চিনি সংযোজন
১৫১৯ সাল। হার্নান কর্টেজ নামের স্প্যানিশ এক পরিব্রাজক এলেন অ্যাজটেকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। সঙ্গে বিশাল সেনাদল।
যুদ্ধ চলল অনেকদিন ধরে। শেষমেশ সম্রাট মন্টেজুমা ভাবলেন, আপোষ করা যাক।
তখন কর্টেজকে সভায় ডাকলেন। সেখানেই কর্টেজ প্রথম চকলেটের স্বাদ গ্রহণ করেন।
কর্টেজ তো চকলেটের স্বাদ গ্রহণ করলেন, পছন্দও করলেন বটে, কিন্তু গলে গেলেন না মোটেই। তারপরও অ্যাজটেকদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। শেষমেশ তাদের হারিয়ে জয়ীও হলেন।
১৫২৮ সালে যখন কর্টেজ দেশের পথে যাত্রা করলেন, তখন তার জাহাজ ভর্তি অ্যাজটেকদের লুট করা মাল। আর সে মালের মধ্যে অনেক অনেক কোকো বীজও ছিল।
স্পেনে ফিরেই কর্টেজ তরল চকলেট তার বন্ধুদের পরিবেশন করলেন। তারা দেখলেন, পানীয়টি খেতে তো ভালোই, গরম থাকতে থাকতেই চিনি মিশিয়ে খেলে আরও বেশি ভালো লাগে। তখন আর কী, অন্যদের খাওয়ানো বাদ দিয়ে ওরা নিজেরাই চিনি মিশিয়ে মজাসে সেই তরল চকলেট খেতে লাগল।
কিন্তু বিধি বাম! স্প্যানিশ রাজপুত্র ফিলিপ এই পানীয়ের ব্যাপারে জেনে ফেলল দ্রুতই। একদল সন্ন্যাসী মধ্য আমেরিকা থেকে আসা কিছু অতিথিকে নিয়ে আসেন তার কাছে। তারাই এক বিরাট পাত্র ভর্তি তরল চকলেট নিয়ে আসেন উপহার হিসেবে।
রাজপুত্র ফিলিপ তো চকলেটের ফাঁদে পড়ে গেলেন। তিনি তরল চকলেটের প্রেমে এমনভাবেই মজলেন, তরল চকলেটকে ঘোষণা করলেন স্প্যানিশ রাজসভার রাজকীয় পানীয় হিসেবে।
এরপর চকলেটের গল্প দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে। তখনও এমনকি ইউরোপের লোকজন সেভাবে আলু খেতেও শেখেনি। তবে কোকো বীজ থেকে চকলেট বানানোটা ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ। তাতে খরচও নিতান্ত কম হত না। তাই কেবল ধনীরাই তরল চকলেট কিনে খেতে পারত।
তারা রীতিমতো রেস্তোরাঁয় একত্রিত হয়ে গরম গরম তরল চকলেটে চুমুক দিতে দিতে আবহাওয়া সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করত।
চকলেট তৈরির যন্ত্রপাতি
তত দিনে উদ্ভাবকেরা স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার করে জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে। কাজেই অনেক কিছু তৈরি করাই অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। এর ভেতরে চকলেটও ছিল। ফলে কোকো বীজ থেকে তরল চকলেট তৈরি করার ব্যবসা বেশ জমে উঠল।
ইউরোপের নানা জায়গায় গড়ে উঠল চকলেট তৈরির কারখানা। আর তখন থেকেই তরল চকলেট আর ‘শুধুমাত্র ধনীদের জন্য’ থাকল না।
সে ১৮৪৭ সালের কথা। ফ্রান্সিস ফ্রাই নামে এক ইংরেজ ছিলেন। চকলেটের কারিগর।
তিনি চিন্তা করলেন, চকলেট যদি পান করার বদলে খাওয়া যেত, তাহলে কতই না ভালো হত। তখন তিনি তরল চকলেটের মিশ্রণকে কীভাবে কঠিন দলার আকৃতি দেওয়া যায়, তাই নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করলেন।
এদিকে নেদারল্যান্ডের কোয়েনরাড ভ্যান হউটেন নামের এক লোক ফ্রাইয়ের সমস্যার অর্ধেক সমাধান করেই ফেললেন। তিনি এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করলেন, যাতে চকলেটের মিশ্রণকে চাপ দিয়ে বাদামি কোকো গুঁড়ায়, ও হলুদ কোকো মাখনে পরিণত করা যায়।
ফ্রাই দেখলেন, কোকোর মাখন ঠান্ডা হলে শক্ত হয়ে যায়।
তিনি ভাবতে লাগলেন, এই কোকোর মাখনকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে কঠিন চকলেট বানানো যায়।
সে জন্য ফ্রাই প্রথমে গরম কোকো মাখন তার চকলেট মিশ্রণে মিশিয়ে, তাতে তিন স্কুপ চিনি মিশিয়ে দিলেন। তারপর মিশ্রণটিকে চারকোণা পাত্রে ঢেলে ঠান্ডা করলেন। ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে মিশ্রণটি শক্ত হয়ে গেল। আর এভাবেই ফ্রাইয়ের হাতে তৈরি হল বিশ্বের প্রথম শক্ত চকলেট।
দ্রুতই কারখানাগুলো উন্নতমানের গাঢ় আর শক্ত চকলেট বানাতে শুরু করল। তারা এই শক্ত চকলেটকে বলত ‘সুস্বাদু খাবার চকলেট’।
ওদিকে সুইজারল্যান্ডে বাস করতেন ডেনিয়েল পিটার। তিনি ছিলেন মূলত মোমের কারিগর। সে সময় আবার মোমবাতির চাহিদা পড়তির দিকে।
কাজেই তার টাকার খুবই টানাটানি যাচ্ছিল। এরই মধ্যে তিনি এক মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন। সেই মেয়ে আবার ছিল চকলেটের কারিগর। তখন তার মাথায় অসাধারণ এক বুদ্ধি খেলে গেল। ঠিক করলেন, তিনি চকলেটের ব্যবসাই করবেন।
ততদিনে চকলেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভীষণ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। পিটার দেখলেন, ব্যবসায় সুবিধা করতে হলে তাকে আরও সুন্দর নকশাদার আর উন্নত মানের চকলেট বানাতে হবে। সে উদ্দেশ্যেই পিটার তার চকলেটে মেশালেন দুধ।
তাতে অবশ্য আশাহত হতে হল পিটারকে। চকলেটের নতুন মিশ্রণটি অনেক পাতলা হয়ে গেল।
পিটারের ভাগ্য অবশ্য অতটাও খারাপ ছিল না। তারই প্রতিবেশী ছিলেন হেনরী নেসলে। তিনি আবার খাবার-দাবার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতেন। নেসলে আসলে বাচ্চাদের খাবার বানিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনিই পিটারের চকলেট মিশ্রণটি কীভাবে ঘন করা যায়, সে উপায় খুঁজে বের করলেন।
১৮৮৩ সালে পিটার তার এই নতুন রেসিপির দুধের ক্রিম সম্পন্ন চকলেটের জন্য সোনার মেডেল পান। দুধসহ চকলেটের চাহিদা তখন একেবারে তুঙ্গে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।