বিজয়ের ৪২ বছরেও নির্মাণ হয়নি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র। বাঙালি হিসেবে এ ব্যর্থতা পুরো জাতির। এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রায় একডজন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। এগুলোর কোনোটিকেই পূর্ণাঙ্গ তথ্যভিত্তিক চলচ্চিত্র বলতে নারাজ চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এগুলো হচ্ছে খণ্ডচিত্র।
ফলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে সেটি হতে পারে স্বাধীনতার প্রকৃত দলিল। বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও এমন দাবি করেছেন।
১৯৭১ সালে বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালে নির্মিত হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র 'ওরা ১১ জন'। এটি পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম।
এ চলচ্চিত্রে যুদ্ধকালীন কিছু খণ্ড চিত্রের সনি্নবেশ ঘটানো হয়েছিল। কিন্তু পরিপূর্ণ চিত্র এতে পাওয়া যায়নি। চলচ্চিত্রটির প্রযোজক মাসুদ পারভেজ বলেন, এটি আসলে চলচ্চিত্র নয়। 'ওরা ১১ জন' হচ্ছে রিয়েল ডকুমেন্ট অব ফ্রিডম ফাইট। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো দুঃসাহস দেখাতে পারিনি।
কয়েকটি ঘটনার মালা গেঁথে তৈরি করেছি মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র। এটি হচ্ছে 'পার্ট অব লিবার্টি'। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর কবিতা লেখা হয়েছে, কিন্তু কয়টি গল্প বা উপন্যাস লেখা হয়েছে, যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তৈরি করা যায়? তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র তৈরি করতে গেলে অস্ত্রশস্ত্র, সরঞ্জাম এবং সামরিক বাহিনীর পোশাক প্রয়োজন। এসব কি পাওয়া যাবে? এগুলোর জন্য শতভাগ সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু বিজয়ে ৪২ বছরেও কোনো সরকার এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কয়টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয় সেগুলোকেও যথাযথ সম্মান দেখানো হয়নি। মাসুদ পারভেজ বলেন, 'ওরা ১১ জন' নির্মাণ করে এ পর্যন্ত কোনো সরকারের কাছ থেকে একটি ধন্যবাদ পর্যন্ত পাইনি। এরপর কি আর মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে কারও আগ্রহ থাকার কথা? প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আজিজুর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত নির্মিত কোনোটিকেই মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র বলা যাবে না। কারণ এগুলো নির্মিত হয়েছে আংশিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালীন হুবহু চিত্র।
এখানে থাকতে হবে পাকবাহিনীর যুদ্ধের নামে নৃশংসতা ও ভয়াবহতার পাশাপাশি মুক্তিবাহিনী এবং মুজিবনগর সরকারকে দেওয়া ভারতের সহযোগিতার বিষয়টি। অথচ এদেশে নির্মিত একটি চলচ্চিত্রেও ভারতের সহযোগিতার বিষয়টি দেখানো হয়নি। এটি ছাড়া চলচ্চিত্র নির্মাণ মানে মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ চিত্র প্রদর্শন অথবা ইতিহাস বিকৃতি করা। চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জহির রায়হান নির্মিত 'স্টপ জেনোসাইড' ও 'এ স্টেট ইজ বর্ন' হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য দলিল। কিন্তু এগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নয়, তথ্যচিত্র মাত্র।
তার ইচ্ছা ছিল মুক্তিযুদ্ধের পুরো ইতিহাস তুলে ধরে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা। গল্প ও চিত্রনাট্যও প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই নিরুদ্দেশ হলেন তিনি। জহির রায়হানের স্বপ্ন নিয়ে আমি এগুতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এর জন্য যে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন, তা আজ পর্যন্ত পাইনি।
ফলে জহির রায়হানের স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেল। চলচ্চিত্রকার শহীদুল ইসলাম খোকন বলেন, 'গ্রিফিথ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্মিত হয়েছে যুদ্ধের কালজয়ী সব চলচ্চিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে চ্যাপলিনই সৃষ্টি করেছেন যুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি 'মসিয়ে ভার্দু'। কিন্তু যে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ইতিহাস রয়েছে সে জাতিই পারল না মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। এর জন্য দায়ী কে? এ প্রশ্ন আজ সবার।
এদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের কন্যা অভিনেত্রী শমী কায়সার নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে পূর্ণাঙ্গ একটি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজও শুরু করেছেন তিনি। তার কথায় আমি মুক্তিযুদ্ধকে সেলুলয়েডের ফিতায় হুবহু তুলে ধরতে চাই। এর জন্য সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। আশা করছি, এ সহযোগিতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একটি অকাট্য দলিল জাতিকে উপহার দিতে পারব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।