চলচ্চিত্র এমন একটা মাধ্যম যা শুধু পর্দায় মানুষের মনের কথাই তুলে ধরেনা , তুলে ধরে দেশ,বিশ্ব ,সময় , মানুষের দুঃখ-কষ্ট , আনন্দ-বেদনার প্রতিটি মুহূর্ত । তুলে ধরে মানুষের জীবনের পাওয়া-না পাওয়া , সংগ্রাম-আন্দোলনের জ্বলন্ত সব দৃশ্য । আর পর্দায় এমন সব মুহূর্ত তুলে আনার পিছনে যে মানুষদের অন্যতম ভূমিকা থাকে , তারা হলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা কিংবা পরিচালক। যুগ, সময়ের কথা তুলে এনে চলচ্চিত্র দর্শকদের সামনে তা উপস্থাপন করাই একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা কিংবা পরিচালকের প্রধান কাজ । আর তেমনি বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন জহির রায়হান ।
তিনি শুধু একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা কিংবা পরিচালকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক,গল্পকার এবং তার আরেকটি বড় পরিচয় ছিল তিনি ছিলেন ১৯৫২ সালের একজন ভাষাসৈনিক ।
চলচ্চিত্র জীবনের অনেক কথা বলে , আর এই মাধ্যমটিই মানুষের জীবনের কথাকে হয়ত খুব সুন্দরভাবে মানুষের কাছে পৌঁছায়। মানুষ কি চাই , কি তার উদ্দ্যেশ্য সবই এই চলচ্চিত্রের ফ্রেমে বন্দী করা যায় । সমাজ , জীবন ,সভ্যতা, ইতিহাস ,সময় প্রতিটি স্তরকেই স্পর্শ করে চলচ্চিত্র। আর তেমনটাই হয়ত মনে করতেন সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান ।
আর তার জন্যেই একসময় তিনি বেছে নিয়েছিলেন চলচ্চিত্রের রুপালী জগতকে । একের পর এক তিনি নির্মাণ করেন তার অসামান্য সব শৈল্পিক চলচ্চিত্র । আর তার জন্যে আজও এই গুণী নির্মাতাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে গভীরভাবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। আজও তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে হয়ে উঠেন বহু নির্মাতার আদর্শ । তার কাজ , তার একাগ্রতা,সৃষ্টি সবকিছু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আজও গভীরভাবে প্রভাব রেখে যায় ।
ভাষা আন্দোলন এবং তার বেড়ে ওঠা
গুণী নির্মাতা জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে । ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হয়ে আসেন । তার প্রাথমিক লেখাপড়া শুরু হয় কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউট ও কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় । ১৯৪৯সালে নতুন সাহিত্য পত্রিকা (কলকাতায়) তে “ওদের জানিয়ে দাও “ শীর্ষক কবিতা প্রকাশিত। ১৯৫০ আমিরাবাদ হাইস্কুল (ফেনী) থেকে তিনি মেট্রিক পরীক্ষা দেন।
১৯৫৩ সালে তিনি আইএসসি পাস করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে কিছুদিন কিছুদিন চিকিৎসাশাস্ত্রে লেখাপড়া করেন । কিন্তু সেখানে কোর্স শেষ না করে তিনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন । ১৯৫২ সালে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় ভাষা আন্দোলনকারী । ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ভাষা আন্দোলনের সময় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গেছিলেন প্রথম যে দশজন , জহির রায়হান ছিলেন তাদের মধ্যে একজন ।
তার সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ছাত্র অবস্থায় ১৯৫০ সালে “যুগের আলো” পত্রিকায় কাজ করার মাধ্যমে । এরই ধারাভিকতায় তিনি পরবর্তীতে “খাপছাড়া”, “যান্ত্রিক”, “সিনেমা” ইত্যাদি পত্রিকায় কাজে করেন । ১৯৫৬ সালে তিনি “প্রবাহ” নামে একটা বাংলা মাসিক পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন । সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা “এক্সপ্রেস” ও তিনি সম্পাদনা করেন।
পারিবারিক জীবন
পারিবারিক জীবনে জহির রায়হানের দুই স্ত্রী’র একজন সুমিতা দেবী।
এই প্রয়াত অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত নাট্য নির্মাতা। আর আরেক স্ত্রী অভিনেত্রী সুচন্দা’র ছোট ছেলে তপু রায়হানও একজন অভিনেতা।
চলচ্চিত্র জগতে জহির রায়হান
