আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খাটাসের হাজত গমন

পৃথিবীর সবচেয়ে অমানবিক শব্দ মানবতা, মানবতা কথায় থাকে না , কাজে থাকে।

অল্প সময়ের জীবনে সবারই কম বেশি বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক ছোটতে যখন মোটামুটি বি টি ভি র রমরমা অবস্থা বিরাজমান ছিল, তখন শুক্রবারের দুপুরের বিভিন্ন বাংলা ছিনেমায় মাঝে মাঝে হিরো কে হাজত বাস করতে দেখেই না জানি কেন আমার শিশু মনে এক রাত্রি হাজত বাসের সুতীব্র আখাঙ্খার উম্মেস ঘটেছিল। যদি ও জানতাম আমার মত নিরীহ প্রানির পক্ষে সেই ছোট বেলার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী হাজত বাসের উপযুক্ত কর্ম অসাধ্য ছিল। এমন কি এমন কোন কর্মের কথা মনে আনলেও আমার প্রিয় লেডি হিটলার আমার মায়ের মুখ খানি মনে হয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে যেত।

তবু ও সৌভাগ্য বসত হোক, আর দুর্ভাগ্য বসত হোক, সু দীর্ঘকাল পর সেই মন বাসনা পূর্ণতা পেয়েছিল। তো মুল ঘটনায় আসি, এইচ এস সি পরীক্ষার পর পর কোচিং এর জন্য ঢাকায় চলে আসি। পরীক্ষা দিয়েই নিজে কে কেন যেন তিন কন্যার পিতার মত ম্যাচিউরড মনে হত। মোটামুটি একী এলাকায় আমরা প্রায় সব ফ্রেন্ড রা বাসা ভাড়া করে থাকতাম। বিকালে ঢাকার ই কোন এক লেকে আমরা সব বন্ধুরা এক সাথে বসে তুমুল আড্ডা দিতাম, আর বড় হয়ে যাওয়ার আনন্দে মনের সুখে আয়েশ করে আশেপাশের মানুষ কে দেখিয়ে দেখিয়ে সিগারেট ফুঁকতাম।

আমরা সবাই ই ক্যান্টের পোলাপান ছিলাম, তাই ছোট থেকে এক সাথে বড় হউয়ায় সবার সব কিছুই আমাদের জানা ছিল। আমাদের এক অতি উৎসাহী বন্ধু যার কোঁকরা চুলের ও গাত্র বর্ণের সম্মানে আমরা ভালবেসে ক্যারাবিয়ান বলে ডাকতাম। ক্যারাবিয়ান তখন ওর এক ভাই এর সাথে হলে থাকত। হলে বিভিন্ন বড় ভাই দের সিদ্ধি সেবনের আসরে উপস্থিত হয়ে সে জেনেছিল, যে সিদ্ধি খেলে বুদ্ধি বাড়ে। সে কি মতলবে জানি না, পরের দিন হলে তার রুম থেকে এক বড় ভাই এর কাছে থেকে একটি সিদ্ধি পূর্ণ সিগারেট চুরি করে আনল।

সেদিনের আড্ডায় সে সিদ্ধি খেলে বুদ্ধি বাড়ে সম্পর্কিত সকল জ্ঞানের বানে আমাদের জর্জরিত করে জানাল, বড় বড় কবি সাহিত্যিক রা, ঋষিমুনিরা সিদ্ধি খেয়েই সিদ্ধ পুরুষ হয়েছিলেন। অন্তত মহা মানব দের সম্মানে হলে ও আমাদের সিদ্ধি পান করা উচিত । আমাদের সবার ই সিদ্ধি বস্তুর উৎকট গন্ধ সম্পর্কে ধারনা ছিল। তাছাড়া আমরা কেউ ই মহামানব দের এমন বিচিত্র সম্মান প্রদর্শনের তাগিদ অনুভব করলাম না। আমাদের ক্যারাবিয়ান দমবার পাত্র নয়, সে একাই পাশে বসে সেই জ্ঞান ভর্তি সিগারেট এ অগ্নি সংযোগ করল।

