আমি মিথ্যাকে, অন্যায়কে সহ্য করতে পারি না । তাই আমি স্পষ্টবাদী
ভয়াবহ ব্যাধির নাম ভারতীয় সিরিয়াল। আর এর নিল ছোবলে ধ্বংষের মুখে বাংলাদেশের গোটা সমাজ । এর কুপ্রভাব থেকে রেহাই পাচ্ছেনা কোমলমতি শিশুরাও ।
কীভাবে পরিবারের অন্যকে হেনস্থা করা যায়, কীভাবে অন্যের সংসার ভাঙা যায়, বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলের কিংবা বউয়ের সঙ্গে ছেলের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা যায় তার মন্ত্র হিন্দি টেলিভিশন সিরিয়াল থেকেই আমাদের সমাজে ঢুকছে।
এবারের প্রতিমঞ্চে ভারতীয় এই টিভি সিরিয়ালের প্রভাবে আমাদের সমাজ কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তার বেশ কিছু চিত্র উপস্থাপন করা হল।
সমকালীন নাগরিক জীবনে টেলিভিশন মানেই যেন হিন্দি সিরিয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাইলেও কি, না চাইলেও কি সবাইকে এক রকম সেগুলো দেখতে বাধ্য হতে হচ্ছে। কারণ পরিবারের মা, বোন, চাচিরা এখন টেলিভিশন বলতে শুধু হিন্দি সিরিয়ালই বোঝেন।
সারা দিন রিমোট হাতে এ ধরনের ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে থাকেন।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব চ্যানেলে চলতে থাকে বিভিন্ন নামের ধারাবাহিক টিভি সিরিয়াল। আর সিরিয়ালের ফাঁদে পড়ে আমাদের নারীসমাজ পরিবার-পরিজন কিংবা সামাজিক জীবনের সাধারণ দায়িত্বগুলো থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। উপরন্তু তারা বাস্তবতা বিবর্জিত এসব সিরিয়ালের চরিত্রগুলো নিজেদের মাঝে আয়ত্ত করতে ব্যতিব্যস্ত রয়েছেন। ফলে এই সিরিয়াল থেকেই সমাজে পরকীয়া, বহুবিবাহ কিংবা বাঙালি বহু বছরের ঐতিহ্যগত চিরায়ত পারিবারিক সম্পর্কের মাঝে দেখা দিয়েছে ভাঙন।
চিত্র-১ : সন্ধ্যা ৬টা বাজে।
মিরপুরের বাসিন্দা রফিক আহমদ কেবলই অফিস থেকে ফিরেছেন। স্ত্রীর চিৎকারে ঠিকমতো ফ্রেশ হতে পারেননি। বাইরে এসে দেখলেন তাদের একমাত্র এক বছর বয়সী বাচ্চা মিমি কাঁদছে। স্ত্রী রফিক সাহেবকে বললেন বাচ্চাকে নিয়ে অন্য রুমে বসে খেলতে, কারণ স্টার জলসায় শুরু হয়ে গেছে ‘টাপুর-টুপুর’ নামের সিরিয়ালটি। আজকের পর্বটি নাকি অনেক আকর্ষণীয়, নতুন কিছু ঘটবে বলে জানান তার স্ত্রী।
অগত্যা রফিক সাহেব কথা না বাড়িয়ে মেয়ের কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
চিত্র-২ : সীমান্ত স্কয়ারে মেয়েকে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছেন ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকার গোলাম হাসান। সবার পোশাক পছন্দ হলেও তার সপ্তম শ্রেণী পড়-য়া মেয়েটি কোন পোশাকই পছন্দ করছে না। কারণ তার পছন্দ ‘ঝিলিক’ নামের একটি পোশাক, এটা ছাড়া আর কোন কিছুই সে কিনতে নারাজ।
তার এক কথা, ঝিলিক জামা লাগবেই।
হাসান সাহেব অনেকটা অসহায়ের দৃষ্টি নিয়ে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে ওই নামের পোশাকটি এখানে নেই। পোশাকটি পরে কিনে দেয়া হবে।
চিত্র-৩ : ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ আনোয়ার স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ে ইতি। প্রতিদিনই একটি বিষয় নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে তার কথাকাটাকাটি হয়। যে যত কথা বলুক না কেন ‘রাশি’ নামের একটি বাংলা এবং স্টার প্লাসের ‘শ্বশুরাল গেন্দা ফুল’ হিন্দি সিরিয়ালটি তাকে দেখতে দিতেই হবে।