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হয়ত নির্মাতা জহির রায়হানের মনে প্রভাব ফেলেছিল , আর তাই হয়ত তিনি নির্মাণ করেছিলেন তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র “জীবন থেকে নেয়া”, যা ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় । যাতে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সমাজের বিভিন্ন চিত্র ।
মানুষের বঞ্চনা , পাওয়া না পাওয়ার আক্ষেপ , মানুষের আন্দোলন । চলচ্চিত্র জগতে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের আবির্ভাব ঘটে ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানি চলচ্চিত্র পরিচালক জারদারির “জাগো হুয়া সাবেরা” ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। ১৯৬০ সালে “কখনও আসেনি” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি পরিচালক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন । ১৯৬৪ সালে তিনি তিনি উর্দু ভাষায় পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি “সঙ্গম” নির্মাণ করেন । ১৯৬৫ সালে তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র “বাহানা” মুক্তি পায় ।
এছাড়া তার অন্য চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে - কাঁচের দেয়াল, সোনার কাজল, বেহুলা, আনোয়ারা, জ্বলতে সুরুজ নিচে এবং এ স্টেট ইজ বর্ন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান ,আর যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে নির্মাণ করেন “স্টপ জেনোসাইড”। তার শেষ চলচ্চিত্র ছিল “লেট দেয়ার বি লাইট”, যার নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেননি পরিচালক জহির রায়হান । নিগার পুরস্কার ('কাঁচের দেয়াল') চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে পান। এছাড়া চলচ্চিত্রের জন্যে তিনি ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান ।
বাংলা সাহিত্যে জহির রায়হান
বাংলা সাহিত্যজগতে তিনি রেখে গেছেন অসামান্য অবদান । অসাধারণ সব গল্প আর উপন্যাস তিনি রচনা করে গেছেন। পঞ্চাশের দশকে ছাত্র অবস্থায় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ “সূর্য গ্রহণ” প্রকাশিত। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে -হাজার বছর ধরে,শেষ বিকেলের মেয়ে, বরফ গলা নদী ,আর কত দিন এবং আরেক ফাল্গুন । ১৯৬৪ সালে তিনি “হাজার বছর ধরে” উপন্যাসের জন্য আদমজী পুরস্কার লাভ।
বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৭১সালে (উপন্যাসঃ মরণোত্তর),স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৯২ সালে (সাহিত্যঃ মরণোত্তর) ।
হারিয়ে যাওয়া জহির রায়হান
সৃষ্টি লক্ষ্যে যে মানুষটির জন্ম হয়েছিল , সে মানুষটিই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন দেশে শহীদ হন । নিখোঁজ বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের খোঁজ নিতে গিয়ে নিজেই চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান । ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে তিনি উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন কিন্তু অবাঙালি বিহারিদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী। ওই প্রতিরোধযুদ্ধে প্রায় ১০০ বাঙালি সেনা শহীদ হন , আর নিখোঁজ হন স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এই প্রবাদতুল্য পুরুষের অবদান ভুলবার নয় । তার রেখে যাওয়া চলচ্চিত্রের ধ্যান-ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে অনেক নির্মাতার আবির্ভাব হচ্ছে । জহির রায়হান এক কিংবদন্তী । বাংলা চলচ্চিত্রের সভ্যতায় তার চলচ্চিত্রের এক ক্ষুরধার স্পর্শ তিনি রেখে গেছেন,যার পরতে পরতে এখনও মানুষ জহির রায়হানের কথা স্মরণ করে । বাংলা চলচ্চিত্রজগতে জহির রায়হান এর নাম সবসময় জীবন্ত থাকবে ।
বেঁচে থাকবে তার সকল সৃষ্টিকর্ম সকল বাংলাদেশী চলচ্চিত্রপ্রেমিদের কাছে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।