আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিএনপিবিহীন আওয়ামীতরফা নির্বাচন আজ

দেশ-বিদেশের সচেতন মানুষের সব পরামর্শ ও সুপারিশ অগ্রাহ্য করে লীগ সরকার তার জেদই বহাল রাখল। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেশির ভাগই ভোটার ও ভোট ছাড়া সম্পন্ন করে নিয়েছে গত ১৫ ডিসেম্বর। ইতোমধ্যে ১৫৩ জন এমপি হয়ে বসে আছেন। বশংবদ নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটাই এখন বাকি। খুচরা অংশের অর্থাৎ অবশিষ্ট ১৪৭ আসনে নির্বাচন হবে আজ।

প্রধানমন্ত্রীর একজন বিতর্কিত আমলা-উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, নির্বাচন সহিংসতাহীন হবে কিনা তিনি নিশ্চিত নন। কিন্তু সহাস্যবদনে সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, না, না, ওসব কিছু হবে না; সুষ্ঠুভাবেই নির্বাচন হবে। টেলিভিশনে তার চেহারা যারা দেখেছেন, তাদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, তার ওই 'ক্রীতদাস'-এর হাসি জাতির সঙ্গে উপহাসের নামান্তর। এমন একটি হানাহানিময় আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শান্তিপ্রিয় জনগণের চেহারায় যখন ফ্যাকাসে ভাব, তখন একজন রকিবউদ্দীনের মুখ দিয়ে হাসি বেরোয় কী করে?

এই খুচরা নির্বাচন উপলক্ষে রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী (ভাষণটা অবশ্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে) নৌকা মার্কায় ভোট চেয়েছেন এবং বলেছেন, 'আমাদের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। ' জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতেই পারেন।

কিন্তু নৌকা মার্কায় ভোট চাইলেন কেন, বুঝলাম না। মাঠে তো 'আমরা আর মামুরা'। অর্থাৎ, মার্কা তো আছেই দুটো_ নৌকা আর লাঙ্গল। তাও যেখানে নৌকা আছে সেখানে লাঙ্গল আছে না থাকার মতো, আর যেখানে লাঙ্গল আছে সেখানে নৌকা আছে নামমাত্র। আপসে আগেই ভাগাভাগি হয়ে আছে।

অন্য যেসব মার্কা আছে ওগুলো থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? কিছু আসনে নৌকা ও লাঙ্গল আছে সমঝোতার ভিত্তিতে_ কোনটা কাকে ছেড়ে দেওয়া হবে আগেই দলিল হয়ে আছে। কিছু আসনে লাঙ্গল মার্কায় প্রার্থী রাখা হয়েছে 'ডামি' ক্যান্ডিডেট হিসেবে; লোকজনকে এটা দেখানোর জন্য যে, নির্বাচনটা হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যেমন ঢাকা-৬ আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এরশাদ পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদকে_ যিনি একদা ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন এবং যাকে দিয়ে খণ্ডিত জাপা নেতা ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমদকে 'চিনি চোর' বলে গালি দেয়ানো হয়েছে। সেখানে সরকারি ইশারাতে 'ডামি' ক্যান্ডিডেট করা হয়েছে বহু মামলার আসামি আওয়ামী লীগার শহীদ কমিশনারকে। কাজী ফিরোজ রশিদ এতে গোসা করায় শহীদ কমিশনারকে এখন পুলিশ দিয়ে দাবড়ানো হচ্ছে।

পুরান ঢাকার আরেকটি আসনে লড়ছেন শাসক লীগেরই দুই প্রার্থী এমপি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও হাজী সেলিম। ঢাকা-৪ আসনটি আপসপ্রার্থী জাতীয় পার্টির আবু হোসেন বাবলাকে ছেড়ে না দেওয়ায় লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী ড. আওলাদ হোসেনকে বহিষ্কার করা হয়েছে, কিন্তু হাজী সেলিমকে বহিষ্কার করা হয়নি। এসবই হচ্ছে পাতানো খেলা। কে জিতবে, কাকে জেতানো হবে তা আগে থেকেই নির্ধারণ করা আছে বলে বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের দলীয় নির্দেশ পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এই যেখানে অবস্থা, প্রধানমন্ত্রীর নৌকায় ভোট প্রার্থনা একেবারেই অর্থহীন।

