সমাজে এমন কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যাদের কাজ ও চিন্তার বহুমুখিতা অনুকরণীয়। মেজর [অব.] রফিকুল ইসলাম তেমনি একজন মানুষ। যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। মৃদুভাষী, নিরহঙ্কারী রফিক রুচি ও ব্যক্তিত্বের এক অনন্য উদাহরণ। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- শেখ মেহেদী হাসান
আপনার ছেলেবেলা কেমন ছিল।
আমাদের গ্রামের বাড়ি হলো চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার নাওড়ায়। নাওড়ায় স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেছি। তারপর আব্বার কর্মসূত্রে বরিশালের ভাণ্ডারিয়ায়, সেখান থেকে গোপালগঞ্জে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় আমরা গোপালগঞ্জে ছিলাম। তখন আমাদের মধ্যে একটা অনুভূতি আসে যে, আমাদের মাতৃভাষা পাকিস্তানিরা কেড়ে নিতে চায়।
আমরা খুব উত্তেজিত ছিলাম, কোনো অবস্থাতেই এটা মেনে নেব না। একটা যুদ্ধের মনোভাব এসে গেল। মনে হলো, ওরা তো আমাদের কেউ না। আমার আব্বা ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। আব্বার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ছিল।
মনে পড়ে, ভাষা আন্দোলনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফরিদপুর জেল থেকে বঙ্গবন্ধুকে গোপালগঞ্জে নিয়ে এলে আমরা ওনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। এরপর আব্বা ফরিদপুরের পালং এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চাকরি করেন। ১৯৫৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনন্দা মডেল হাইস্কুল থেকে আমি মাধ্যমিক পাস করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। ইতোমধ্যে '৫৮-তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চালু হয়েছে। তখন রাজনীতি আমাকে আকর্ষণ করল।
আমি কিছুদিন কুমিল্লার ফুলার হোস্টেলে ছিলাম। এরপর আব্বা কুমিল্লায় বদলি এলেন। বাগিচাগাঁওতে বাড়িও করলেন। আমরা ৯ ভাইবোন একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। আমি ছিলাম সবার বড়।
খুব অ্যাডভান্সার ছিলাম। তবে পড়াশোনায় কখনো ফাঁকি দেয়নি। ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় আমরা রাতের অন্ধকারে প্রত্যেকে দু-তিনটা করে ইট এনে শহীদ মিনার বানিয়ে সকালে সেখানে ফুলের মালা দিতাম। ভাষা শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতাম। ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আপনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং আইয়ুব খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়ে আমি নতুন একটি জগৎ পেলাম। আমাদের বিভাগে অনেক খ্যাতিমান শিক্ষক ছিলেন। আমার সাবসিডিয়ারি ছিল ম্যাথমেটিঙ্ ও পরিসংখ্যান। বছর দুই পড়েছিলাম কিন্তু অনার্স শেষ করিনি।
তখন আমি ঢাকা ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। আমি ঢাকা হলের [বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল] চার তলায় ৮৮ নম্বর কক্ষে থাকতাম। আজকের নামকরা অ্যাডভোকেট বাসেত মজুমদার থাকতেন নিচ তলায় সিঁড়ির ডাক দিকে। একেক কক্ষে দুই থেকে তিনজন থাকতাম। হলের রাজনীতি এবং আইয়ুবের দেওয়া সেই শরিফ কমিশনের [পরে হামুদুর কমিশন] শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের যে মুভমেন্ট ছিল তাতে আমি যথেষ্ট অ্যাকটিভ ছিলাম।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল হায়দার আকবর খান রনো। আমি, রনো দুজনই ঢাকা হলটা দেখতাম। আমি ছিলাম আবাসিক, রনো এবং সাংবাদিক রহিম আজাদ ছিলেন অ্যাটাস্ট। আমার ওপর বেশ চাপ যেত। কমরেড ফরহাদের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ।
তখন আমার ভেতরে একটা অনুভূতি এলো, কেবল আন্দোলন করে আমার দেশকে স্বাধীন করা যাবে না। পশ্চিমাদের বিতরণ করে আমাদের রাষ্ট্রকে স্বাধীন করতে হবে। এই ধারণাটি সম্ভবত ভাষা আন্দোলন থেকে আমার মধ্যে আসে। মনে হতো, আমরা কেন স্বাধীন দেশ গড়তে পারব না? আমি ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ করি। আমরা বকশিবাজারের একটি চায়ের দোকানে বসতাম।
