আমরা প্রায় দীর্ঘদিন ধরে বিবর্তন শব্দটির সাথে পরিচিত । বর্তমানে এই শব্দটির অর্থ একেক জনের কাছে একেক রকম । চার্লস রবার্ট ডারউইন তাঁর বিখ্যাত বই “ The Origin of the Species (1859) ”-এ বিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নৈর্বচনিক মতবাদকে উপস্থাপিত করেছেন । তাঁর মতে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে বানর জাতীয় মানুষ (এইপ) থেকে । আর ধর্মতত্ত্ব মতে, মানুষ এসেছে আদম-ইভ্ কিংবা মনু-শতরূপা থেকে ।
যে যাই বলুক না কেন ডিএনএ তত্ত্ব আবিষ্কারের পর আজ মানব অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচিত হতে যাচ্ছে । শুধু মানব অস্তিত্বের ইতিহাসই নয় বর্তমানে এমন কোন ক্ষেত্র নাই যেখানে ডিএনএ তত্ত্ব কার্যকরী হয় না । ১৮৬৮ সালে ফ্রেডরিক মীসার নামে একজন তরুণ সুইডিশ চিকিৎসক শীতকালে টুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে “ফেলিক্স হোপ ছেইলার ” নামক ল্যাবরেটরিতে শ্বেত রক্ত কনিকার উপাদানের উপর গবেষণা করতে গিয়ে ডিএনএ-এর অস্তিত্বের সন্ধান পান । পরবর্তিতে আমেরিকান আণবিক বিজ্ঞানী জেমস ডি ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক ওয়াটসন ও মরিস ভিকিনছ একসাথে গবেষনা চালিয়ে ১৯৫৩ সালে ডিএনএর উপাদান আবিস্কার করেন । প্রাণি জগতের সমস্ত জেনেটিক কোড ধরে রাখে এই ডিএনএ যাকে আমরা জিন (Gene) বলে থাকি ।
ডি এন এ (Deoxyribo nucleic acid) মূলত অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, এবং হাইড্রোজেন দ্বারা গঠিত মাইক্রোমলিকিউল । এটি একটি নিউক্লিক এসিড যার মাঝে বংশ বিস্তার, জীবের বেড়ে ওঠা এবং তার সম্পর্কে যাবতীয় সকল তথ্য (জেনেটিক ইনফরমেশন) জমা থাকে । ডিএনএ যে কোন জীব কোষের নিউক্লিয়াস এবং সামান্য পরিমাণে মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট-এ সঞ্চিত থাকে । নিউক্লিয়াসের মাঝে যে ডিএনএ থাকে তাকে নিউক্লিয়ার ডিএনএ (nuclear DNA) আর মাইটোকন্ড্রিয়ার মাঝে অবস্থিত ডিএনএ কে মাইটোকড্রিয়াল ডিএনএ (mtDNA) বলা হয় ।
কী এই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (mtDNA) ? কিংবা মানবের আদি পুর্বপুরুষ নির্ধারনে এর ভূমিকাই বা কী ? এই mtDNA-র কাজ কি ? এ ধরনের প্রশ্ন আমাদের মনে আসাটা স্বাভাবিক ।
ডি এন এ কে আমাদের বংশ বিস্তারের নীল নকশা বলতে পারি । ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর মিশ্রণের সময় শুক্রাণু -এর (mtDNA) বাদ যায় এবং শুধু মায়ের (mtDNA) এতে স্থান পায় । তবে nuclear DNA অপরিবর্তিত থাকে । এভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করে আমরা যে কার সাথে আমাদের আদি পূর্ব পুরুষের পরিচয় মিলাতে পারি । তাহলে দেখা গেল যে, mtDNA আসে মাতৃ-ডিম্বানু থেকে আর মায়ের mtDNA আসে তাঁর মায়ের কাছ থেকে ।
