আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পেপার ম্যান

“তোমার সমস্ত গুণাগুণ আমার সংস্পর্শে এসে নষ্ট হয়ে গেছে” বলছিল পেপার ম্যান। ওকে আমি পেপার ম্যান বলে ডাকি। আমরা ছিলাম নদীর ধারটিতে বসে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল প্রায়। বিদায়ী সূর্যটার রক্তিম কান্না শান্ত নদীতে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিয়েছিল।

আমার পাশে বসে পেপার ম্যান। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য আমি যেন আমার পার্শ্ববর্তী মানুষটির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। অন্যমনস্ক আমি হঠাৎ চমকে উঠি। “কি এতো ভাবছো?” বললো আমাকে। আমি একটু লাজুক হেসে ওর দিকে তাকালাম।

পেপার ম্যানের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা চিঠি চালাচালির মাধ্যমে। ওকে আমি আগে থেকেই জানতাম। সেও আমাকে। কিন্তু কথা হয়নি কোনোদিন। ও থাকতো আমারি শহরে, আমার পাশের ছাদের চিলেকোঠায়।

আমি যখন পড়তে বসতাম, আমার জানালার ছাদ দিয়ে ওর চিলেকোঠা দেখা যেত। ও থাকতো একা। শীর্ণ শরীর আর মায়াময় চেহাড়ার লোকটিকে আমার ঠিক যেন উপন্যাসের নায়ক বলে মনে হতো। অষ্টাদশী আমি আমার কল্পনার ওকে নিয়ে লিখেছি কতো অণু-উপন্যাস, আর নিজে হয়েছি সেইসব উপন্যাসের নায়িকা। আমার চুল ছিল মাঝারি আকারের।

তবুও দুপুর স্নান শেষে আমার ভিজে চুলে দাঁড়িয়েছি আমার সেই সুখের জানালায়। গল্প উপন্যাসে যখন নায়িকারা আনমনে তাদের ভিজে চুলে শুকনো তোয়ালের পরশ বুলিয়ে যায়, তাকে গোপনে ভালোবেসে যাওয়া মানুষটি হয়তো পাশের ছাদ থেকেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই দৃশ্যের অবলোকন করে যায়। আমি সচেতন ভাবেই সেসব করে গিয়েছি। কিন্তু কোন মুগ্ধ দৃষ্টি আমার উপর নিক্ষিপ্ত হয়নি। গান পারতাম ভালো।

আমার গুণগুণ করে গাওয়া গান কখনো কখনো আর গুণগুণ থাকতোনা। তাদের গন্তব্য হয়ে যেত ঐ চিলেকোঠাটা। উৎস জানতে পায়নি কোনোদিন, উৎস থেকে সৃষ্ট সুর গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলো কিনা! কেননা, ফলাফল ছিল শুন্য। কল্পনা করতাম, একদিন আমার কলেজ যাওয়ার যাত্রাপথে পেপার ম্যানের সাথে আমার দেখা হয়ে যাবে, পেপার ম্যান আমায় বলবে-“ আপনি কিন্তু খুব ভালো গান করেন!!” পেপার ম্যান একদিন তার ছোট্ট চিলেকোঠা ছেড়ে চলে গেলো। আমার নিত্যদিনের ওর জন্য করে যাওয়া কাজগুলোতে তাই ব্যাঘাত ঘটলো।

এবার তাই তারই জন্য আমার নতুন কর্মসূচীর পরিকল্পনা করতে হলো। এরই মধ্যে আমি আমার উপন্যাসের নায়ক সম্পর্কে সব ধরনের তথ্যই যোগাড় করে ফেলেছিলাম। ওর সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য যোগাড় করা কেমন একটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওর নতুন ঠিকানাও বের করতে খুব একটা কষ্ট করতে হলোনা আমাকে। নতুন বাসায় তার পদ-অবনতি ঘটেছে।

এবার আর ছাদ নয়, ছাদের তলায় একটা ছোট্ট ঘরে ওর আবাস হলো। এবারও সে একা। আমার নতুন কর্মসূচীর মধ্যে ওকে চিঠি দেওয়াটাকে অন্তর্ভুক্ত করলাম। টিভি নাটকে একটা চিঠি লিখতে দেখেছি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা নষ্ট করতে । সেই হিসেবে আমি মাত্র দু’টো।

একটা কাঁটাছেড়াসহ অন্যটি বিহীন। মাত্র দু’তিনলাইনের চিঠিটা ছিল এমন, প্রিয় প্রতিবেশী, কেমন আছেন আপনি? আমাকে কি আপনি চিনতে পেরেছেন? যদি চিনতে পারেন তাহলে প্রতিউত্তর দিবেন। ভালো থাকবেন। আপনার চিঠির প্রত্যাশায়... ইতি -প্রতিবেশিনী চিঠিটা পোষ্ট করার পর আফসোস হচ্ছিল খুব। আমি কে, সেটা একটু খোলাসা করেই ওকে লেখা উচিত ছিল।