একদিন কমরেড ফরহাদের সঙ্গে কথায় কথায় বললাম, ফরহাদ ভাই এই আন্দোলনের পাশাপাশি আপনাদের সামরিক বাহিনীতে লোক পাঠাতে হবে। আমাদের কর্মীদের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ না নিলে ভবিষ্যতে কিছু করা যাবে না। এরপর ফরহাদ ভাই এবং আমার পরিবারের কাউকে না জানিয়ে আমি সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীতে দরখাস্ত দিই। একপর্যায়ে আমার রিটেনসহ অন্যান্য পরীক্ষা হয় এবং আমি সিলেক্ট হয়ে গেলাম।
বাড়ি থেকে সেনাবাহিনীতে যাওয়ার অনুমতি কি সহজে পেয়েছিলেন?
আর্মিতে সিলেকশন হওয়ার পর আব্বাকে গিয়ে বললাম, আপনাকে না জানিয়ে আপনার সই নকল করে আমি আর্মিকে দরখাস্ত দিয়েছিলাম, আমার চাকরি হয়ে গেছে।
প্রথমে আব্বা, আম্মাসহ পরিবারের কেউ রাজি ছিলেন না। আমি ভেতরের কথা কাউকে বলিনি। অর্থনীতিতে আমি ভালোই করছিলাম। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক সচিব ড. সাত্তার ছিলেন আমার ভাতিজা [বয়সে আমার জ্যেষ্ঠ]। ড. সাত্তার এবং অর্থনীতিবিদ ড. হুদা সাহেব আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি করেছিলেন।
তাদেরও কিছু বললাম না। ফরহাদ ভাই আর রনোকে বললাম আমি চলে যাচ্ছি। তাদের এও বললাম, আমাদের আরও কিছু বাছাই করা ছেলেকে সেনাবাহিনীতে ঢুকাতে হবে, সে যে পদেই হোক। টেকনিকগুলো জানতে হবে। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরের শেষে আমি যোগ দিলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।
আপনি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করেছিলেন।
পাকিস্তানের কাকুলের মিলিটারি একাডেমির ক্যাডেট হিসেবে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে আমি প্রশিক্ষণ শুরু করি। সেখানে আমার একটাই চিন্তা ছিল, আমি ভালো প্রশিক্ষণ নেব। আমি যুদ্ধের প্রতিটি বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানব। দেশের ম্যাপটা নিয়ে ভাবতাম, কীভাবে কী করা যায়? তখন থেকেই আমি দেশ স্বাধীনের স্বপ্ন দেখতাম।
আমি তো হঠাৎ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়িনি। যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে আমি সেনাবাহিনীতে গিয়েছিলাম। কাকুলে যাওয়ার পর আমার নেওয়া হলো সায়েন্সে। ম্যাথমেটিঙ্, ফিজিঙ্ নিয়ে আমাকে পেশোয়ার ইউনিভার্সিটির অধীনে গ্র্যাজুয়েশন করতে হয়। গ্র্যাজুয়েশনের পর মিলিটারি একাডেমি থেকে আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে পাঠিয়ে দিল।
সেখানে বেসিক ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করি। এর মধ্যে ১৯৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধে। তখন পাকিস্তানের এনসিও ছিলেন সম্ভবত জেনারেল ফারুকী। বাঙালিদের সম্পর্কে তিনি একটা মন্তব্য করেছিলেন, যা আমার ভালো লাগেনি। আমি তাকে প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, আপনি বাঙালিদের সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে আর্মি হেডকোয়ার্টারের জেএসইউকে বিষয়টি জানালেন। আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর থেকে পরের দিনই আর্টিলারি কোরে পাঠিয়ে দিল। আমি রিসালপুরে ট্রেনিং করতে করতে চলে গেলাম নওশা আর্টিলারি সেন্টারে। আমার মনে হয় না, বিশ্বের কোথাও একজন লেফটেন্যান্ট তার যে কোর সেই কোরের চিফের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারে! আর্টিলারির বেসিক কোর্স শেষ হওয়ার পর আমাকে লাহোর ফ্রন্টে ২৪ ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে যায়। ১৯৬৫-এর যুদ্ধের সময় রিসালপুরে আমাদের কতগুলো বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টের জন্য তৈরি করা হচ্ছিল।
ওই বছরই আমি কমিশন লাভ করি।
লাহোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আপনার পোস্টিং কোথায় ছিল?
