সমকালীন সমাজের সাথে কতটা প্রাসঙ্গিক এই গল্পগুলি সেই কৌতুহল থেকে কয়েকমাস আগে এদের ফিরে পড়তে আর সেই সাথে আমার অনুভব-এ অনুবাদ করতে শুরু করি। যত দিন গেছে তত অবাক হয়ে গেছি দেখে যে একের পর এক গল্পগুলি কি প্রবলভাবে আমাদের সময়ের কথা বলছে। এই গল্পগুলিতে যাঁরা মন্তব্য করেছেন তাঁরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গল্পে একই অনুভব-এর কথা জানিয়েছেন। আসুন, দেখা যাক এবারের পঞ্চক-এ কি পাওয়া গেল।
অনুবাদ ইংরেজী পাঠের অনুসারী, আক্ষরিক নয়।
সাথে আমার দু-এক কথা।
গল্পসূত্রঃ R. Worthington (DUKE Classics)-এর বই এবং আন্তর্জাল-এ লভ্য http://www.aesop-fable.com -এ ইংরেজী অনুবাদের ঈশপের গল্পগুলি।
গল্পক্রমঃ R. Worthington-এর বইয়ে যেমন আছে।
----------------------------------------------------------------
(৫৬)
The Crow and the Pitcher
এক কাক ও জলের কলসী
একটা কাকের একদিন খুব জলতেষ্টা পেয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন আর থাকতে পারছেনা।
এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে একটা জলের কলসী নজরে আসায় সেটার কাছে উড়ে চলে এল। এসে দেখে কলসীতে জল এত নীচে রয়েছে যে সেটা তার নাগালের বাইরে। খুব দুঃখ হল তার। নানা ভাবে নানারকম চেষ্টা করল সে জলের মধ্যে ঠোঁট নিয়ে যেতে, কিছুতেই কিছু হল না। তখন সে একটা উপায় আবিষ্কার করল।
এদিক ওদিক যেখান থেকে যত পারে নুড়ি পাথর কুড়িয়ে আনল। তার পর একটা একটা করে সেই নুড়ি পাথরগুলো কলসীর মধ্যে ফেলতে লাগল। একটু একটু করে জলের তল উপরে উঠতে থাকল। একসময় চলে এল তার নাগালের মধ্যে। এইবার জল খেয়ে প্রাণ রক্ষা হল তার।
প্রাচীন বচনঃ প্রয়োজন-ই আবিষ্কারের কারণ।
আমি বলিঃ প্রয়োজন বোধ করলে উপায় বের হতে পারে। সাফল্য আসে তাদেরই যারা সেই উপায়টাকে নিয়ে ধৈর্য্য ধরে এগিয়ে যেতে পারে।
(৫৭)
The Ass Eating Thistles
কাঁটাঝোপ চিবোনো গাধার গল্প
সেবার ভাল ফসল হয়েছে। এক গাধা চলেছে ক্ষেতের দিকে।
পিঠে নিয়ে চলেছে নানা রকমের খাবারের বোঝা। গাধার মালিক চাষী আর তার ক্ষেতমজুরদের জন্য। যেতে যেতে রাস্তার একপাশে কিছু কাঁটাঝোপ দেখে গাধা সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর মনের সুখে ঐ কাঁটাগাছগুলো চিবোতে চিবোতে ভাবতে থাকলঃ “কত রকমের খাদ্য বয়ে নিয়ে চলেছি আমি। ভোজনরসিক লোকগুলো ঐ সব খাবার খেয়ে কি আহ্লাদ-ই না করতে থাকবে! কিন্তু আমায় দেখো! এই তেতো কাঁটা গাছের ঝাড়-ই আমার কাছে স্বাদে-গন্ধে সবদিক থেকে পরম তৃপ্তিদায়ক! বিশ্বের সবচেয়ে জমকালো আর দামী খাবারের থেকেও সুস্বাদু।
যার যা খেতে মন চায় খাক, আমার সবচেয়ে পছন্দের খাবার এই রকম রসে টসটসে কাঁটাগাছ। এই পেলে আমার আর কিছু চাই না। ”
প্রাচীন বচনঃ যার যা রুচি। এক-এর কাছে যা বিষ, অন্যের কাছে তা অমৃত। একজন যা ফেলে দেয়, আরেকজন তা মাথায় তুলে নেয়।
আমি বলিঃ যত ভাল খাবারই সামনে ধর, গাধারা কাঁটাঝোপ চিবোতেই পছন্দ করবে। যত যুক্তির সমাহারই সাজিয়ে দাও, জেগে-ঘুমানো মূর্খরা অবাস্তব গাল-গল্প বিশ্বাস করতেই বসে থাকবে।
(৫৮)
The Wolf and the Lion
নেকড়ে ও সিংহের গল্প
একটা নেকড়ে একদিন একটা ভেড়া চুরি করে নিজের ডেরায় নিয়ে যাচ্ছিল। পথে এক সিংহ তার কাছে থেকে ভেড়াটা কেড়ে নেয়। নেকড়ে তখন একটু তফাতে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করলঃ “আপনি অন্যায্যভাবে আমার কাছ থেকে আমার জিনিষ কেড়ে নিলেন।
” সিংহ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গর্জন করে বললঃ “আচ্ছা, ভেড়াটা তোর নিজের কাছে থাকাটা খুব ন্যায়সম্মত হত বলছিস? কোন বন্ধুর কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলি বুঝি ওটা? না কি কিনেছিলি কোথাও থেকে? এই দু’ভাবের কোনটাতেই যদি না পেয়ে থাকিস, তা হলে ওটা তোর হয় কোন হিসাবে?”