জ্ঞান পোড়া উৎকট বিচ্ছিরি গন্ধে আমরা দু হাত করে সরে গেলাম। সে একাই মহা উৎসাহে জ্ঞানবান হতে লাগল। আমরা তিন জন ছিলাম, ক্যারাবিয়ানের বাম পাশে। আর সবাই ডান পাশে। হঠাত কিছু বেরসিক জন গনের বন্ধু পুলিশ, শত্রু সুলভ ভঙ্গিতে পেছন থেকে আমাদের চার জনের কলার চেপে ধরল, যদি ও আমরা তিন জন কিছুটা তফাতে ছিলাম, তবু ও কিভাবে যেন পুলিশ গুলো বুঝে ফেলল আমরা একই পালের গরু।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমার অন্য সকল বন্ধুরা ছুটে পালাল। আমি বিমর্ষ নয়নে আমাকে ধরে থাকা পুলিশ ভাই কে বললাম, “ আঙ্কেল কলার টা ছেড়ে দিন, আমি পালাব না। “ আমার এমন বন্ধুত্ব পূর্ণ আচরনের জবাবে কিছু মন মুগ্ধকর গালির মালা উপহার পেলাম, সাথে তিনি আমার কলার আরও ভালবেসে (?) চেপে ধরলেন। আমি মন কষ্টে ভাবতে লাগলাম, যে মূর্খ মানব পুলিশ কে জনগণের বন্ধু উপাধি দিয়েছেন, তিনি নিশ্চয় ই সিদ্ধি পান করেন নি বলে তাঁর জ্ঞানের ঘাটতি ছিল। সিদ্ধি জ্ঞানের ঘর কত খানি আলোকিত করে জানি না, কিন্তু অনুভুতির বাগান কে সম্ভবত রঙ্গিন করে দেয় তা বুঝলাম ক্যারাবিয়ান কে দেখে।

পুলিশ ভাই টি ক্যারাবিয়ানের কলার আর কোমরে প্যান্ট শক্ত করে ধরেছিল। ক্যারাবিয়ান সকল কে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল, “ আঙ্কেল ছাড়ুন না, কাতু কুতু লাগছে। “ এমন পরিস্থিতিতে ও মাত্র সবাই হাসার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিলাম, হঠাত এক বিরল ঘটনা ঘটে গেল। ক্যারাবিয়ান পুলিশ কে ধাক্কা দিয়ে একটু সামনে দৌড় দিল। ছোট তে শিশুদের যেন নজর না লাগে, সে জন্য কপালে কাল টিপ দিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু সৌভাগ্য বসত ক্যারাবিয়ানের সমগ্র অঙ্গেই স্রস্থা প্রদত্ত টিপ বর্ণ থাকা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্য বসত কার জানি নজর লেগে গেল। একটু সামনেই ইহা দেহ নিয়ে বিরাট এক পুলিশ তাঁকে ধরেই ঠাস ঠুস শব্দে লেক প্রকম্পিত করে ফেলল। লেকের সবাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছিল। আমরা ও মজা নিয়ে দেখছিলাম। আমার বেশ ভাল লাগছিল, এই ক্যারা বিয়ান ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার সময় আমাকে একটা প্রস্ন দেখায় নি।

এই দুঃখ মুলক পরিস্থিতিতে আমার প্রতিশোধ পরায়ণ স্রিতি চারনের আনন্দ মুলক প্রাপ্তির মুহূর্তে হঠাত করে এক উদ্ভট বাঙালির উদয় হল। সে এসে ক্যারা বিয়ান কে উত্তম মধ্যম দান রত পুলিশ ভাই টিকে বলল, “ স্যার আরও লাগান... এই হালা গো অত্যাচারে বইতারিনা । ভাল কইরা লাগাইলেই দেখবেন কইয়া দিব কই থিকা আর কি কি নিছে ” আমার পিলে চমকে উঠল কি সাংঘাতিক ওই উদ্ভট পাবলিক কি হয়েছে কিছু না শুনেই আমাদের ছিনতাইকারী ভেবেছে। মেজাজ টা বিগ্রে গেল। বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, “ বেকুবের বাচ্চা তুই জ্ঞানের পথিক কে ছিনতাইকারী বানিয়ে দিলি না জেনে।

আর আমাদের দেখে তোর ছিনতাইকারী মনে হয় ??? ” উদ্ভট টা আমার মনের প্রস্ন কিভাবে বুঝল জানি না, সে বলল, “ ভালা ঘরের পুলা পাইন ই আইজকাল এসব করে । ” আমি শোকে পাথর হয়ে গেলাম। এদিকে ক্যারা বিয়ান যাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, তাঁর হাত ছিলে গেছে, তাই প্রতিশোধ নিতে সেও যেয়ে ক্যারা বিয়ান কে দস্যু বনহুর টাইপ হাসি দিয়ে উত্তম মধ্যম দেয়া শুরু করল। মাইরের স্পীডে আর ক্যারা বিয়ানের হাউ কাউ তে আমার কলিজা শুকিয়ে আসছিল। কিন্তু আমি ভাবলাম, আমি ভয় পাব কেন? আমি তো কিছু করি নি।