১৯৬৮ সালে আমাকে যশোর ক্যান্টমেন্টে পোস্টিং দেয়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর '৫৯ মার্শাল ল' হলো। সে সময় আমার ভূমিকা একটু ভিন্নধর্মী ছিল। ততদিনে আগরতলা ষড়যন্ত্র হয়ে গেছে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারকে গ্রেফতার ও বিচার শুরু হলো। তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। আমরা নিজেরাও শঙ্কিত ছিলাম। তারা বাঙালি অফিসার, জেসিও, এনসিও যারা সেনাবাহিনীতে ছিল তাদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করল। আমরা ভাবছিলাম, পাকিস্তানিরা হয় আমাদের সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করবে, নয়তো মেরে ফেলবে।
এই মামলার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় যা দিন দিন বাড়ছিল। যেখানে ৫২'-এর ভাষা আন্দোলন থেকে আমি রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ ছিলাম, হয়তো আমার মতো অনেকেই ছিল, তাদের আর পাকিস্তানের সঙ্গে পেচাপের সুযোগ ছিল না।
সেনাবাহিনীতে তো আপনারা নানা রকমের বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন।
আমার পোস্টিং হওয়ার কথা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। আমি ভাবলাম একবার পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে ওখান থেকে এসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছু করতে পারব না।
তখন মিলিটারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রহমান যিনি আমাদের পোস্টিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মিলিটারি একাডেমিতে আমার কমান্ডার ছিলেন। তাকে আমি আব্বার অসুখের কথা বলে, অনুরোধ করি আমাকে আরও কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তানে রাখার জন্য। তখন তিনি আমাকে পাকিস্তানের পোস্টিং অর্ডার ক্যান্সেল করে ইপিআরে ডেপুটেশনে দিয়ে দিলেন। অন ডেপুটেশনে সহকারী কমান্ডার হিসেবে আমি দিনাজপুরে যোগ দিলাম, ১৯৭৯-এর শেষ দিকে।
সেখানে ৭-৮ মাস ছিলাম। সেখানে ইপিআরের বিওপিগুলোতে ঘুরে বেড়াতাম। সবার সঙ্গে কথা বলতাম। তারাই আমাকে বলত, স্যার এদের সঙ্গে থাকা যাবে না, এরা আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করে। তখন গোপনে বাঙালিদের মধ্যে যাকে বিশ্বস্ত মনে করতাম তাদের বলতাম, তৈরি থাক যে কোনো সময় দেশের জন্য যুদ্ধ করতে হবে।
দেশকে স্বাধীন করতে হবে।
মিলিটারি একাডেমি থেকে পাকিস্তানের আইএসআই আমার ওপরে নজর রাখছিল। আমরা '৬২-তে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি মিছিলে আমি অংশ নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে রেজা আলী, রনোসহ অনেকেই ছিলেন। ওই মিছিল থেকে গভর্নর হাউসকে লক্ষ্য করে আমি একটি পাথর ছুড়েছিলাম।
