ফণিভূষণ নামটা মুখে নিতেই নিজের উপর সাংঘাতিক রাগ হলো সেকান্দারের। বালের নাম দেহি মুখ থিকা যায় না! মনে মনে গজ গজ করতে থাকে সে। ফণিও এসব জানে, তাই সেও কোন সাড়া-শব্দ করে না। যেন কিছুই শুনেনি এমন ভাব করে সেকান্দারের পাশে পাশে চলতে থাকে। সেকান্দার পরক্ষণেই সংশোধন করে ডাকে ফণিকে, ইসমাইল...।
ফণি এবার সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দেয়, জ্বি ভাই?
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সেকেন্দার বলে, তুই হইলি আমার ধর্ম ভাই, বুঝছোত?
ফণি দুর্বল গলায় উত্তর দেয়, জ্বি।
মালাউন হইয়া মরতি, এখন মুমিন মুসলমান হইয়া মরবি। তোর পরকাল রক্ষা পাইছে, কি কছ?
তা তো ঠিক কথা ভাই।
কি সুন্দর তোর নাম হইছে- ইসমাইল! ভাল নাম না?
সুন্দর নাম ভাই।
ইসমাইল নামে আমাদের একজন নবী ছিলেন।
তার পিতাও একজন নবী। তার নাম ইব্রাহিম। আল্লাপাক ইসমাইলকে কোরবানী দিতে বলছিল ইব্রাহিম নবীকে। ঘটনাটা জানছ নি?
জানি ভাই। মসজিদে যেদিন আমার নাম রাখলো হুজুরে, সেইদিনই বলছিলেন।
মাশাল্লা এখন তুই নামে চেহারা-ছুরতে খাঁটি মুমিন মুসলমান, কি কছ?
অবশ্যই ভাই।
নাকি মিছা কথা কছ আমার লগে?
কি কন ভাই, মিছা কথা কমু ক্যান?
ধর্মত্যাগীর শাস্তি হইল মৃত্যুদন্ড। এইটা আল্লাপাকের বিধান। যে দ্বিনের পথ থিকা ফের শিরকের পথ বাইচ্ছা নেয় তার শাস্তি হইল পাথর ছুইড়া মারা...।
সেকান্দারের গায়ে মোটা খাকি শার্ট, লুঙ্গির উপর চওড়া বেল্ট বাধা।
এই পোশাকে তাকে লাগছে ঠিক চকিদারের মত। যদিও আজকাল নিজেকে তার ‘মিলিটারি মিলিটারি’ মনে হয়। হাতে রাইফেল থাকলে তো একদম মিলিটারি! একদম শরাফত আজমী স্যারের মত । খাঁটি পাঠানের বাচ্চা এই শরাফত আজমী। কি চেহারা! আর কি ইসলামী জোস! কাফেররে ইসলামের ছায়া তলে আনছে জেনে কি খুশীটাই না হলো সেইদিন সেকান্দারের উপর।
অন্ধকার ঝোপঝারে যেতে যেতে টর্চের আলো ফেলে সেকান্দার। কোথায় যে কে ওঁত পেতে আছে কে বলবে? এই ফণি হারামীটাকেই বা বিশ্বাস কি? যদি প্রতিশোধ নিতে চায়? দুই ভাইয়ে তেমন ভাব না থাকলেও মনি তো ওর ভাই। হঠাৎ মনির কথা মনে পড়ল সেকান্দারের। মহা শয়তান ছিল হারামজাদা! পায়খানার নিচে গিয়ে লুকিয়ে ছিল। তাদের দলটা মনিকে সেখান থেকে টেনে বের করে আনে।
মালাউনটা বন্দুকের নলের সামনেও স্বীকার করলো না সোনার গয়নাগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। এই হিন্দুগুলি খাক না খাক, সোনাদানা থাকবেই। সেকান্দাররা অনুমান করেছিল মাল ভালই পাওয়া যাবে। মেজাজটা তাই বেশি বিগড়ে গিয়েছিল। মনির বউটা তো ওর চেয়ে বেশি শয়তান।
মাগীর কাপড় খুলে...। তবু যদি মাগীটা মুখ খুলে! ওদের এক কথা, গয়না নেই বাবা! মনি সেকান্দারের পা ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিল। সেকান্দারের মন একটুও গলেনি তাতে। মনির ভিটেবাড়ি খুড়ে হালের জমি বানিয়ে ফেলেছে সেকান্দাররা লুকোনো সোনার খোঁজে। ছেলেমেয়ের কাছে ওগুলো আগেই পাচার করে দিয়েছে মনি।
ইন্ডিয়ায় ওর ছেলে থাকে। সেকান্দারের অনুমান হাওয়া-বাতাস টের পেয়ে মনি ওগুলো আগেই বার্ডার পার কিরে দিয়েছে।
ফণি সেই তুলনায় অনেক ভাল। সাত ভরি সোনা সে নিজের হাতে তুলে দিয়েছে সেকান্দারের হাতে। সেকান্দারের কথায় বউ সহ ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছে।
দুদিন আগেও যে শিরক করতো মূর্তিপূজা করে এখন মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে। আজমী স্যার এই জন্য সেকেন্দারের পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। স্যারকে বলে ফণিকে একটা কাজও পাইয়ে দিয়েছে সেকান্দার। এ জন্য সে বেতনও পাবে। ফণির আজ নাইট ডিউটি।
স্কুল ঘরে ক্যাম্প হয়েছে। সেকান্দার ফণিকে নিয়ে সেখানেই যাচ্ছে। এশার নামাজ পড়ে দুজন রওনা হয়েছে। আরো দশ-বারো জন তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে সেখানে।
২.
