আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

Memories of Murder 2003 / Joon-Ho Bong

mail.aronno@gmail.com

গত কয়েক মাস একটানা সাউথ কোরিয়ান সিনেমা দেখতে গিয়ে বারবারই মনে হচ্ছিল, নির্দিষ্ট কোনো সাউথ কোরিয়ান সিনেমা নয়, বরং বিগত এক যুগে সাউথ কোরিয়ান নিউওয়েভ সিনেমার সার্বিক যে বিকাশ তা নিয়েই লেখা উচিত, আর এই বিকাশে গত এক যুগে সাউথ কোরিয়ানরা মুভি মেকিংয়ের যে অভাবনীয় সম্ভাবনা নিয়ে উঠে এসেছে, তা এক কথায় বিস্ময়কর, আর সারা পৃথিবী জুড়ে আমার মতো এমন অসংখ্য সিনেমাপ্রেমি আছেন, যারা হয়ত প্রতিনিয়ত মুখিয়ে থাকেন নতুন কোনো কোরিয়ান সিনেমার মুক্তির দিকে, কেন না যারা ইতিমধ্যেই সাউথ কোরিয়ান সিনেমার ভক্ত হয়ে পড়েছেন, তারা জেনে গেছেন, সাউথ কোরিয়ান পরিচালক ও কাহিনীকাররা গতানুগতিক ধারার বিশ্বসিনেমায় নতুনতর এমন মাত্রা সংযোজন করে চলেছেন, যেখানে মুভি মেকিংয়ের সবক্ষেত্রেই তারা সক্ষম হয়েছেন তাদের মেধা ও সৃজশীলতার ব্যতিক্রমী ও অনুকরণীয় উদাহরণ তুলে ধরতে, আর দর্শকরা একদিকে যেমন মুগ্ধ হচ্ছেন, তেমন-ই আকর্ষিত হচ্ছেন বেশি করে। প্রায় প্রতিটি সিনেমাতেই কাহিনীর ব্যতিক্রমধর্মী বিকাশ আর সুদক্ষ অভিনয় শৈলীর স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ, দর্শককে গল্প বা ঘটনার মধ্যে এমনভাবে টেনে নিয়ে যায়, যা কিনা খুব ধীর গতিতে বিবশ করতে থাকা ভয়াল নেশার মতো এবং সম্পূর্ণরূপে দখল করে নেয় অনায়াসেই। নির্বাক সিনেমার সময় থেকে শুরু করে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়ে সাউথ কোরিয়ান সিনেমা মূলতঃ তেমন কোনো রিমার্কেবল কিছু দিতে ব্যর্থ হলেও, ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সিরি’ সিনেমাটির অভূতপূর্ব বক্স অফিস সাফল্য যেন সাউথ কোরিয়ান মুভিকে দিল নতুন রূপ ও বিকাশ, আর তারপরই তারা হুট করে প্রবেশ করল নতুন এক সিনেমা যুগে, যেখানে মাত্র ১৪ বছরেই তারা কেবল নিজ দেশ বা এশিয়ায় নয়, সমগ্র বিশ্বকেই দেখিয়ে দিল, মুভি মেকিং কীভাবে উৎকর্ষতায় শীর্ষে পৌঁছাতে পারে, আর তখন প্রমাণ স্বরুপ আমাদের সামনে উঠে আসে অসাধারণ কিছু কোরিয়ান সিনেমার নাম, যা আমাদের কেবল বিনোদন-ই দেয়নি,বরং নিউ ওয়েভ সিনেমার সাথে এমনভাবে পরিচয় ঘটিয়েছে, যেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের বলতে বাধ্য হয়েছি, ‘এমনটা আগে দেখিনি’, আর যেসব সাউথ কোরিয়ান সিনেমা আমাদের চমকে দিয়েছে ভীষণভাবে, ‘মেমোরিজ অব মার্ডার’ সেসবের অন্যতম। মূলতঃ, সমসাময়িক ক্রাইম থ্রিলার মুভি নিয়ে কথা বলতে গেলেই ‘মেমোরিজ অব মার্ডার’ সিনেমাটির নাম উঠে আসে অনিবার্যভাবে, কেননা ক্রাইম থ্রিলার জেনর-এ বিশ্ব সিনেমা যত মুভি আজ অব্দি পেয়েছে, নিঃসন্দেহে এই সিনেমাটি উল্লেখযোগ্য, কারণ সিনেমাটির একদম শেষ দৃশ্যে না পৌঁছে বোঝা যায় না যে, পরিচালক আসলে আমাদের এই জেনরের স্বভাবজাত বিকাশকে তার স্বরপে রেখেই মূল বিকাশকে কেবল ভিন্নখাতে প্রবাহিতই করেননি, বরং জেনরের সাথে যথাযথ সুবিচার করে সমান্তরালভাবে কাহিনীর কেন্দ্রিকতা এমন দিকে প্রবাহিত করেছেন, যেখানে আমার বুঝতেই পারি না যে, এটা নিতান্তই খুন বা খুনির কাহিনী নয়, বরং খুনের রহস্য উদঘাটন ও খুনিকে ধরার জন্য কাজ করতে থাকা গোয়েন্দাদের নানাবিধ মানসিক টানা-পোড়েনের গল্প, যা আগে দেখানো হয়নি, এভাবে। তাছাড়া এমন একটি সিরিয়াস ক্রাইম থ্রিলারের মধ্যে তিনি অনায়াস ঢুকিয়ে দিয়েছেন বিদ্রুপের মতো শক্তিশালী একটি বিষয়, যেখানে একই সাথে যেমন তৎকালীন ভঙ্গুর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, অপ্রতুল প্রসাশনিক সুবিধাদি এবং অদক্ষ ও করুণ আইন ব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তেমন-ই চরিত্রগুলোর সামাজিক ও মানসিক অবস্থানও বর্ণনা করা হয়ে দক্ষভাবে, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে লাশের শরীরে পাওয়া খুনির স্পার্মের নমুনার ডিএনএ টেস্ট করার মতো সুবিধাদি কোরিয়ায় না থাকার উল্লেখ এবং তা আমেরিকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত দিয়ে।