আমার ছবিটা তুলেছিলেন অবজারভারের সাংবাদিক মোজ্জামেল সাহেব। তখন আমি আর্মিতে ট্রেনিং করছি। ছয় মাস পার হয়েছে, একদিন মিলিটারি একাডেমির প্যারেট গ্রাউন্ড থেকে আমাকে ডেকে আনা হলো, কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তখন কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রফিক পরে মেজর জেনারেল এবং আইয়ুব খানের মিলিটারি সেক্রেটারি। আমি প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে প্রায় হাফ মাইল দৌড়ে ওপরে এসে দেখি পেশোয়ার ইউনিভার্সিটিতে আমাদের যারা পড়াতেন তারাও সেখানে উপস্থিত।
বিজ্ঞানের শিক্ষক মি. নাসিরুল্লাহ এবং ইংরেজির শিক্ষক ক্যাপ্টেন নাকভি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। নাকভি আমাকে বললেন, তোমার কি যে একটা ছবি এসেছে, তুমি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলে। তোমাকে যাই জিজ্ঞেস করুক, তুমি মিথ্যা বলবা না। বাকিটা আমরা দেখব। আমি কমান্ডারের রুমে ঢুকেই দেখি তার টেবিলে একটি ছবি পড়ে আছে।
ব্রিগেডিয়ার রফিক আমার দিকে না তাকিয়ে ছবিটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। বললেন, পিক ইট আপ। আমি ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলাম, সেই ঢিল ছুড়বার ছবি। আমি খুব সাহস করে বললাম, স্যার, ডোন্ট থিঙ্কস ইট এ ভেরি হ্যান্ডসাম ফটো। উনি হেসে দিয়ে বললেন, গেট আউট স্কাউন্ডেল।
পরের ঘটনা ক্যাপ্টেন নাকভি আমাকে বলছিলেন, ব্রিগেডিয়ার রফিক তাদের কাছে আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তারা উনাকে জানিয়েছিলেন, সে রাজনীতিতে ছিল। তখন তো সে আর্মিতে যোগ দেয়নি। রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। সে একটা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে।
আপনারা যদি ওকে থ্রো আউট করেন আমিও এখানে থাকব না। নাসিরুল্লাহ সাহেবও একই স্ট্যান্ড নিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, হি উইল বি অ্যান এসেট। তখন ব্রিগেডিয়ার রফিক আর্মি হেড কোয়ার্টারকে আমার সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, সে রাজনীতি করেছে ঠিকই কিন্তু রফিক একজন চৌকস কর্মকর্তা। সে আমাদের দেশের জন্য এসেট।
আমি দিনাজপুরে বিওপিগুলো ঘুরে ঘুরে সৈনিকদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলি। পশ্চিমারাও এটা লক্ষ্য করেছে। ধরেন, এক-একটা বিওপিতে ১০ থেকে ১২ জন সৈনিক। তাদের মধ্যে বাঙালি ৮ জন। অবাঙালিরা আমাকে নিয়ে সন্দেহ করে, স্যার এদের সঙ্গে কি কথা বলে।
তবু আইএসআই আমার বিরুদ্ধে নজরদারি করে হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট পাঠায়, 'সুনির্দিষ্ট কিছু না জানা গেলেও তাকে এখানে রাখা ঠিক না। ' আইএসআই দিনাজপুরে ইনচার্জ ছিলেন মেজর সিদ্দিক যিনি বিয়ে করেছিলেন কুষ্টিয়ার এক বাঙালি মেয়েকে। তার টাইপিস্টও ছিলেন বাঙালি। সিদ্দিক সাহেবের স্ত্রী ওই পিওকে বলে রেখেছিলেন, কোনো কিছু হলে আমাকে জানাবা। টাইপিস্ট আমাকে বললেন, স্যার আপনি বোধহয় বেশি দিন এখানে থাকতে পারবেন না।
