এর মধ্য দিয়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুটি আলোচনা সভায় নাগরিক সমাজের দুই অংশের প্রতিনিধিদের দুরকম বক্তব্য এলো।
গত ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর লেইকশোর হোটেলে বিদেশি অর্থে প্রকল্প চালানো চারটি এনজিও প্রথম আলোচনা সভাটির আয়োজন করে। ওই সভায় ৫ জানুয়ারি ভোট ভোট বন্ধ করার পক্ষে মত দেন অধিকাংশ আয়োজক।
এর সাতদিন পর একই স্থানে আরেকটি আলোচনা সভার আয়োজন করে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি’। অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারাকাত এই আলোচনা অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন।
‘সহিংস রাজনীতি সংকটে দেশ ভবিষ্যৎ ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, “নির্বাচন ইস্যুকে ঘিরে সরকার ব্যর্থ নয়। নির্বাচনে আসার জন্য বিরুদ্ধশক্তি শর্ত দিয়েছে, শেখ হাসিনাকে চলে যেতে হবে।
“৩০ সদস্যের মালিক যদি ২৩০ সদস্যের মালিককে বলে যে, আপনাকে চলে যেতে হবে এবং তিনি যদি চলে যান, তাহলে এদেশে কোনদিন গণতন্ত্র আসবে? গণতন্ত্র থাকতে পারে না। অসম্ভব। ”
তিনি বলেন, “সংবিধান প্রণেতা যদি বলেন এবং তারসঙ্গে আশেপাশে এখানেও দুএকজন আছেন তারা যদি বলেন, হাসিনাকে চলে যেতে হবে- এটা সংবিধানের পন্থা না।
“সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, চারটি শর্ত। তিনি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা না হন, তিনি যদি সংসদের আস্থা হারান, তিনি যদি বাজেট পাস করতে না পারেন এবং তিনি যদি নৈতিক স্থলনে দায়ী হন- এই চারটি কারণ ছাড়া কোনো প্রধানমন্ত্রী সংসদের মেয়াদকালে পদত্যাগ করতে পারেন না।
“তারা শর্ত দিয়েছেন। বলছেন অমুক অমুক হতে পারেন। আপনি হবেন না।
তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি একটা ভাওতাবাজি ছাড়া কিছু না। ”
ফরাসউদ্দিন বলেন, “এই যে নির্বাচন বন্ধের কথা বলা হয়েছে এর একমাত্র কারণ হলো সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা, যারা ধর্মের নামে বেসাতি করে জনসাধারণকে মারছে, পেট্রোল বোমা ছুড়ছে, শিশুকে হত্যা করছে, তাদের হাতে এই দেশের রাজত্বকে ছেড়ে দেওয়া। ”
আগের আলোচনা সভায় ৫ জানুয়ারির ভোট বন্ধের দাবি তোলা হয়। প্রথম সারির একাধিক পত্রিকায় ভোট বন্ধের জন্য মন্তব্য প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
সেখানে অংশ নেওয়া উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন এনজিওকর্মী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা এবং এক এগারোর সময় আলোচিত আইনজীবী ও ব্যাবসায়ীরা।
বিএনপির কয়েকজন রাজনীতিবিদ ওই আলোচনা সভায় অংশ নিলেও তাতে আওয়ামী লীগের কাউকে দেখা যায়নি।
ওই আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ এস এম শাহজাহান, মইনুল হোসেন, হোসেন জিল্লুর রহমান, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, রোকেয়া আফজাল রহমান, ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক, পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় এই গোলটেবিলে আরো বক্তব্য রাখেন সাবেক কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী, মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়েশা খানম, স্থপতি মোবাস্বের হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা তপন চৌধুরী, বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক।
নারী সংগঠক রোকেয়া কবীর, সালমা আলী, সংস্কৃতিকর্মী লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিয়াস করিমও উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান চৌধুরী।
তাদের সমালোচনা করে কলাম লেখক ও সাহিত্যিক জাফর ইকবাল বলেন, “যখন নাকি আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা বলেন নির্বাচন বন্ধ করতে হবে, তার কারণ জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে। ”
এনজিওর সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আমি যতদূর জানি আমার বাংলাদেশ মোটামুটিভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। বিদেশি দাতাদের সাহায্যে আর চলতে হয় না। এখন বিদেশি দাতারা এনজিওগুলোকে সাহায্য করে। সেই এনজিওরা বসে একটা মিটিং করে বলেছে যে, নির্বাচন করা যাবে না।