পরীক্ষা কিংবা বাসা টিউটর পড়াতে এলেও সেটাতে তার মনোযোগ থাকে না। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দি সিরিয়াল দেখার কারণে এখন তাকে অধিকাংশ সময়ই হিন্দিতে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে, এমনকি সিরিয়ালের বিভিন্ন ডায়ালগ মুখস্থ করে রেখেছে। অন্যদিকে পরীক্ষার রেজাল্টে যথেষ্ট খারাপ হচ্ছে দিন দিন।
কোণঠাসা বাংলাদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেল
ভারতীয় টিভি চ্যানেলের মধ্যে স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলা, জিটিভি, স্টার ওয়ান, সনি, জি স্মাইল কিংবা ইটিভি বাংলায় প্রচারিত সিরিয়ালের অধিপত্যে বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বাঙালি নারীদের কাছে টেলিভিশন বলতে এখন এসব চ্যানেলের সিরিয়ালই বোঝাচ্ছে।
প্রায় ১৫টির বেশি বাংলাদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেল এখন প্রচারিত হচ্ছে। তবে ভারতীয় চ্যানেলের অবাধ প্রবেশ আর চাকচিক্য অনুষ্ঠানের কারণে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আর এসব চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে বিভিন্ন নামের টিভি সিরিয়াল, যার ফলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য অনেকটাই হুমকির সম্মুখীন।
ভেঙে পড়ছে সামাজিক সম্পর্ক
স্টার প্লাস, স্টার ওয়ানের এই হিন্দি সিরিয়ালের কারণে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা শহরের পরিবার গুলোতে দেখা দিয়েছে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা। টিভি সিরিয়ালগুলোর বাস্তবতা বিবর্জিত কাহিনী আর চরিত্রের মধ্যকার হিংসা-বিদ্বেষ, চক্রান্ত কিংবা অপরাধ প্রবণ বিষয় আমাদের বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে।
আগে যেখানে সন্ধ্যার পর পরিবার-পরিজনের সবাই মিলে একসঙ্গে গল্পগুজব করত, সবাই সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করত, সেখানে এখন এই হিন্দি সিরিয়াল দেখে মানুষ শিখছে কীভাবে অন্য পরিবারের ক্ষতি করা যায় কিংবা বউমা তার শাশুড়িকে বা শাশুড়ি বউমাকে শায়েস্তা করে তার নানান ফন্দি।
স্টার প্লাসের ‘শ্বশুরাল গেন্দা ফুল, ইয়েহ রিশতা ক্যা কেহ রাহে, সাথ নিভানা সাথিয়া বা প্রতিজ্ঞা নামের হিন্দি সিরিয়াল কিংবা অন্যান্য চ্যানেলের প্রচারিত এমনই সিরিয়ালের প্রকোপে পড়ে পরকীয়ার মতো ঘটনাটি সমাজে অহরহ ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
প্রতিটি সিরিয়ালে দেখানো এই পরকীয়া বা ডিভোর্সের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হচ্ছে বাঙালি নারীরা। তার পরেও সরকারিভাবে কোন ধরনের বন্ধের ব্যবস্থা কিংবা উপযুক্ত গবেষণা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সিরিয়াল
হিন্দি সিরিয়ালগুলোয় এমন সব বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে যাতে আমাদের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে।
যেমন আগে প্রতিটি পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়ায় স্টাইল ছিল ঠিক বাঙালিয়ানা, কিন্তু এখন উৎপাদন আর চাহিদার মাঝে সামঞ্জস্য থাকছে না, নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হচ্ছে হিন্দি ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাবে।
তা ছাড়া সিরিয়ালে এমন কিছু বিকৃত বিষয় উপস্থাপন করা হচ্ছে যেটি বাংলাদেশ বা বাঙালি জাতিত্বের পরিপন্থী। জি বাংলার আলোচিত সিরিয়াল ‘কেয়া পাতার নৌকা’য় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুসলিম সমাজকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই সিরিয়ালটিতে সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস বিকৃতভাবে দেখানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে এমনভাবে ছোট করে দেখানোর পরও বাংলাদেশ থেকে কোন ধরনের প্রতিবাদের ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।