তখন আমাকে পোস্টিং দিলেন আজাদ কাশমির। আমি আবার জেনারেল আবদুর রহমানের সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে জানালাম, সিদ্দিক সাহেব, উনি বাঙালিদের নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলায় আমি প্রতিবাদ করেছিলাম সে জন্য এখানে পোস্টিং দিয়েছে। একদিকে আব্বা অসুস্থ, ঘরটাও তুলতে পারিনি। উনি বললেন, তোমার বিরুদ্ধে একটা রিপোর্ট গেছে।
ঠিক আছে, তুমি আর কিছু দিন পশ্চিম পাকিস্তানে থাক। তোমাকে চট্টগ্রামে বদলি করে দেব। পরে আমাকে চট্টগ্রামে বদলি করে দিলেন।
১৯৭০ সালে চট্টগ্রামে চলে আসি। দিনাজপুরে একটা বড় পাবলিক মিটিং হয়।
কে অতিথি ছিলেন আজ মনে নেই। আমি অ্যাসেস করতে গেলাম। আমার হিসাবে ৮ থেকে ১০ হাজার লোকের উপস্থিতির কথা জানিয়ে রিপোর্ট দিলাম। সিদ্দিক সাহেব রিপোর্ট দিলেন, এখানে সাত-আটশ লোক হয়েছে, তেমন কিছু না। এ ধরনের আন্ডার ইস্টিমেট করত পশ্চিমা অফিসাররা।
তারা মনে করত, বাঙালিদের কোনো মনোবল নাই। তারা বড় ধরনের কিছু করতে পারবে না।
ঠিক কোন সময়ে বুঝতে পারেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্রোহ করতে হবে এবং আপনাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে হবে।
আমি সবসময় চিন্তা করছিলাম যে, যুদ্ধ করতে হবে। আমি শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।
মানসিক প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। চট্টগ্রামে এসে আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম কী করতে হবে। প্রথম চিন্তা ছিল চট্টগ্রাম দখল করে এটাকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। সেটা পারলেই পলিটিক্যাল লিডাররা এখানে এসে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করবেন এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য চাইবেন। এটুকু আমার দায়িত্বের মধ্যে রেখেছিলাম।
এটা ছিল আমার একক সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। ১৯৭১-এর মার্চের ৩ তারিখে সংসদ বসার কথা। এর ভেতরে ওরা যে চক্রান্ত করছিল তা অনুভব করতে পারতাম। কারণ ইয়াহিয়া খান কিংবা পশ্চিমা জেনারেলরা কখনো চাইবে না, পূর্ব অঞ্চলের মানুষেরা স্বাধীন হোক।
আমি যখন যশোরে ছিলাম তখন ২৪ আর্টিলারি ফ্লিডে আমার কামান ছিল ১৮টা। এ কামানগুলো দিয়ে পশ্চিমাদের ওপর অ্যাটাক করে যশোর মুক্ত করার জন্য আমরা রেডি ছিলাম। কিন্তু বাঙালি অন্য দুই তিনজন অফিসার যারা প্রথমে অ্যাটাক করতে রাজি ছিলেন তারা হঠাৎ বলেন, স্যার ঠিক এই মুহূর্তে আমরা বিদ্রোহ করব না। আমরা ভারত থেকেও কোনো আশ্বাস পেলাম না, সুতরাং আমাদের প্ল্যান সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত একাত্তরে এসে আমরা সফল হই।
আপনি ১নং সেক্টর বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা এবং নোয়াখালীর মাতা মুহুরী নদী পর্যন্ত বৃহৎ একটি সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন; মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কোনো স্মৃতি মনে পড়ে কী?