এর ই মধ্যে ক্যারা বিয়ানের গলার আওয়াজে আমার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল । “ আঙ্কেল আমি এস এস সি তে গোল্ডেন এ+ পেয়েছি। এবার ও পাব আশা রাখি। ” ক্যারা বিয়ানের এমন মহান অর্জন ও ভবিষ্যৎ অর্জনের সমূহ সম্ভাবনায় ওই ইয়া আকার পুলিশ টির রেগে যাওয়ার কারন বুঝলাম না। সে টম জেরি কার্টুনের মত ক্যারা বিয়ানের গলা ধরে ঝাঁকাতে লাগল, সাথে পশ্চাৎ দেশে লাথি তো আছেই।

ক্যারা বিয়ানের কাঁদাকাটি কিছুটা হাই স্কেল আবার লো স্কেলে যাচ্ছিল। স্কেলের মাত্রা বুঝে লাথির স্পীড টা অনুমান করতে পারছিলাম। ইতি মধ্যে পুলিশের ভ্যান এসে সামনে থামল দুই টি। এতক্ষণ ছোট বেলার সুতীব্র আকাঙ্খা পুরনের পথে প্রথম পর্যায় সম্পন্ন হউয়ার আকস্মিকতায় আশে পাশে কি হল খেয়াল করি নি। পিকাপে প্রায় ১২ জোড়া কপোত কপোতীর সাথে আমাদের দুইটি পিকাপে ভরা হল।

আমি বসলাম, পিকাপের দরজার কাছে। আমার পাশে ক্যারা বিয়ান আর তাঁর পাশে আমার দুই বন্ধু। বেচারা ক্যারা বিয়ান খুব ভাল ছেলে। এমন মাইর ও জীবনে খায় নি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, আর বলছিল, “ আমি শেষ আব্বু।

আমার আর ইঞ্জিনিয়ার হউয়া হল না। ” আমার কলিজা কাঁপলে ও কেন জানি খুব মজা লাগছিল। আমি ওকে বললাম , “ চুপ কর হারামজাদা । সিদ্ধি খা। ইঞ্জিনিয়ার হউয়া লাগব না।

মহা পুরুষ হয়ে থাক। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার রা তোর দোয়া নিয়া যাইব। ” আমার এমন কথায় ক্যারা বিয়ান আবার কাঁদতে লাগল, আর এই পরিস্থিতিতে ও পিকাপের সবাই হেসে উঠল। এক পুলিশের গলায় তাকালাম, “ দেখছেন স্যার, পুলিশের পিকাপে বইসা ও হাসে। মনে হয় পিকনিক খাইতে যাইতেছে ।

এক দফা দিয়া দেই। ” সাথে সাথেই বিকট কান্নাকাটিতে তাদের পায়ের দিকে তাকালাম। দেখি চারজন ছেলে, আমাদের বয়সী এবং ভদ্র বলেই বোঝা যায়, পুলিশের অফিসার এর সম্ভবত পায়ে পড়ে কান্না কাটি করছে। ওই অফিসার বিরক্ত হয়ে অন্যদের বলল, “ আজে বাজে কথা বাদ দিয়ে, এখন এই চার টাকে তারাতারি গাড়িতে তুলে গাড়ি ছাড়। ওই চার জন ছেলের একজন কে থাপ্রা একটা দিতেই সবাই সুবোধ ছেলের মত গাড়ি তে এসে বসল।

সাথে সাথে দুইটা পিকাপ এক সাথে ছেড়ে দিল। আমি এক টা দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিলাম। যাক, এত দিন পরেও স্বপ্ন পুরন হল। দুটি কথা ঃ ১ মাদক কে না বলুন, মাদক থেকে দূরে থাকুন। ২ গায়ের রঙ দিয়ে মানুষ এর সৌন্দর্য বিচার করা সভ্য মানুষের শোভা পায় না।

ক্যারা বিয়ান কাল হলেও অনেক স্মার্ট। আর সে এখন একটা ভাল জায়গায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। প্রকৃত স্মার্ট নেস মানুষের মনে, বেক্তিত্তে ও কাজে। এই গল্প কে বাস্তব বা অবাস্তব দুটোই মনে করতে পারেন। অনেক বড় গল্প তাই আজ আর বাড়ালাম না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.