সিনেমাটি ১৯৮৬ সালে কোরিয়ায় সামরিক শাসনামলে একটি সিরিয়াল কিলিং-এর সত্য ঘটনার উপর নির্মিত, যেখানে খুনি একের পর এক নারীদের ধর্ষণ ও খুন করে লাশের মুখ প্যান্টি দিয়ে ঢেকে রেখে যায়। সিনেমাটি শুরু হয় গ্রামাঞ্চলে এমন-ই একটি ঘুনের ঘটনা দিয়ে, যেখানে কৃষিক্ষেতে পানি চলাচলের কালভার্টের নিচে একটি নারীর লাশ পাওয়া যায়, যাকে ধর্ষণ করার পর হাত-পা বেঁধে মাথায় প্যান্টি জড়িয়ে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছে। এরপর তদন্ত শুরু হয় এবং প্রাথমিক তদন্তের শুরু থেকেই সিনেমাটি বিদ্রুপ হিসেবে ধরা দেয় আমাদের কাছে, যেখানে লাশের প্রাথমিক অবস্থানে মানুষের যততত্র বিচরণ, গ্রামবাসীর ভীড়, নিযুক্ত তদন্ত কর্মকর্তাদের অদক্ষতা বা ফরেনসিক টিমের আসতে দেরী হওয়া্, ঘটনাস্থলে বিদ্যমান খুনের নমুনাসমূহের নষ্ট হয়ে যাওয়া, সবকিছু আমাদের সামনে হাজির হয় তৎকালীন কোরিয়ান শাসন ব্যবস্থার প্রতি বিদ্রুপ হিসেবে, আর এই বিদ্রুপকে সার্থক রূপ দিতে যিনি বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন, তিনি কাঙ-হো-সাঙ, যার কথা হয়ত নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না এবং যারা চান-অক-পার্কের বিখ্যাত ভিজেন্স ট্রিলজির ‘সিমপ্যাথী ফর মিস্টার ভিজেন্স (২০০২) দেখেছেন, তারা হয়ত কোনোদিনই ভুলবেন না এই অভিনেতার অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার কথা, আর আধুনিক সাউথ কোরিয়ান মুভিতে তিনি ইতিমধ্যেই যা সংযোজন করেছেন, তা কোরিয়ান সিনেমা স্মরণ রাখবে বহুকাল। মূল তদন্তকারী অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করা কাঙ-হো-সঙ-এর স্বভাবজাত শক্তিশালী অভিনয় এক কথায় অনবদ্য, আর ব্যক্তিগতভাবে স্ক্রীনে সবসময়ই তাকে আমার মনে হয়েছে সাবলীল আর স্বতস্ফূর্ত, যা তাকে বর্তমান সময়ে জীবিত অভিনেতাগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এই সিনেমায় তাকে তুলে ধরা হয়েছে একজন অদক্ষ, অযোগ্য ও কম শিক্ষিত তদন্তকারী অফিসার হিসেবে, যেখানে সে খুনের বিষয়টি সুরাহা করার জন্য গ্রামের এ্যাবনরমাল মানুষগুলোকে প্রাথমিক সন্দেহের তালিকায় নেয়, এমন কী পাগল একজনকে ধরে এনে জোরপূর্বক চেষ্টা করে খুনের দায় স্বীকার করতে, কিন্তু, তার কোনো প্রয়াস-ই সফল না হওয়ায় এক পর্যায়ে খুনিকে ধরার জন্য আধ্যাত্মিক মহিলার শরণাপন্ন হয়, অথচ তার সব রকম প্রচেষ্টাই ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয় এবং ক্রমশঃ ভেতরে ভেতরে মরিয়া হয়ে উঠে।