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের রাত। চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে রেলওয়ের পাড়ে একাকী এসে দাঁড়ালাম আমি। রাত তখন ৯টা। পাহাড়ের ওপরে এক-দোতলা কাঠের বাংলো থেকে আমি টেলিফোনে দুটি ম্যাসেজ পাঠাই হালিশহরের ইপিআর হেডকোয়ার্টারে। আমার গোপন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুটো ম্যাসেজই ইপিআর ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে উত্তরে শুভপুর থেকে দক্ষিণে টেকনাফ পর্যন্ত সব ইপিআর পোস্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
প্রথম ম্যাসেজটি ছিল 'আমার জন্য কিছু কাঠের ব্যবস্থা কর' এবং দ্বিতীয় ম্যাসেজটি ছিল 'আমার জন্য কিছু কাঠ নিয়ে আসো'। দুটো ম্যাসেজই রুটিন ধরনের বিধায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের এতে সন্দেহ করার মতো কিছুই ছিল না। কিন্তু ম্যাসেজ দুটো পাঠানোর পর যখন মেঘমুক্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালাম তখন এক অজানা আশঙ্কায় আমি মুহূর্তের জন্য শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম। এটা কি একটা বিদ্রোহের আবেগময় বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমি কি একটা অসম্ভব কিছু করার চেষ্টা করছি।
যা অবশ্যম্ভাবী তা হতেই হবে। সেটা শুধু সময়ের ব্যাপার। আমার চিন্তায় বাধা পড়ে একটা বেবিট্যাঙ্ িপাহাড়ের ঢাল বেয়ে আমার কাছে এসে থামল। নেমে এলেন দুজন বাঙালি সামরিক অফিসার_ লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী এবং মেজর জিয়াউর রহমান। আমরা সেই বাংলোর সামনে একটি জামগাছের নিচে বসলাম।
লে. কর্নেল বললেন, 'এই মুহূর্তে তোমার এ ধরনের কিছু করা উচিত নয়'। আমি জানতে চাইলাম কেন? লে. কর্নেল বললেন, 'ওরা আমাদের বিরুদ্ধে মারাত্দক কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পাবে না। বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে তারা এমন কিছু করতে পারে না। ' অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি আবার সেই টেলিফোনে ২য় ম্যাসেজটি বাতিল করার জন্য নির্দেশ দিলাম। প্রথম ম্যাসেজটি অপরিবর্তিত থাকল।
আমি শেষ প্রচেষ্টায় আবার বললাম, আপনারা আমাদের ওপর প্রথম আঘাত হানার সুযোগ করে দিচ্ছেন তাদের। তখনও রাত্রির নিস্তবদ্ধতা ভেঙে পোর্ট এলাকা থেকে রাইফেল আর মেশিনগানের গুলির আওয়াজ আসছিল। এদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকায় আমার সাংকেতিক বার্তা পাওয়ার বাঙালি সেনারা দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
২৫ মার্চ রাতে আমি আগের রাতের স্থগিত কার্যক্রমের ওপর আবার পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম। এটা বুঝতে পারছিলাম যে হয় এই পদক্ষেপ আমাদের জন্য এনে দেবে স্বাধীনতা, অথবা দাঁড় করাবে 'ফায়ারিং স্কোডে'র সামনে।
আওয়ামী লীগ নেতা ডা. জাফরকে বললাম আমাদের জনগণকে রক্ষা ও মুক্তির জন্য ইপিআর সৈনিকদের নিয়ে আমি পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করছি। ষোলশহর এবং ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে বাঙালি সেনা ও অন্যদের বলুন তারা যেন আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেয়। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে তখন অন্য ঘটনা ঘটে গেল। রাত সাড়ে ১১টায় ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা তাদের ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে ইবিআরসির বাঙালি সেনাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে বসে। অস্ত্রাগার দখলে নিয়ে প্রায় এক হাজার বাঙালি সেনাকে নির্বিচারে হত্যা করে।
অন্যদিকে আমার নির্দেশও যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে বলে খবর আসতে থাকে। শত্রুদের নিরস্ত্র ও বন্দী করে ইপিআরের সৈনিকরা শহর অভিমুখে যাত্রা করে।