কিভাবে চিনবে সে আমায়? ফিরতি চিঠির আশা তাই খুব ক্ষীণ ছিল। কিন্তু তবুও আশায় বাঁধে মন। যদি পারে চিনতে!! ওর চিঠি যেদিন পেয়েছিলাম, সেদিনটা আমি কোনোদিন ভুলবোনা। হৃদপিন্ডটাও যে এতো জোড়ে সুখের ঢোল বাজাতে পারে বুঝেছিলাম সেবারই প্রথম। প্রতিবেশিনী, কথা বলার সাহস হয়নি কখনো আপনার সাথে, সাহস হয়নি চোখ মেলে দেখারও।

চিনি আপনাকে, আরো চিনার সুযোগ করে কি দিবেন আমায়? ইতি -ভীতু প্রতিবেশী সেই থেকে চিঠি চালাচালির শুরু। আমার লেখার হাত ভালো ছিল। আমার সময়ও ছিল অফুরন্ত। অনেক সময় আর যত্ন নিয়ে ওকে এক একটা চিঠি দিতাম। যেন এক একটা কাব্য।

ওর অভাব ছিল সময়ের। লিখার হাতও তেমন ভালো ছিলনা। তবু ওর ছোট্ট ছোট্ট চিঠিগুলো পড়তে কিযে ভালো লাগতো!! ওর সহজ কথায় লিখা চিঠিগুলো মাঝে মাঝে দুর্বোধ্য বলে মনে হতো। মনে হতো এই সহজ কথার ভিতরেই না জানি কোন গুঢ় অর্থ লুকিয়ে আছে, আমি ঠিক ধরতে পারছিনা। গুপ্ত অর্থ খুঁজতেই এক চিঠিই বারবার পড়া হতো।

পেপার ম্যান একদিন আমাকে গল্প লিখতে উৎসাহ দিলো। আমার স্কুলের ঘটনা নিয়ে লিখেও ফেললাম একটা। এবার চিঠির সাথে গল্প ফ্রি পেলো ও। অনেক বাহবা পেলাম। ওর প্রশংসার লোভেই মাঝে মাঝেই ওকে চিঠির সাথে গল্প উপহার দিতে লাগলাম।

ওর মন্তব্যগুলো আমার লোভ আরো বাড়িয়ে দিতে লাগলো। আমি লিখতে থাকলাম। পেপার ম্যান কে নিয়ে কখনো গল্প লিখা হয়ে উঠতোনা। গল্পবিহীন ওকে একদিন দু’তিন লাইনের একটা চিঠি দিলাম। প্রিয় পেপার ম্যান, একদিন সারাটা দিন তোমার সাথে কাটাতে চাই।

সময় হবে কি তোমার? ইতি -মায়া মায়া, ভীতু আমি, আমার এই ইচ্ছাটা এতোদিন বলবো বলবো করেও বলা হয়নি। চাই খুব চাই। তবে আমার দু’টো উপহার চাই। আমায় গান শোনাবে, আর আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবে। পরশুদিন সময় হবে কি তোমার।

ইতি -তোমার পেপার ম্যান। ওর সাথে আমি আজ সারাটা দিন। কি যে ভালো লাগছে! আমার কল্পনার স্ক্রিপ্ট গুলো যেন আজকেই দু’ই কুশীলব দ্বারা অভিনীত হচ্ছে। ওকে গান শোনাবো বলে কত যে অনুশীলন করেছি। কিন্তু কেন জানিনা এতো অনুশীলনের পরেও, বারবার গানের সুরের বাত্যয় ঘটছিলো।

গলা কাঁপছিল। সে বললো, তোমার গলা মনে হয় আজ ভালো নেই। আরেকদিন শুনবো। গানযে তার ভালো লাগেনি বুঝতে বাকি রইলোনা। ওকে নিয়ে লেখা গল্পটা কালকেই ছিড়ে কুটিকুটি করেছি।

লিখার পরেই বুঝতে পারছিলাম লেখাটা ওকে মুগ্ধ করার মতো হয়নি। আমার লিখার এই গুণটার অধঃপতন ওকে জানানোর কোন ইচ্ছাই আমার হয়নি। কিছুটা মন খারাপ নিয়েই তাই বসে ছিলাম আমি। সূর্য ততোক্ষণে বিদায় নিয়েছে। পেপার ম্যানের চাওয়া দু’টো উপহারের মধ্যে একটা তো পুরোপুরিই ব্যর্থ, আরেকটা অর্ধেক।

কিছুটা অন্যমনস্ক, কিছুটা হতাশ, কিছুটা লজ্জিত আমাকে পেপার ম্যানের ওই কথাটা আমার বুকে তীড়ের মতো বিঁধলো। সময় হয়ে এলো ফিরে যাওয়ার। পেপার ম্যান বললো, “চলো উঠা যাক”। বললাম- “তোমায় একটা গান শোনায়”। ও সম্মতি জানালো।

আমি গাইতে শুরু করলাম, এখন আর আমার গলা কাঁপছেনা... “বিকেলের শেষ আলোয় একটু থাকো, গৌধুলির ছায়া ফেলে যেওনাকো, রাত যেন ছুটি নেয় তোমার আলোয়। তাই বাসি ভালো, সোনার আলো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.