লন্ডনে এসেও তিনি কেবল রেস্টুরেন্টে রাঁধেন আর রাঁধেন। ভাঙাচোরা ইংরেজিতে কথা বলেন। মাথা নিচু করে টাকটাকেই মুখচ্ছবি হিসেবে দেখিয়ে আকরাম গলদঘর্ম নেচে যান। বাবা স্বগতোক্তি করেন, বাবা গল্প করেন।
আকরামকে চিৎকার করে ডাকেন নিচতলায় খেতে যাওয়ার জন্য। সবাই টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছেন তাঁর সঙ্গে খাবেন বলে। আকরাম ওপরতলায় নাচ প্র্যাকটিস করছেন। নাচ কেন? এ নিয়ে বাপের সঙ্গে তর্কবিতর্ক।
এই আকরামই আবার ছোট্ট ঈশিতাকে গল্প শোনান।
বনবিবি আর দক্ষিণারায়ের গল্প। ঈশিতাকে গল্প শোনানো সহজ নয়। সে পেটে উঠে বসে কাতুকুতু দেয়। ঈশিতা লেডি গাগাকে চেনে। সে আকরামকে বলতে ভোলে না বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা।
ঈশিতার বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের যুদ্ধের কথা শুনে আকরাম চিৎকার করে মাকে খাস বাংলায় ডাক দিয়ে বলে, ‘আম্মা, তুমি আবার ঈশিতারে তোমার হিস্টোরি শুনাইছ?’ এ যেন প্রথম প্রজন্মের অস্তিত্ব-সংকট, দ্বিতীয় প্রজন্মের আত্মপরিচয় তৈরির চেষ্টা এবং বর্তমান প্রজন্মের সত্যসন্ধানী মনোভাব।
ঈশিতাকে বলা গল্পের মাধ্যমে আকরাম খান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনকে নিয়ে আসেন অটোয়ার ন্যাশনাল আর্ট সেন্টারে। মঞ্চের সামনে একটা কালো পর্দায় ভেসে ওঠে গাছগাছালি-নদ-নদী। প্রযুক্তির কল্যাণে পর্দায় একটি ছোট ছেলের উপস্থিতিতে গল্প হয়ে যায় জীবন্ত। যে গল্পের নায়ক মধু খেতে ভীষণ ভালোবাসে।
কিন্তু মধু চলে যায় হাটে। তার আর মধু খাওয়া হয় না। ছেলেটি বাবার সঙ্গে মৌচাক খোঁজে। গাছ বেয়ে মগডালে উঠে যায়। দিন ফুরিয়ে রাত আসে।
জঙ্গল তাকে আপন করে নেয়।
একদিন বাঘের গর্জনে প্রাণ কেঁপে ওঠে তার। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে ছেলেটি একসময় পেছনে ফিরে দেখে বাঘ নয়, প্রকাণ্ড এক কামান। ছেলেটি এক হাত বাড়িয়ে কামানটাকে থামিয়ে দেয়। তখন মাথার ওপরে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি।
এই বৃষ্টি এবং আকরাম খান তখন বাংলাদেশি দর্শককে নিয়ে যান স্মৃতির অতলে। তখন তাঁদের সামনে অনেক কিছু ভেসে ওঠে; বাংলাদেশের কৃষক, বৈরী প্রকৃতির বিপরীতে সংগ্রামরত মানুষ, আমাদের গর্বের ধন গেরিলা অর্থাৎ আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা।
সামরিক শাসনবিরোধী স্লোগান ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, কবি শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ কবিতার অংশবিশেষ এবং ‘জলে ভাসা পদ্ম আমি শুধু পেলাম ছলনা’ গানের কথাগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ পরিচিত হবে একটি নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে।
অভিবাসী হিসেবে আমার কাছে আকরামের ঈশিতাকে বলা গল্পের দ্বিতীয় অংশটি খুবই সময়োপযোগী মনে হয়েছে। ঈশিতা গল্পের বাকিটুকু জানার আগ্রহ প্রকাশ করলে আকরাম তাকে বলেন, তুমি যদি বাংলা ভাষায় কথা বলা এবং পড়ালেখা শেখো, তাহলে তোমাকে সেই পাসওয়ার্ডটি দেওয়া হবে।
ঈশিতা রাজি হয় আর আকরাম খান নৃত্যের তালে তালে তাকে সেই পাসওয়ার্ডটি দেন। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, বিদেশে জন্ম নেওয়া আকরাম প্রাচীন বাংলার প্রাচীনতম নৃত্যমুদ্রা তাক ধিনা ধিন তাক ব্যবহার করেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সম্ভাবনার দেশ আমাদের ফেলে আসা মাতৃভূমি। সেই দেশ স্বৈরাচার, নষ্টভ্রষ্ট রাজনীতিক আর অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারণে বিপর্যস্ত। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সাভার ট্র্যাজেডি, ড. ইউনূস প্রসঙ্গ আর বর্তমানের রাজনৈতিক অস্থিরতা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থা নাজুক করে তুলেছে।
এমন অবস্থায় বিদেশে জন্ম নেওয়া এক বাংলাদেশি তাঁর মাতৃভূমিকে স্বদর্পে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন তার নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে। তিনি তাঁর অভিনীত এবং পরিচালিত নৃত্যনাট্যে বাংলাদেশের ট্রাফিক সমস্যা, নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা, মৌলবাদের আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে সংগ্রামের গল্প অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বর্ণনা করেন।
আমরা যদি আকরাম খানের দেশ নামক নৃত্যকাহনের অন্তিম দৃশ্যের দিকে তাকাই তাহলে আজকের বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে। অবাক বিস্ময়ে মঞ্চে দেখলাম নেংটিপ্রায় ধুতি পরা আকরাম অক্লান্ত ঘাম ঝরিয়ে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলেন তাঁর আপন বস্ত্রখণ্ড পিরানটি। কয়েক দশক আগে বাংলা ভাষার অন্যতম কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর লাল সালুর মাধ্যমে আমাদের আপন ঐতিহ্যে ফেরার পথটি দেখিয়েছিলেন।
সেই একই কাজ নিখুঁত নৃত্যকুশলতায় আকরাম করেছেন লাল সালুঘেরা অভাগা দেশটির অবগুণ্ঠনের অস্তিত্ব ধরে আমূল টান দিয়ে। আমাদের মনে পড়ে তখন শাহবাগ প্রজন্মের গর্জন। তেঁতুল হুজুরের মুখোশঘেরা আজকের বাংলাদেশ।
কবির চৌধুরী
অটোয়া, কানাডা
<[email protected]>
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।