ইয়াহিয়া খান একটি রাজনৈতিক সমস্যাকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছিলেন।
পাক হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। শাসকরা ভেবেছিল বাঙালি সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এবং সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নির্মূল করলেই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু হয়েছিল হিতে বিপরীত। মুক্তিবাহিনী গঠনের পর তাতে যোগ দিলেন হাজার হাজার ছাত্র-জনতা।
প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র তুলে নিলেন হাতে। দেশের অভ্যন্তরে শুরু হলো গেরিলা আক্রমণ। মুক্তিবাহিনীর ১১টি সেক্টর ও তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হলো। যোগ দিল নৌ-কমান্ডো, মুক্তিবাহিনীর নৌ-শাখা ও বিমান শাখা। পাকিস্তান সরকারে কর্মরত বহু বাঙালি কর্মকর্তা ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।
পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিদেশে কর্মরত বহু কূটনীতিকও কর্মস্থল ত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। দেশপ্রেমের এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে আরও বেগবান ও অনুপ্রাণিত করেছে আমাদের সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও মিডিয়া সংগঠনগুলো। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সঠিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি প্রচার করায় খুব দ্রুতই বিশ্ব জনমত স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসে। ভারতের সক্রিয় সমর্থন এবং ডিসেম্বরে তাদের সশস্ত্র বাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহণ বিজয়কে আরও ত্বরান্বিত করে।
তবে মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। সেদিন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিঃস্বার্থভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। সে জন্যই মাত্র ৯ মাসে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। আবারও এমন ত্যাগের মহিমায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমি ১৯৭১ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসের আর্টিলারি ইউনিটের অফিসার ছিলাম।
২৫ মার্চ রাত ১০টায় সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনা ও অফিসারদের আটক ও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। অফিসার হওয়ার সুবাদে আমাদের চারজনকে প্রথমে আর্টিলারি ইউনিটের একটি অফিস কক্ষে আটকে রাখা হয়। তিন দিন খাদ্য-পানি ছাড়াই সেখানে ছিলাম। ৩০ মার্চ রাতে ওরা আমাদের কক্ষে ঢুকে গুলি করে। আমার সহযোগীরা শহীদ হন।
তিনটি গুলি লাগলেও সৌভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই। আমি চোখের কোনায়, ডান হাতের কব্জি ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরার ভান করে পড়ে থাকি। তারা আমাকে মৃত ভেবে চলে যায়। রাতে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই। পরে বুড়িচং থানার ভরাশাল গ্রামে গিয়ে জীবন রক্ষা পাই।
চার দিন পর আমাকে ভারতের আগরতলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে আমি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। চৌদ্দগ্রাম অপারেশনে আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি ব্রিজ পাকিস্তান বাহিনীর প্রহরা উপেক্ষা করে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিই। ফলে চট্টগ্রামের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জুনের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত আমরা ফেনী-বেলুনিয়া পকেটের প্রায় ২০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে বহাল রাখি।
কিন্তু হানাদার বাহিনী বিমান হামলা এবং হেলিকপ্টার বহর থেকে ছত্রীসেনা নামিয়ে যুগপৎ আক্রমণ করলে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করে দ্বিতীয় বেলুনিয়া যুদ্ধে আমরা পাকবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। তাদের পরাজিত করে ফেনী-বেলুনিয়া পকেট পুনরুদ্ধার করি। হানাদার বাহিনীর প্রায় দুই হাজার সদস্য এ যুদ্ধে আত্মসমর্পণ ছাড়াও ১৮০ জন নিহত হন। আমাদের ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এ যুদ্ধে সাহসিকতা ও সাফল্যের জন্য আমাকে ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। আমরা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা মুক্ত করে মিরসরাই-সীতাকুণ্ড হয়ে কুমিড়া পৌঁছি। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৫টায় হানাদার বাহিনীর আত্দসমর্পণের সংবাদ পাই। এর আগ পর্যন্ত আমাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকে। সেদিন চট্টগ্রামের হাটহাজারী পৌঁছে গিয়েছিলাম।
হানাদার বাহিনীর আত্দসমর্পণ ও যুদ্ধবিরতির সংবাদে সবাই উল্লাসে মেতে উঠি। অনুলিখন : আহমদ সেলিম রেজা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।