ফণি বেরিয়ে যাবার পর ছায়া বসেই ছিল।
ঘরের দাওয়ায় বসে সন্ধ্যা হতে দেখলো। বুক ফেটে তার দীর্ঘশ্বাস বের হয়। ওখানে একটা তুলসীতলা ছিল। তার হাতে শাঁখা ছিল। সিধায় সিদুর ছিল।
সেও ছিল ছায়া, এখন তাও নেই। সে এখন ফাতেমা। যাক, ফাতেমার এখন ভয় নেই। ছায়ার ভয় ছিল। তার স্বামী ফণির ভয় ছিল।
ইসমাইলের ভয় নেই। দাদা আর বৌদিকে এজন্যই মরতে হয়েছিল। বৌদির কাপড় খুলে গয়নার সন্ধান করেছে ওরা। ছায়ার চোখ ভরে পানি এলো একথা মনে করে। একসঙ্গে থাকতে গেলে কত ঝগড়াঝাটি হয়।
তাদেরও হয়েছিল। শাশুড়ি বেঁচে থাকতে এক হাড়ি ছিল। পরে বউয়ে বউয়ে ঝগড়াঝাটিতে দুই ভাই ভিন্ন হয়। তাতেই বরং সম্পর্কটা ভাল হয়েছিল। নিজের দিদির মত ছিল বৌদি।
ভাসুরকে যখন মারে ফণি তখন ঘরে বসে কাঁপছে। সেকান্দারের সঙ্গে ফণির আগে থেকে সখ্য ছিল। বাড়িতে আসতো। একটা যুদ্ধ না বাঁধলে বুঝি মানুষকে পুরোপুরি জানা যায় না। এই যে সেকান্দার, যাকে চিরকাল দেখে আসছে, সে যে মনে মনে কি পুষে রাখতো এক ভগবানই তা জানতো...।
ভগবান? ছায়া ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভগবান তো তাদের আগেই ত্যাগ করেছেন। তারাও ভগবানকে ত্যাগ করেছে। বাড়িতে সকাল-সন্ধ্যা যে দেবতার পূজা হতো ফণি তাকে লুকিয়ে রেখেছে ঘরের চালায় কোথায় যেন। এখন আল্লা ছাড়া তাদের আর কেউ নেই...।
ঘোর আঁধার নেমেছে কখন ছায়া টেরও পায়নি। মশা ঝাঁক বেধে কামড়ে ধরেছে। তার জীবনে এরকম কোনদিন হয়নি। সন্ধ্যা নেমে গেছে অথচ ঘরে সন্ধ্যা বাতি দেয়নি। হিন্দুঘরের মেয়ে সে।
সন্ধ্যাবেলা ধূপবাতি জ্বালানো তাদের রীতি। মুসলমানের ঘরেও সন্ধ্যাবেলা আলো জ্বলে। তারাও উঠান ঝাট দিয়ে ঘরের দাওয়ায় পানি ছিটায়। এসব তো গ্রামের মুসলমানরাও করে। আজ যে তার কি হলো।
ছায়া উঠে গিয়ে কুপি ধরিয়ে দাওয়ার সামনে রাখে।
দুপুরে কিছু খায়নি ছায়া। খিদে মরে গেছে সেই যেদিন সেকান্দাররা ভাসুর আর বৌদিকে মেরেকেটে যায়। ছায়ার মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই কি এসব ঘটেছে নাকি? পুরাটাই একটা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। দেশে নাকি যুদ্ধ লেগেছে।
সেই যুদ্ধে তারা যে কোন পক্ষের তাই সে জানে না। তাদের হিন্দুরা সব দলে দলে দেশ ছাড়ছে। সবাই বলাবলি করছিল একটাও হিন্দু আর আস্ত থাকবে না। কেন যে লোকে এসব বলতো ছায়া বুঝতো না। বিশ্বাসই হতো না।
শুনতো ঢাকায় ছ্ত্রারা সব রাস্তায় মরে পড়ে আছে। ঢাকায় কোনদিন যায়নি ছায়া। ঢাকায় নাকি ঘোর দূর্যোগ। একদিন যে তাদের গ্রামেই সেই দূর্যোগ এসে পড়বে তা কল্পনাও করতে পারেনি ছায়া। যাদের এতদিন দেখে এসেছে।