ওরা কিন্তু সাথে সাথে এটা বলে নাই যে, সহিংসতা আগে বন্ধ করো তারপর তোমার সাথে কথা বলবো।
“একটা পত্রিকায় আর্টিকেল বের হয় ইংরেজিতে, পরের দিন সেটা বাংলা করে ছাপানো হয়। লেখা আছে, নির্বাচন বন্ধ করতে হবে। কেন লেখা নাই সহিংসতা বন্ধ করতে হবে? সমাধান, সমাধান তো আছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি সমাধান।
”
গাইবন্ধায় জামায়াতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ-বিএনপির এক হওয়ার উদাহরণ টেনে জাফর ইকবাল বলেন, “একশবার সমাধান আছে। জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে আমরা এক হয়ে যাবো। কিন্তু কোনো পত্রিকাতে এটা লেখা নাই।
“ওরা যদি একটা উপজেলায় সমাধান করতে পারে, তাহলে আমরা এটাকে সারাদেশে মডেল করতে পারবো না কেন। তার মানে তারা সমাধান চায় না।
”
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত বলেন, জামায়াত ইসলামীর অধীনে এখন ১২৫টি জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক-বিমাসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে এদের অর্থের জোগান দেয়া হয়। এসব দিয়ে জামায়াত গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে।
তিনি বলেন, আনুমানিক হিসাবে গত একমাসে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির তীব্রতা কতোটা তা নতুন সরকার এসে প্রথম বছরেই টের পাবে।
‘দুচারটা এনজিওর’ সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানান তিনি।
বর্তমানের রাজনৈতিক সহিংসতকে ‘সন্ত্রাসের রাজনীতি’ উল্লেখ করে সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, “সহিংসতা ঠেকাতে সবার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গড়ে তুলতে হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানুষ যেভাবে জেগে ওঠেছিল, সেভাবে আবার তাদের জাগিয়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক পরিবারে, পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ”
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, “সবাই যে সংলাপের কথা বলছেন, সে সংলাপটা কার সঙ্গে হবে? যারা সন্ত্রাস করছে তাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ হতে পারে না।
তবে কয়েকটি শর্ত মানলে সংলাপ হতে পারে। এগুলো হলো- যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ঐক্যমতে আসতে হবে, জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে, সন্ত্রাস দমন করতে হবে ও রাজনীতি হতে হবে জনকল্যাণমূলক। ”
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে এখন সন্ত্রাস হচ্ছে। এ সন্ত্রাসকে ঢেকে দেয়ার জন্য অনেকে সংলাপ ও সমঝোতার কথা বলছেন।
“মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এলেই কেবল তার সঙ্গে সংলাপ-সমঝোতা হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি, ৭১-এর হত্যাকারী ও মা-বোনদের ইজ্জতহানির সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে সংলাপ মানে পরাজিতের সংলাপ। ”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, ভোটার হত্যা করে কি ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন অর রশিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আলোচনা হতে পারে। এই নির্বাচন সংবিধান রক্ষার নির্বাচন, গণতন্ত্র রক্ষার নির্বাচন।
চলমান সংকট নিরসনে চারটি প্রস্তাব করেন তিনি।
এগুলো হলোÑ যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার শেষ ও কার্যকর করা, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর এখনকার সহিংস ঘটনাগুলো জনগণের কাছে প্রচার করা এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে আনা।
চলমান রাজনৈতিক সংকটকে ১৯৭১ সালের সংকটের সঙ্গে তুলনা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযের সাবেক উপাচার্য আব্দুল মান্নান বলেন, এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে। আরেকটি বড় কারণ বাংলাদেশকে আবারও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।