এ ছাড়া দলপ্রধান তো ভোট ভিক্ষা করেন তার দলকে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় যাওয়া তো ভোট ছাড়াই নিশ্চিত হয়ে গেছে। জাপা তো তার দলের বাইরের কেউ নয়। 'আধাখাচরা' যে নির্বাচন হচ্ছে তাকে আওয়ামীতরফা নির্বাচন বলেই অভিহিত করা যায়। বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের জোট এই নীলনকশার নির্বাচনে নেই; নেই ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম রবের জাসদ; নেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাসদসহ বিভিন্ন বামদল, এমন কী পরিচিত ইসলামী দলগুলোও।

এ কেমন নির্বাচন মানুষ বুঝছে, হাসছে বাইরের দুনিয়ার মানুষ। কেউ কেউ উপহাসও করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার 'হিজ মাস্টার্স ভয়েজ'রা এতে লজ্জিত না হলেও এটা আমাদের জাতীয় লজ্জা, সামষ্টিক গ্লানির বিষয়।

এ সমালোচিত নির্বাচন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী এবং তার বিজ্ঞ(!) সহযোগীরা সংবিধানের দোহাই দিতে দিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগার স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন গত ১ জানুয়ারি বুধবার একুশে টেলিভিশনের টকশো 'একুশের রাতে' বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে।

কিন্তু একবারও বলছেন না যে, এই সংবিধান তিনি এককভাবে তৈরি করেছেন। ' প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রী-মিনিস্টার-উপদেষ্টা সংবিধানের দোহাই দিয়ে দুটি কথা বলছেন_ (১) সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান না থাকায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান 'সর্বদলীয়' (সর্বদলীয় সরকার বলেও কোনো কিছু সংবিধানে নেই) সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে_ এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পৃথিবীর অন্যান্য কিছু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে তিনি আমাদের মতো 'নাদান' পাবলিককে বোঝাতে চাচ্ছেন, ওইসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। কাজেই তার সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। তিনি বলে দিয়েছেন, এ অবস্থান থেকে একচুলও নড়বেন না; নড়েনওনি।

(২) সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে বলছেন, ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করা না গেলে তা হবে সংবিধানের ব্যত্যয়। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রী-মিনিস্টার-উপদেষ্টাদের দুটি যুক্তিই খণ্ডনযোগ্য। তারা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর দোহাই দিচ্ছেন। সংবিধানের এই ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন তারা এককভাবে। এই অযাচিত সংশোধনীর মাধ্যমে তারা এর আগে পঞ্চম জাতীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৫৮(খ)(গ)(ঘ) ও (ঙ) অনুচ্ছেদে সর্বসম্মতিতে সংযোজিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছেন।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ দেশের শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, মুক্তিযোদ্ধা_ কারও পরামর্শ-সুপারিশই তারা গ্রাহ্য করেননি। এমন কি সংবিধান সংশোধনের জন্য যে সংসদীয় বিশেষ কমিটি করা হয়েছিল তাদের সুপারিশমালাও ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে গেছে। প্রাসঙ্গিকভাবে ওই কমিটির কার্যবিবরণীর কিছু বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই পাঠকদের সুবিধার জন্য।

সংবিধান সংশোধনের জন্য ২০১০ সালের ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবক্রমে সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট যে বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়, সে কমিটি ২৭টি বৈঠক করে। তারা তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, ১০ জন আইনজীবী, ১৮ জন বুদ্ধিজীবী, ১৮ জন সম্পাদক এবং সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সদস্যদের মতামত গ্রহণ করে।

২০১১ সালের ২৯ মার্চ বিশেষ কমিটির ১৪তম সভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অপরিবর্তিত রাখার ব্যাপারে কমিটিতে ঐকমত্য হয়। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আবদুল মতিন খসরু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, রাশেদ খান মেনন, ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রমুখ। ২০১১ সালের ২৯ মার্চ বিশেষ কমিটির ১৪তম সভায় তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে_ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেজর কোনো কিছুতে হাত দেওয়া আমাদের উচিত হবে না। ... যদি দুই টার্মের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয় তাহলে দেখা যাবে, ওই দুই টার্মের পর হয়তো আমাদের ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। তখন আমাদের চিৎকার করতে হবে..., এ সময়ের মধ্যে আমাদের যাওয়া ঠিক হবে না।