প্রতিটি জীবের দেহ লক্ষ লক্ষ কোষ দিয়ে গঠিত আর প্রত্যেকটি কোষে আছে মাইটোকন্ড্রিয়া নামের শক্তি উৎপন্নকারী কিছু অঙ্গাণু । এই “পাওয়ার হাউজ” নামে খ্যাত মাইটোকন্ড্রিয়াতে রয়েছে কিছু গোলাকার ডিএনএ । জীবের বেশির ভাগ কোষে (৫০০ থেকে ১০০০ সংখ্যক) mtDNA মলিকিউল এর প্রতিরুপ ধারন করে যা মানুষের আদি বৈশিষ্ট্য (নিউক্লিয়ার ডিএনএ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকেও) নির্ধারণে আরো অধিক সহজে সাহায্য করে । মানুষের দেহে mtDNA জিনোম প্রায় ১৬০০ সংখ্যক Base Pairs দিয়ে গঠিত । পাশের গোলাকার চিত্রটি দেখে অনেকে প্রশ্ন করতে পারে যে, mtDNA এর গঠন কেন এমন ? বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীব কোষে অবস্থিত মাইটোকন্ড্রিয়া লক্ষ-কোটি বছর আগে একধরনের ব্যাক্টেরিয়া ছিল যা জীব কোষ দ্বারা ভক্ষিত হয়েছে এবং জীবনের তাগিদে এটি কোষের সাইটোপ্লাজমের মধ্যে স্থায়ী ভাবে অবস্থান নেয় ।
এটি কোষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি (ATP) উৎপাদন করে আর বিনিময়ে কোষ তাকে সুরক্ষা প্রদান করে । এতে করে তাদের মধ্যে একধরনের সিমবায়োটিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । ব্যাক্টেরিয়া একধরনের প্রোক্যারিওটিক বা আদি কোষ । তাই আদি কোষ হিসেবে mtDNA এর মধ্যে ঐ ধরনের গঠন বিদ্যমান । তাছাড়া “এনডোসিমবায়োটিক হাইপোথিসিস” প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে , ব্যাকটেরিয়ার DNA ও মাইটোকন্ড্রিয়াল DNA এর মধ্যে একটি সাধারণ সাদৃশ্য রয়েছে ।
ধারনা মতে তাদের উভয়ের উৎপত্তিকাল ১.৭ বা ২ বিলিয়ন বছর আগে । অর্থাৎ, প্রায় আদি কোষ শ্রেণিভুক্ত । যাই হোক, আমরা এখন মানুষের পূর্বপুরুষ নির্ধারণে mtDNA কি ধরণের ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে আলোচনা করব ।
বর্তনামে মানুষের অস্তিত্বের ইতিহাস জানার জন্য অনেকে জোর দিচ্ছেন ফসিল (জীবাশ্ম) গবেষণার উপর । এক্ষেত্রে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে mtDNA বা মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ।
বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন গুহা থেকে প্রাচীন কঙ্কাল, দাঁত,হাড় ইত্যাদি সংগ্রহ করে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাচীন মানব-অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে । ২০০৮ সালে রাশিয়ার “Institute of Archaelogy and Erthnology of Novosibirsk” -এর প্রত্নতত্ববিদরা সাইবেরিয়ার আল্টাই পর্বতের মধ্যে ডেনিসোভা নামক গুহা থেকে হোনিড ( দুই পায়ে ভর করে চলন্ক্ষম) প্রজাতির এক মেয়ের (প্রায় ৪১০০০ বছর পূর্বের ) আঙ্গুলের হাড় ও আক্কেল দাঁত সংগ্রহ করেন এবং mtDNA বিশ্লেষণের মাধ্যমে মেয়েটিকে X-woman নামে আখ্যায়িত করেন ।
ডেনিসোভায় প্রাপ্ত মানব কঙ্কাল গুলোকে “ডেনিসোভান” প্রাণি হিসেবে নামকরণ করেন । অপরদিকে “নিয়ানডার্থাল” নামের একটি জীবাশ্ম-নৃতাত্ত্বিক প্রজাতি প্লাইস্টোসিন যুগে বসবাস করতো । তাদের আবাসস্থল ছিল ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলে ।