নিয়তির কী বিচিত্র বিধান! তার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। ২৫ মার্চের রাতে সেই দুজন অফিসার, যারা আমার ২৪ মার্চের বিদ্রোহকে থামিয়ে দিয়েছিলেন তাদের একজন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বন্দী করল। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের যে বিশ্বাস করেছিলেন, ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেই বিশ্বাসের জবাব দিল।
মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানিরা যখন রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্টে নির্মম হামলা চালায় তখন তিনি যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম পোর্টে 'সোয়াত' জাহাজ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নামিয়ে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসতে। জনতার ব্যারিকেড উঠিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন খালেক আগ্রাবাদ এলাকার প্রবেশমুখে জিয়াকে আমার যুদ্ধ শুরু করে দেওয়ার কথা জানান। এ পরিস্থিতিতে জিয়া বন্দর এলাকায় গেলে তার নিরাপত্তা বিঘি্নত হতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তাকে ফিরিয়ে আনা হয়। মাত্র ২৪ ঘণ্টা পরের ঘটনাবলিই প্রমাণ করে দিল তারা দুজনে পাকিস্তানিদের যেভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন, তা ছিল ভুল। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার আমার কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য চাপ সৃষ্টি ছিল আত্দঘাতী।
অথচ সমগ্র জাতিকে দিতে হলো চরম মূল্য। পাকিস্তানিদের সংঘটিত গণহত্যায় নিহত হলো লাখ লাখ বাঙালি।
১৯৭২-এ আপনি বেশ দ্রুত অবসরে যান, তারপরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন। ওই সময়ের কথা যদি বলেন।
আমার অবসরটা একটা চক্রান্তের ফল।
এটা আমি এখন বলব না। এটা আমি লিখব, তবে জীবিত অবস্থায় ছাপব না। সেনসেটিভ বিষয়, তা না হলে এত আগে আমার অবসর নেওয়ার কথা নয়। অবসরের পরে আমি চট্টগ্রামের 'দি পিপল্স ভিউ' পত্রিকায় সহযোগী সম্পাদক ছিলাম। ছোটখাটো কিছু ব্যবসা করি।
১৯৭৭ সালে এসে অবসরপ্রাপ্ত কিছু অফিসারকে সিভিল সার্ভিসে নেওয়া হয়। এর পর ১৯৭৭ থেকে ১৯৯০ ঢাকা ওয়াসা, হ্যান্ডলুম বোর্ড এবং বিআইডবি্লউটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এর মধ্যে এরশাদবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। জাসদের কয়েকজন নেতা, সাংবাদিক ফয়েজ ভাই আমার বাসায়, মতিঝিল বিমান অফিসের কাছে একটি বি্লডিংয়ে আমরা মিটিং করতাম। এরশাদ পতনের ব্যাপারে কিছুটা ভূমিকা রেখেছি।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আপনি একজন উপদেষ্টা ছিলেন। ওই সময়ের কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল।
প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছয়জন সদস্যের মধ্যে আমি অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ছিলাম। এটা আমার সৌভাগ্য। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, কফিল উদ্দীন মাহমুদ, বিচারপতি খালেক, মাজেদ সাহেব, রেহমান সোবহান সাহেব আর আমি।
সম্ভবত সেক্টর কমান্ডার ছিলাম এবং আমার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে সব রাজনৈতিক দল থেকে আমার নাম গিয়েছিল। সাহাবুদ্দীন সাহেব ভালো মানুষ ছিলেন, তার সঙ্গে কাজ করে আনন্দ পেয়েছি। আমাকে দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে এসে দেখলাম, কোনো একটি দেশ থেকে অত্যধিক মূল্যে জাহাজ কেনা হচ্ছে। এতে ৩-৪ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি ছিল, আমি জাহাজ কেনা বন্ধ করে দেই।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রাণলয়ে এসে দেখলাম, ওরা বেশি দামে বিমান কিনছে। সেখানেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। আমাকে নানাভাবে অ্যাপ্রোচ করা হয়েছিল, আমি নীতি বিসর্জন দেইনি। আমাদের সুবিধা ছিল কেউ আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। আমরা প্রত্যেকেই সততার সঙ্গে কাজ করেছি।
দেশের ভালোর জন্য কাজ করেছি।
১৯৯৬ সালে আপনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ থেকে পরপর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জনগণের কাজ করতে আপনার কেমন লাগে?
যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে একবার ঢুকলাম, তখন তো আমার কিছু করার নেই। কিছু তো একটা করতে হবে। তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হই।
শৈশব থেকে সাধারণ মানুষকে নিয়েই আমার চিন্তা-ভাবনা। দেশকে স্বাধীন করব সেরকম স্বপ্ন দেখেছিলাম। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে ভালো লাগে। আমি প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছি। তবে অনেক সময় হতাশ হই, কারণ রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
'৯৬ থেকে '৯৯ সাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ দেশের ইতিহাসে আপনাকে অন্যতম সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হয়। আপনার এ সাফল্যের গোপন রহস্য কি?
আমি মনে করি সবাই সফল হতে পারবেন। কয়েকটা জিনিস মনে রাখতে হবে, যে যত বড় পজিশনে কাজ করবেন, তাকে দার্শনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। কেবল প্রশাসক নয়, একজন দার্শনিক হতে হবে।
মানুষের জীবনকে উপলব্ধি করতে হবে। শিশুর জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষাও উপলব্ধি করতে হবে। একজন মা, একজন গৃহবধূর অন্তরের আকুতি, একজন বিজ্ঞ পিতা-মাতার অনুভূতির সঙ্গে একাত্দ হতে হবে। যে কোনো ভিকটিমকে মনে হবে, এ আমার পরিবারেরই সদস্য, যার উপরে অত্যাচার-নিপীড়ন হয়েছে। আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে হবে।
এখানে কোনো দল, ব্যক্তি, আত্দীয়তা চলবে না। আমি পুলিশ বলেছিলাম, অফিসিয়ালি আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের বই তোমার মূল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই বইকে অমান্য করলে আমি ধরব। আমি আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলাম।
আপনারা যে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, তা কতখানি পূরণ হয়েছে।
আজ স্বাধীনতার বিয়ালি্লশ বছর পর এসে যা দেখছি তাতে বলব, যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম তার সবটা পূরণ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, স্বাধীনতা পেয়েছি। কেন চেয়েছিলাম স্বাধীনতা? স্বাধীনতা চেয়েছিলাম মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য, শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য, দারিদ্র্যের বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য, সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু তা তো হয়নি। অবকাঠামো হয়েছে।
শিল্পেও কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি হওয়া উচিত ছিল। গার্মেন্টের কাপড় রপ্তানির মধ্যে সন্তুষ্ট হলেই হবে না। শিল্পে উন্নতি করতে হলে ভারী শিল্পের দিকে যেতে হবে, ভারী, মাঝারি ও হালকা সব ধরনের মেশিনারি তৈরি করতে হবে। গার্মেন্টের সেলাই মেশিনটাও এখনো বানাতে পারিনি।
এই না পারার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, সম্পদের অভাব, শিক্ষার অপূর্ণতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিকল্পনাহীনতা, কাজের ধারাবাহিকতা না থাকা, জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপ দিতে না পারা প্রভৃতি অনেকগুলো কারণের কয়েকটি। এসব বিষয়ের প্রতি আমাদের সজাগ হতে হবে। কেবল একাত্তরের স্বপ্ন নয়, আজকের প্রজন্মের স্বপ্ন নিয়েও কাজ করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী করব, সেটাও বলতে হবে।
আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষা ও প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বের প্রতিযোগিতার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। জনগণকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারলেই আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হবে। গড়ে উঠবে ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, সেটাই আজ আমাদের অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আমরা অবশ্যই সফল হব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।