অপরদিকে তাকে সহায়তা করতে সিউল থেকে আসা সুশিক্ষিত তরুণ অফিসার চরিত্রে অভিয়ন করা সাঙ-কিয়ুন-কিন, যে কিনা অপেক্ষাকৃত অধিক দক্ষতার সাথে চেষ্টা করে খুনের রহস্য উদঘাটন করতে, কিন্তু শেষ অব্দি সেও ব্যর্থ হয়, এবং দু’জন অফিসারই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, যা পরিচালকের খুন বা খুনি নয় বরং খুনের রহস্য উন্মোচনের জন্য সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মানসিক টানাপোড়েন, মরিয়া প্রয়াস, ব্যর্থতা, উৎকন্ঠা, হতাশা ইত্যাদি বিষয়ের দিকে সিনেমাটির মোড় ঘুরিয়ে দেবার প্রয়াসকে ষোলআনাই সফল করেছে। মূলতঃ সিনেমাটির প্রতিটি চরিত্রই যেন তাদের অভিনয় দক্ষতার সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়েই হাজির হয়েছেন আমাদের সামনে এবং এই বিশেষ ব্যাপারটি প্রায় সব কোরিয়ান সিনেমাতেই দারুনভাবে বর্তমান, যেখানে অভিনয় শিল্পীরা সবসময়ই তাদের সেরাটি উপহার দিচ্ছেন, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে, অল্প সময়ের জন্য পর্দায় হাজির হওয়া সন্দেহভাজন খুনী হিসেবে প্রেফতারকৃত গ্রামের সাদাসিধে পাগল টাইপের চরিত্রে অভিনয় করা নো-শিক-পার্ক অথবা অপর সন্দেহভাজন খুনী চরিত্রে রিউ-তে-হো -এর অভিনয়, আর এখানেই কোরিয়ান সিনেমাগুলো সবসময়-ই একধাপ এগিয়ে থাকে তাদের সার্বিক বিকাশে। একজন দক্ষ পরিচালক সবসময়-ই তার সিনেমার কাহিনী নিজেই পরিমার্জন করেন, আর যখন পরিচালক নিজেই হয়ে পড়েন কাহিনীকার, তখন সিনেমাটি যেন তার নির্মাণ ও বিকাশে হয়ে উঠে তাৎপর্যপূর্ণ, আর সেজন্যই হয়ত জোন-হো-বঙ ক্ষেত্রে এমন একটি সিরিয়াস ক্রাইম থ্রিলার কাহিনীর মধ্যে দারুণ বিদ্রুপ ঢুকিয়ে দেয়া, চরিত্রগুলোকে সেই বিদ্রুপের মধ্যে অসহায় অথচ অধিক সিরিয়াস করে তোলা এবং কোনোভাবেই মূল থিম বা সিরিয়াসনেস থেকে সরে না আসা, এই বিশেষ চ্যালেঞ্জগুলো হয়ে উঠেছে সহজতর। গতানুগতিকভাবে আমরা যেসব ক্রাইম থ্রিলার মুভি দেখে থাকি, তাতে খুনি বা যে খুন হয় কিংবা খুনের জন্য সমাজ, পরিবার তথা সার্বিক জীবন পরিস্থিতিতে যেসব বিরূপ পরিস্থিতির অবতারণা হয়, সেদিকেই কাহিনী নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে, অথচ জোন-হো-বঙ সে পথে না এগিয়ে আমাদের সম্পূর্ণরূপে চমকে দিয়ে এগিয়েছেন ভিন্ন পথে, যখন আমরা পুরো সিনেমা জুড়েই ভাবছিলাম যে আমার এগিয়ে যাচ্ছি খুনির দিকে, কাম্য পারিণতির দিকে, অথচ সিনেমাটির শেষ দৃশ্য জানিয়ে দিল, আসলে আমরা এতক্ষণ যা দেখছিলাম সেটা ছিল খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ত দু’জন তদন্তকারী অফিসারের সার্বিক মানসিক পরিস্থিতির সুচারু বিবরণ। জোন-হো-বঙ-এর সিনেমাটিক বিউটি আমাকে চমকে দিয়েছিল ২০০৮ সালে নির্মিত ‘টোকিও’ সিনেমাটি দেখার পর এবং সেটি আজও আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে।