প্রায় ৬০০,০০০ - ৩৫০,০০০ বছর আগে ইউরোপে প্রথম প্রাক-নিয়ানডার্থাল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে । গবেষকদের মতে প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর পূর্বে নিয়ানডারথাল ও ডেনিসোভানরা আফ্রিকা ছেড়ে চলে যায় । নিয়ানডারথাল-রা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পাড়ি দেয় । অন্যদিকে ডেনিসোভানরা পূর্ব দিকে যায় । প্রায় ৫০ হাজার বছর পূর্বে তারা যখন এশিয়ার দক্ষিণ উপকূলের দিকে সরে যায় তখন অন্য মানবদের সঙ্গে প্রজনন ঘটে ।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ডেভিস রিচ বলেন, ডেনিসোভানরা সম্ভবত এশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে এসেছে । কিছুদিন আগে ব্রিটিশ সাময়িকী “Nature”-এর বিজ্ঞানীরা কঙ্কাল নিয়ে নতুন এক ধরনের তথ্য দিয়েছেন যে, মানবজাতির আদি পুরুষ বলে পরিচিত নিয়ানডারথাল মানবের অজ্ঞতানামা এক প্রজাতি আবিষ্কার করেছে । ধারণা করা হচ্ছে, এরা ৩০-৫০ হাজার বছর পূর্বে এশিয়ায় অবস্থান করেছিল । ডেনিসোভান নামে পরিচিত মানবজাতি এই পূর্বপুরুষদের জিন কাঠামো শনাক্ত করতে বিজ্ঞানীরা ডেনিসোভা গুহায় প্রাপ্ত হোনিড প্রজাতির মেয়ের আঙ্গুলের হাড় ও আক্কেল দাঁত ব্যবহার করেছিল । উল্লেখ্য, বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র এই আঙ্গুলের হাড় ও আক্কেল দাঁত ব্যবহার করে গোটা ডেনিসোভান সম্প্রদায়ের জিন কাঠামোটি শনাক্ত করতে সক্ষম হন ।
সম্প্রতি আরো একটি আলোচিত খবর বেরিয়ে এসেছে যে, জার্মানীর “Max Planck Institute for Evolution Anthropology”–এর প্রাচীন DNA গবেষকরা স্পেনের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত “Sima de los Huesos” নামক একটি গুহা থেকে হোমো গণের অন্তর্ভুক্ত প্রায় ৪০০০০০ বছরের পুরনো একটি কঙ্কাল আবিষ্কার করেন এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোমের একটি পূর্নাঙ্গ অনুক্রম খুঁজে পান যা ডেনিসোভানদের মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোমের সাথে পুরোপুরি মিল । এই গুহাতে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন প্লাইস্টোসিন যুগের “হোমিনিন ফসিল” -এর এক বিশাল সংগ্রহ মাটিচাপা রয়েছে । জুয়ান লুইস আরসুয়াগা -এর নেতৃত্বে স্পেনের একদল জীবাশ্ম বিজ্ঞানী দীর্ঘ দুই দশক ধরে পরিশ্রম করে প্রায় ২৮টি মানব ফসিল উদ্ধার করেন । এই ফসিলগুলোকে Homo heidelbergensis -এ নামকরণ করা হয় এবং এগুলোর সাথে নিয়ানডার্থালদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মিল খুঁজে পাওয়া গেছে । তবে এখনো এদের অরিজিনাল ডিএনএ গত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় নি ।