তার পরও বাঙালি সর্বসাধারণ এই সিরিয়ালের প্রতি উন্মাদ প্রায়।
সিরিয়াল এখন বাজার দখল করেছে
রাজধানীর অভিজাত মার্কেটগুলো এখন ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের নায়িকা বা মডেলদের পোশাকের দখলে রয়েছে। বসুন্ধরা সিটি, সীমান্ত স্কয়ার, আলমাস শপিং কমপ্লেক্সসহ উত্তরা, ধানমন্ডি, গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার শপিংমলগুলোতে ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালের মডেলদের পোশাকের জন্য হুমড়ি খাওয়া ভিড়।
স্টার প্লাস, জি বাংলা, স্টার জলসার মতো চ্যানেলের সিরিয়ালের চাকচিক্য, খোলামেলা আর আভিজাত্যের দর্শনে বাঙালির মাঝে এক ধরনের বিলাসিতার বাসনা সৃষ্টি করেছে। এই পোশাকগুলোর দামও কম নয়, চার হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ফলে সাধারণ পরিবারগুলো যেমন বিপদে পড়ছে তেমনি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পেও দেখা দিয়েছে ধস। মাসাক্কালি, ঝিলিক, আশকারা, খুশি কিংবা প্রতিজ্ঞা নামের পোশাকগুলো এখন বাজার দখল করে রেখেছে। এমনকি এই সিরিয়াল যে চ্যানেলে প্রচারিত হয় তার নামে পর্যন্ত দোকানের নাম রাখা হয়েছে। ধানমন্ডির সীমান্ত স্কয়ারে তৃতীয় তলায় ‘স্টার প্লাস’ নামে একটি দোকান রয়েছে, যেখানে শুধুই ভারতীয় সিরিয়ালের নামকরা ব্র্যান্ডের পোশাক বিক্রি করা হচ্ছে।
সমাজ ও সংস্কৃতি গবেষকরা যা বলেন
হিন্দি টিভি সিরিয়ালগুলোর কারণে সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাঙালি মনন এবং বাংলাদেশীদের মাঝে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে।
এই টিভি সিরিয়ালের বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম লেখক, সংস্কৃতি গবেষক ফজলুল আলমের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমি এটাকে সংস্কৃতি হিসেবে দেখি না। এগুলো পণ্য।
এটাকে পণ্য হিসেবে তৈরি করে, পণ্য হিসেবে বিক্রি করে যারা ব্যবসায়ী তারাই কোটি কোটি টাকা বানাচ্ছেন। সমাজের কী হল না হল এটা নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই।
তা ছাড়া তারা এই সিরিয়ালগুলো এমনভাবে তৈরি করেন যে সবাই সেটা গ্রহণে বাধ্য হয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রায় ১৫টি টিভি চ্যানেল থাকা সত্ত্বেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না, কারণ হিসেবে টেকনিক্যাল অভাবের কথা বলেন এই সাংস্কৃতিক পন্ডিত। অনুষ্ঠান তৈরির বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য উল্লেখ করে বলেন, “অনেক দিন আগে যখন ‘আওয়ারা’ নির্মাণ করা হয়েছিল তখন সবার কথা মাথায় রেখেই সেটি নির্মাণ করা হয়েছিল। আর এখন যে সিরিয়ালগুলো তৈরি করা হচ্ছে সেগুলো শুধুই ধনীদের চাকচিক্যময় জীবন ব্যবস্থা, পোশাকের বিলাসিতা দেখানো হচ্ছে।
এগুলোই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য, সেটাই হিন্দি সিরিয়ালগুলোর অন্যতম লক্ষ্য।
” আমাদের জীবন যাপন, উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে এই সিরিয়ালগুলোর বিশাল পার্থক্য রয়েছে, সেটা সবাইকে বিবেচনা করতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। পাশাপশি সরকারেরও কিছু করনীয় থাকতে পারে । আর এই অভিশাপ থেকে বের হওয়ার এক মাত্র পথ দেশপ্রেম ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।