তারপর ২০০৬ সালে নির্মিত ‘দ্য হোস্ট’, ২০০৯-এ ‘মাদার’ , আর সবশেষ ‘মেমেরিজ অব মার্ডার’, যা ইতিমধ্যেই তাকে মুভি মেকিং জিনিয়াস হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে এবং অনিবার্যভাবেই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছেন আধুনিক সাউথ কোরিয়ান সিনেমার। তার মুভি নির্দেশনার যে বিষয়টি সবসময়-ই আমাকে মুগ্ধ করে, তা হলো অনবদ্য সিনেমাটোগ্রাফি, যা কিনা তার নিজস্ব ট্রেডমার্কগুলোর অন্যতম এবং এই সিনেমাতেও একদম শুরুর দৃশ্য থেকেই দেখা যাবে এমন কিছু অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, যার দরুন কেবল সিনেমা নয় বরং পরিচালকের জন্যও প্রশংসার বৃহদাংশ বরাদ্দ হয়ে যাবে আপনা-আপনি। ‘মেমোরিজ অব মার্ডার’ নিঃসন্দেহে গত কয়েক দশকে বিশ্ব সিনেমায় সংযোজিত গুরুত্বপূর্ণ সিনেমাগুলোর মধ্যে একটি এবং পরিচালক জোন-হো-বঙ-কে আমরা দীর্ঘ দিন স্মরণ রাখব এই সিনেমাটির কারণেই। অরণ্য ঢাকা, বাংলাদেশ ২২.১২.১৩

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।