' আমির হোসেন আমু বলেন, 'আসলে আমরা যদি এটা পরিবর্তন করতে যাই, তাহলে অনেক ঈড়সঢ়ষরপধঃরড়হ ধৎরংব করবে, অনেক ঝামেলার মধ্যে আমরা জড়িয়ে পড়ব। তার চাইতে ওঃ রং নবঃঃবৎ, এটা যেভাবে আছে সেভাবে থাকে। ' আবদুল মতিন খসরু বলেন, 'আমরা যখন প্রথম বৈঠকে বসি, তখন কতগুলো নীতিমালা নিয়েছিলাম, আমরা এমন কোনো বিষয়ে যাব না, যাতে বিতর্কে জড়িয়ে যাই। আমরা বিতর্কিত কোনো বিষয়ে হাত দেব না। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ব্যবস্থা আছে এটাই থাকুক।

' রাশেদ খান মেনন বলেন, 'মাননীয় সদস্য, আপনি যেটা বললেন, সরকারের যে ব্যবস্থা আছে এটাই থাকুক। ' শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, 'আমিও একমত যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে আমাদের কোনো পরিবর্তন এ মুহূর্তে প্রয়োজন নেই। যদি সময়টা ষরসরঃ করার বিষয় থাকে তাহলে সে ব্যাপারে হয়তো আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি। ' সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ওহ ংঢ়রঃব ড়ভ ধষষ ঃযব ষরসরঃধঃরড়হ এটাকে রেখেই আগানো ভালো। এটার ওপর একটি ঐকমত্য আমরা চাই।

তারপর ষড়ড়ঢ়যড়ষবংগুলোতে যাব। ' এ আলোচনার অভিন্ন মতামতের ভিত্তিতেই ওই সভায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালের ২৭ এপ্রিল কমিটির ২০তম সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫৮ অনুচ্ছেদকে একটু সংশোধন করে অনির্বাচিত সরকারের অনির্দিষ্টকাল থেকে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করার জন্য একটা টাইম ফ্রেম দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। তিনি কমিটির কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ করেছিলেন, বাতিলের জন্য নয়। উল্লেখ্য, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করেন।

২৭ এপ্রিল ২০তম সভায় আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, 'ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্কে আমার বক্তব্য... হচ্ছে... এটি (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) আমরা রাখব। এর ভিত্তিতেই কমিটি ২০১১ সালের ২৯ মে একটি সুপারিশ তৈরি করে। পরদিন ৩০ মে সুপারিশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার পরই হঠাৎ করে সব পাল্টে যায়। সিদ্ধান্ত হয় ব্যবস্থাটি বাতিলের। সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে প্রবর্তিত একটি গ্রহণযোগ্য ও মীমাংসিত ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায় একদলীয় সিদ্ধান্তে, প্রায়-একদলীয় সংসদে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, শাসক দল তাদের সুবিধার জন্যই কাজটি করেছে। এ থেকেই স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনসহ অন্য সমালোচকদের বক্তব্য সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজেই সংসদে নিজেদের দানবীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নিজেদের প্রণীত ও সংবিধানে সংযোজিত বিধানের দোহাই অনৈতিক। সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে প্রণীত ও সংযোজিত একটি মীমাংসিত ব্যবস্থাকে এভাবে একদলীয় সিদ্ধান্তে বাতিল করে দেওয়ার নষ্ট নজির পৃথিবীর কোনো সভ্য গণতন্ত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের পাশর্্ববর্তী দেশ ভারতে এ পর্যন্ত ৯৮ বার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে।

কিন্তু রাজনৈতিক দায়িত্বশীল দল তো বটেই, ক্ষুদ্র কোনো নৃ-গোষ্ঠীর মতামতকেও অগ্রাহ্য করে কিছু করা হয়নি। আমাদের দেশে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কেন বাতিল করা হয়েছে এখন তা সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। গণবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ভরাডুবি ঠেকানোর জন্য সরকার এ কাজটি করেছে।

২৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচনের কথা যা বলা হচ্ছে তাও যথার্থ নয়। হ্যাঁ, সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদ অনুসরণ করলে তা করতে হয়।

এখানে তারা চাতুরির আশ্রয় নিয়েছেন। এ ধারায় বলা আছে, "মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। " পাঠক, লক্ষ্য করুন, এখানে মেয়াদ অবসানের পর এ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদেই সংবিধান আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে আরেকটি সুযোগ অবারিত রেখেছে। তাতে বলা হয়েছে, 'মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।

' নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে তুমুল বিরোধের কারণে দেশে এখন ভয়ানক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি। এ বিরোধের কারণেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে। সরকার নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা বদলে দিয়ে, নিজেদের পছন্দমাফিক নির্বাচন কমিশন গঠন করে এবং বিরোধী দলের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে পরিকল্পিতভাবেই বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে_ দেশ-বিদেশে এ ধারণা এখন বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। দেশের সব সচেতন মানুষ, একমাত্র ভারত ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়াসহ সারা বিশ্ব চেয়েছে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটা গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশে হোক। জাতিসংঘও উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশের বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতা করে দিতে।

কিন্তু সবই ব্যর্থ।

শেষ মুহূর্তেও তারা চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারের প্রাণান্ত প্রয়াস সবাই লক্ষ্য করেছেন। দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিরাও প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে একটা সমঝোতায় পেঁৗছে ইনক্লুসিভ একটি নির্বাচন করার জন্য। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম গত ২ জানুয়ারিও প্রধানমন্ত্রীর কাছে করুণ আর্তি জানিয়েছেন এই নির্বাচন বন্ধ করার জন্য।

এরা সবাই বলছেন, সংবিধানের ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদের আশ্রয় নিয়ে ২৪ জানুয়ারি নয়, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সংঘাতময় পরিবেশ বিবেচনায় সংসদ ভেঙে দেওয়ার অনুরোধ করুন এবং রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সবার অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। কিন্তু কিছুই হলো না। উল্টো সুশীল সমাজ সম্পর্কে আপত্তিকর কিছু মন্তব্য ছুড়ে মারলেন প্রধানমন্ত্রী। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার প্ল্যানই বাস্তবায়ন হচ্ছে আজ। কিন্তু এতে লাভ? লীগ নেতারা এবং তাদের পক্ষীয় বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, একবার নির্বাচন করে ফেলা গেলে আরও পাঁচ বছর লীগ সরকারকে ঠেকায় কে? মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদরা তো নির্বাচনের(?) পর বিরোধী পক্ষকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেওয়ার কথা বলছেন আকারে-ইঙ্গিতে।

কিন্তু অনুধাবন করছেন না, জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে তারা সংবিধান লঙ্ঘন করছেন। এর পরিণাম তাদের ভোগ করা লাগতে পারে। সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, "একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের(৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে, সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন। " যে নির্বাচনে ৫২ শতাংশ আসন আপস সমঝোতার মাধ্যমে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার ফলে নির্বাচনই হলো না, ১৫৩ জন সব অটো এমপি হয়ে গেলেন; তাতে জনগণকে তো তার পছন্দের প্রার্থী বাছাই করার সুযোগই দেওয়া হলো না। অভিজ্ঞজনরা বলছেন, লোকদেখানো আজকের জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির নির্বাচনও ভোটারবিহীন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাঠের বাইরে থাকতে বাধ্য করে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে প্রাপ্ত 'সোনার কাপ' কয়দিন ঘরে রাখতে পারে আওয়ামী লীগ, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এই 'সোনার কাপ' নিয়ে দুই দলের লড়াই দেশের বর্তমান হত্যা, সন্ত্রাস, হানাহানির রাজনীতিকেই আরও প্রলম্বিত করবে। দেশের সব কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতি ধ্বংসের মুখোমুখি পেঁৗছবে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট বাড়বে, ভোগান্তি বাড়বে। গণআকাঙ্ক্ষা ও সংবিধানের চেতনাবিরোধী ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার এরপরও যতদিন থাকবে ততদিনই দেশ জ্বলবে অশান্তির অনলে।

এর হাত থেকে কী নিষ্কৃতি নেই?

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।