নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কিছু দিন আগে পর্যন্ত নতুন প্রকল্প অনুমোদন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী গত অক্টোবর ও চলতি নভেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ১৯৩টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ১২১ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন বলে জানা গেছে। প্রকল্প উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের সাফল্যের কথা তুলে ধরে এসব প্রকল্পকে এলাকাবাসীর জন্য তাঁর সরকারের উপহার হিসেবে উল্লেখ করেন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় বসাতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এসব প্রকল্পের উদ্বোধন নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
সরকারের রুটিন কাজ হলেও নৈতিকতার দিক থেকে এটাকে দৃষ্টিকটু হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এর মাধ্যমে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির পথ বন্ধ হয়ে যায় বলে মনে করেন তাঁরা।
সবশেষ গত ১৯ নভেম্বর ঢাকার বাইরে পটুয়াখালীর কলাপাড়া পায়রা বন্দর এলাকায় সারোয়ার জাহান পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে জনসভায় কলাপাড়া পায়রা সমুদ্রবন্দর, পটুয়াখালী মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, পটুয়াখালী শিশু একাডেমী কমপ্লেক্স, উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন কলাপাড়া শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু, পটুয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়, বাউফল থানা ভবন, বানৌজা শের-ই-বাংলা নৌঘাঁটির। ওই দিনই বরগুনার তালতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে বসে উদ্বোধন করেন বরগুনা জেলা সার্ভার স্টেশন, তালতলী উপজেলার দক্ষিণ ঝাড়াখালী এসইএসডিপি নতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন, বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজের একাডেমিক ভবন নির্মাণ ও ট্যাংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ইকো-ট্যুরিজম সুযোগ বৃদ্ধিকরণ কাজের।
সেখানে বসেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন নতুন করে তৈরি তালতলী উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন, বরগুনা সদর হাসপাতালকে ৫০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ, বরগুনা-তালতলী-সোনাকাটা সড়কের বরগুনা জেলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বরগুনা জেলার আমতলী থানা ভবন, গোলবুনিয়া প্রতিরক্ষামূলক কাজের আমতলী-তালতলী-সোনাকাটা সড়কের ৮২০০ মিটার চেইনেজে ৬৬ মিটার (কচুপাত্রা) গার্ডার ব্রিজ, ইসিআরআরপির আওতায় দক্ষিণ সওদাগরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টার, আমতলী চৌরাস্তা বক্স কালভার্ট ও আমতলী উপজেলাধীন লোচা প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টারের।
এ ছাড়া নভেম্বর মাসে রাজবাড়ী, নওগাঁ, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, মাদারীপুরের শিবচর, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া বাগেরহাটের মংলা, রামপাল, গাজীপুরের কাশিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ৬৩টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং ৭৬টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। আর গত অক্টোবরে করেছেন ১১৭টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং ৫৮টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন।
এদিকে গত ৫ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হয়েছে ৪ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার ১৫টি প্রকল্প। এর আটটিকেই নির্বাচনমুখী বলে উল্লেখ করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
স্থানীয় সরকার, যোগাযোগ, শিল্প, স্বাস্থ্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব প্রকল্প উদ্দেশ্যমূলকভাবেই নেওয়া হয়েছে বলে তাঁরা মন্তব্য করেন। বাস্তবে এর সুফল পাওয়া যাবে না বলেই তাঁদের ধারণা। এদিকে ১২ নভেম্বরের পরের বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার ১৭টি প্রকল্প। এর কয়েকটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
২৭ অক্টোবর থেকে নির্বাচনী আবহাওয়া চলে আসায় এরপর প্রধানমন্ত্রীর নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যে নির্বাচনী প্রচার করছেন, সেটাকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান এ বিষয়ে প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ হয়ে গেলে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো কাজ করা ঠিক না। সাধারণভাবে নির্বাচনের সময়সীমার বিষয়টি নির্ধারিত হয় সংসদ ভেঙে দিলে কিংবা সংসদের পাঁচ বছর পূর্তির ৯০ দিন আগে। এই সময়ে যেসব উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন হচ্ছে বা হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে কথা বলা উচিত নির্বাচন কমিশনের এবং যাঁরা নির্বাচন করবেন তাঁদের। এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকে আপত্তির কথা শোনা যায়নি। তিনি আরও বলেন, এই সময়ে এমন কোনো রুটিন বা নীতিনির্ধারণী কাজ করা ঠিক না, যা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে বা পরবর্তী সরকার অগ্রাহ্য করতে পারে।
এ বিষয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও এই রীতি নীতি মেনে চলা হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছিলেন, ২৭ অক্টোবর থেকে নির্বাচনী কাউন্ট ডাউন শুরু। সে সময়ের পরও প্রধানমন্ত্রী নতুন নতুন প্রকল্পের উদ্বোধন করে প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। দলের জন্য ভোট চাইছেন।
নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কেন পদক্ষেপ নিল না, আমার মাথায় আসে না। নির্বাচনকালীন সরকারের কাজ হলো “নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” বা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরিতে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। কিন্তু এটা তৈরির জন্য যে সময় ছিল, তার অর্ধেকটাই চলে গেছে। ’ এখন যে আচরণবিধি রয়েছে, তা দিয়ে কতটা সমান সুযোগ করা সম্ভব তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে নেতিবাচক বলা যাবে না।
কিন্তু রাজনৈতিক এবং নৈতিক অবস্থান থেকে এটা অগ্রহণযোগ্য। নির্বাচনকে সামনে রেখে এটাকে ভোট চাওয়ার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা অনৈতিক ও দৃষ্টিকটু। তিনি আরও বলেন, নৈতিকতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় অবস্থান ব্যবহার করে উদ্বোধনের সংস্কৃতি গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। এ ক্ষেত্রে শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে পাওয়া সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে একই সময়ে রাজনৈতিক জনসভা এবং ভোট চাওয়া নৈতিকতার দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করেন ইফতেখারুজ্জামান।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।