এদিকে “Max Planck Institute for Evolution Anthropology”–এর গবেষক ম্যথিয়াস মিয়ার ও তার দল পরিত্যক্ত প্রাচীন DNA উদ্ধার ও সিকোয়েন্স করার নতুন কৌশল আবিষ্কার করেন । পরবর্তিতে স্ব-দলে যোগ দেন জুয়ান লুইস আরসুয়াগা এর সাথে এবং Sima-গুহাতে গিয়ে হোমিনিনের উরুর হাড় থেকে দুই গ্রাম হাড়ের গুঁড়া নেন এবং এ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে mtDNA এর জিনোম অনুক্রমিত করেন । পরবর্তিতে ডেনিসোভান, নিয়ানডার্থাল, আধুনিক মানুষ ও বানরের mtDNA-এর সাথে তুলনা করা হয় । ম্যথিয়াস এর মতে সাইমা গুহাতে প্রাপ্ত হোমিনিন-এর mtDNA এর সাথে ডেনিসোভানদের mtDNA এর মিল খুঁজে পাওয়া যায় । অপরদিকে নিয়ানডার্থাল-জাত বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয় ।
সুতরাং এদের বয়স ও বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায় সাইমা-হোমিনিনদের সাথে ডেনিসোভান ওনিয়ানডার্থাল দের মধ্যে সাধারণ পূর্বপুরুষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান ।
“Max Planck Institute for Evolution Anthropology”–এর পরিচালক Svante Paboo বলেন, “আমাদের এ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ডিএনএ গবেষণা আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে । বর্তমানে আমরা মানব জাতির হাজার বছরের ইতিহাস জানতে সক্ষম হব । এই গবেষণার মাধ্যমে ডেনিসোভান ও নিয়ানডার্থাল গোষ্ঠীর হোমিনিন দের লক্ষ বছরের পূর্ব পুরুষের অস্তিত্বও খুব শীগ্রই বেরিয়ে আসবে । ”
“Centre for Research on Human Evolution and Behavior”- এর পরিচালক Juan Luis Arsuaga বলেন, “এই ধরনের অপ্রত্যাশিত ফলাফল আধুনিক মানুষ ও নিয়ানডার্থাল মানবদের উৎপত্তি ও বিবর্তনের জটিল প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে জানার পথ খুলে দিয়েছে ।
আমি আশা করি ভবিষ্যতে অধিক গবেষণা সাইমা গুহাতে প্রাপ্ত হোমিনিনদের মধ্যে জীনগত সম্পর্ক আরও পরিষ্কার হবে । তবে এক্ষত্রে আরো আলাদা প্রানি থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করতে হবে এবং নিঊক্লিয়ার DNA সিকোয়েন্স নিয়েও গবেষণা করতে হবে । ”
অতএব সমাজ বিজ্ঞান অনুযায়ী প্রাচীন মানুষের গুহায় বাস করার সত্যতা হয়তো আজ প্রমানিত হতে চলছে । যদি এই মতের কোন ত্রুটি থাকত তাহলে এই প্রাচীন হোমিনিনদের কঙ্কালগুলো কেন শুধুমাত্র হাজার বছরের পুরনো গুহায় পাওয়া যাচ্ছে ? এতো শুধু নমুনা মাত্র । এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আরো আশ্চর্য্যজনক কোন কিছু আবিষ্কৃত হবে যা মানব ইতিহাস সম্পর্কে আরো নিখুঁত ধারণা দিবে ।
বিজ্ঞানীদের এই চলমান গবেষণা এমন এক সূত্রের সন্ধান দিবে যেটি ধরে এগুলে মানব সহ সমস্ত জীবের আদি অস্তিত্ব তথা প্রাণ সৃষ্টির মূল উৎস সম্পর্কে অবগত হওয়া যাবে । আর এতে mtDNA-ই প্রধান ভূমিকা পালন করবে । যেহেতু mtDNA শুধুমাত্র মাতৃ গোষ্ঠিতে বিদ্যমান অতএব তার সূত্র ধরেই বের করা যাবে আদি মাতা ও তার সময়কাল । এভাবেই প্রকটিত হয়ে উঠবে মানব বিবর্তন তথা অস্তিত্বের আদি রহস্য । যা কোন পৌরাণিক বক্তব্য নয় হয়ে উঠবে প্রামাণিক ইতিহাস ।
সময়ের অপেক্ষা মাত্র ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।