এক গ্রামে বাস করেছে। তারাই যে একদিন সাক্ষাৎ যমের ভূমিকায় নামবে ছায়ার এখনো বিশ্বাস হয় না।
ঘরে একটু চাল ভাজা ছিল তাই ধামায় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। কিছুই মুখে রোচছে না। ছায়া বসে বসে ভাবে, গ্রামে কত মুসলমানের ঘরেও আগুন দিয়েছে ওরা।
সুলেমানের মত তাজা জোয়ান ছেলেটারে স্কুলঘরের কাছে তাল গাছের সঙ্গে বেধে পিটিয়ে মেরেছ। সুলেমান নাকি ইন্ডিয়া যাওয়ার পায়তারা করছিল। কত মুসলমানের ঘর খালি পড়ে আছে। সব ফেলেটেলে ভেগেছে প্রাণ হাতে নিয়ে। ফাতেমাও তাহলে নিরাপদ নয়? সেকান্দার নাকি কথা দিয়েছে সে উনার ধর্ম ভাই।
কাজেই উনার কোন ভয় নেই। বলেছে সে ও তার পরিবার র্নিভয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এই ঘোর অন্ধকারে বসে থেকে এই আশ্বাস এখন মনে জোর আনতে পারছে না ফাতেমার। বরং অজানা একটা শংঙ্কায় গাটা বারবার কাঁটা দিয়ে উঠছে। সারাক্ষণ শুধু ‘কি হয় কি হয়’ এক আতংক।
উনি চলে গেলেন তাকে একা ফেলে। বলে গেলেন নাইট ডিউটি না কি আছে। আজ আর রাতে ফিরবেন না। এর মানে হচ্ছে সারারাত ছায়া আর দুচোখ এক করতে পারবে না। এমনি বসে বসে স্মৃতি রোমন্থন করবে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।
এই দুঃসহ যন্ত্রণা তার আর সহ্য হচ্ছে না। সময়গুলো যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। কখন এই কালো অমানিশা কাটবে? কখন ভোর হবে আর ফণি ঘরে ফিরে আসবে...।
৩.
ফণি ঘরে ফিরে এসে দেখে ছায়া উপুর হয়ে শুয়ে আছে। ফণি কাঁধের গামছাটা বেড়াতে ঝুলানো দড়িতে রাখতে রাখতে একবার ঘাড় বেঁকিয়ে ছায়ার দিকে তাকায়।
ছায়া ওমনি শুয়ে আছে। কোন সাড়াশব্দ নেই। ফণি জানে ছায়ার ঘুম পাতলা। একটু শব্দ হলেই ওর ঘুম চটে যায়। ফণির চেয়ে থেকে মনে হলো, যেন মরে গেছে ছায়া।
ফণি চেয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে ছায়ার মাথার কাছে এসে বসে। ফণি ছায়ার পিঠে আলতো হাত রাখলো। ছায়া মরেনি...।
মুখ ফিরিয়ে ছায়া ফণিকে দেখে।
ছায়ার ক্ষত-বিক্ষত ঠোট, বাঁ চোখে রক্ত জমা।
ফণি ছায়াকে ডাকে। ছায়া অদ্ভূত এক অচেনা দৃষ্টিতে তাকায় ফণির দিকে। সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে ফণি সহসা কিছু বলতে পারে না। ফণি জানে তাকে আজ রাতেও নাইট ডিউটিতে যেতে হবে।
ইসমাইলকে এসব করতে হবে ফণিকে বাঁচাতেই। ফাতেমাও মুখ বুজে থাকবে ছায়ার জন্যই...।
ফণি তবু জানতে চায়, কে? ...
ছায়া দূরাগত কোন দেশ থেকে যেন উত্তর দেয়, তোমার ধর্ম ভাই...।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।