প্রাচীন বচনঃ এক চোর আরেক চোর-এর থেকে কোন অংশে ভাল নয়।
আমি বলিঃ প্রথমে দেশীয় দাদারা লুট করে; তাদের থেকে আবার বিশ্ব-দাদারা ডাকাতি করে। উভয়েই যার যার সংগ্রহকে নিজের নিজের হকের পাওনা বলে গণ্য করে।
(৫৯)
The King’s Son and the Painted Lion
এক রাজপুত্র আর এক সিংহের ছবি
এক রাজার ছিল একটি মাত্র ছেলে। রাজপুত্র শিকারে যেতে খুব ভালবাসত।
রাজা একদিন স্বপ্ন দেখলেন, কেউ তাকে সাবধান করে দিচ্ছে যে রাজপুত্র একটা সিংহের হাতে মারা যাবে। রাজার মনে ভয় ধরে গেল - স্বপ্ন যদি সত্যি হয়ে যায়! রাজা তখন ছেলের জন্য একটা প্রাসাদ বানিয়ে দিলেন। এখন থেকে রাজপুত্র এই প্রাসাদের মধ্যেই থাকবে, বনে জঙ্গলে আর যাবে না। আর, জন্তু-জানোয়াররাও এই প্রাসাদের মধ্যে আসতে পারবে না। রাজপুত্রের যাতে মন ভাল থাকে তাই ঐ প্রাসাদের দেয়ালগুলো নানা রকম জন্তু-জানোয়ারের ছবি দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হল।
সব প্রমাণ আকারের, একেবারে জীবন্ত দেখতে। ঐ ছবিগুলোর মধ্যে একটা সিংহের ছবিও ছিল। রাজপুত্র যখন সেই ছবিটা দেখল, নিজের বন্দীদশার দুঃখ তার মনের মধ্যে একেবারে উথলে উঠল। সিংহটাকে বলল সে, “সমস্ত জন্তুদের মধ্যে তুই হচ্ছিস সবার চেয়ে নচ্ছাড়। ঘুমের মধ্যে দেখা আমার বাবার একটা মিথ্যে স্বপ্নের ভিতর ঢুকে এলি তুই।
আর তার ফলে, চার দেয়ালের ঘেরাটোপে বন্দী থাকা কোন মেয়ের মত, আমি এই প্রাসাদের মধ্যে আটকা পড়ে গেলাম। বল, কি শাস্তি এখন দেব আমি তোকে?” এই বলে সে একটা কাঁটা-গাছের ডাল ভেঙ্গে নিতে গেল - ওটা থেকে একটা বেত বানিয়ে তাই দিয়ে আচ্ছা করে এই ছবির সিংহটাকে পিটবে সে। ভাঙ্গতে গিয়ে ডালটা থেকে পট করে একটা কাঁটা ফুটে গেল তার আঙ্গুলে। কাঁটা ফোটার জায়গাটা ফুলে উঠল, এমন ব্যথা হল সেখানে যে রাজপুত্র অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ভয়ংকর জ্বর এল তারপর।
সেই জ্বর আর সারল না। কয়েকদিনের মধ্যে ঐ জ্বরের ঘোরেই মারা গেল সেই রাজপুত্র।
প্রাচীন বচনঃ সাহস করে বিপদের মোকাবিলা না করে তার থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে পার পাওয়া যায়না।
আমি বলিঃ কেবল মিডিয়ায় বাগাড়ম্বর করে গেলে সমস্যার সমাধান হয়না। ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন হতে হতে একসময় কাগুজে অস্তিত্বের বাইরে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
(৬০)
The Trees and the Axe
গাছ ও কুড়ালের গল্প
একটা লোক একদিন জঙ্গলে গিয়ে গাছেদের কাছে প্রার্থনা জানাল তাকে যেন কেউ একটা হাতল দেয় তার কুড়াল-এ লাগানোর জন্য। গাছেরা রাজী হল। সবাই মিলে একটা ছোট জিওল-গাছকে দান করে দিল লোকটাকে। সেই লোক তখন ঐ জিওল গাছটাকে উপড়ে নিয়ে তার থেকে একটা হাতল বানিয়ে তার কুড়াল-এ লাগিয়ে নিল। আর, তারপর-ই ঝপাঝপ কুড়াল চালিয়ে একটার পর একটা পুরান বড় বড় গাছ কেটে নামিয়ে নিতে লাগল।
এক বুড়ো শাল গাছ এই ভাবে নিজের জনদের ধ্বংস হতে দেখে বিলাপ করে পাশের গাছটিকে বলল, “প্রথম কাজটাতেই আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমরা যদি তখন জীওল গাছটার বাঁচার অধিকার ছেড়ে না দিতাম তা হলে আজ নিজেদের বাঁচার অধিকারও হয়ত রক্ষা করতে পারতাম। আর তখন হয়ত, আর ও বহুকাল এখানে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম। ”
প্রাচীন বচনঃ অন্যের অধিকার লুট হয়ে যেতে দিলে নিজের অধিকার হারিয়ে যাওয়ার ও বিপদ ঘনিয়ে আসে।
আমি বলিঃ সংখ্যালঘুর উৎখাত হওয়া যদি আজ বন্ধ না করা যায় তবে কাল ঐ সংখ্যালঘুর উৎখাতকারীদের হাতেই সংখ্যাগুরুর নিরাপত্তাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।