জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই
এটা আমার জীবনের অন্যতম মজার ঘটনা। আমি তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক যুগের চিন্তার নির্বাহী সম্পাদক। পত্রিকা অফিস তার ঠিকানা পরিবর্তন করল। অফিস পরিবর্তন করার ফলে পত্রিকা অফিসের টেলিফোন লাইনটা নতুন ঠিকানায় লাগানো দরকার।
নারায়ণগঞ্জ টিএন্ডটি অফিসে দরখাস্ত দেয়া হল।
সেই দরখাস্ত আর নড়ে না। পত্রিকা অফিস বলে আমরা বিরাট ঝামেলায় আছি। একদিন আমি গেলাম টিএন্ডটি অফিসে। গিয়ে দেখলাম, আমাদের দরখাস্ত বিলিং সেকশনে পড়ে আছে। গিয়ে জানালাম, এটা পত্রিকা অফিসের নাম্বার।
একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে।
পত্রিকা অফিস শুনেই সম্ভবত বিলিং সেকশনের ভদ্রলোকের টনক নড়ল। আমাকে পরামর্শ দিল হাতে হাতে দরখাস্ত নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে। আমি বিলিং সেকশন থেকে দরখাস্ত নিয়ে গেলাম একজন ইঞ্জিনিয়ারের কাছে। উনি অনুমতি দিলেন।
এবার লাইনম্যানদের দায়িত্ব হল আমার লাইনটা নতুন ঠিকানায় লাগানো। গেলাম, লাইনম্যানদের সেকশনে। গিয়ে দেখি ওখানে কেউ নাই। এক ভদ্রলোক জানাল, লাইনম্যানদের এক বস আছে, উনার সঙ্গে যোগাযোগ করলে কাজ খুব দ্রুত হবে। আমি সেই বসের মোবাইল নাম্বার চাইলাম।
উনি বললেন, উনার মোবাইল নাম্বার দেয়া নিষেধ। আমি তব্দা খেয়ে গেলাম।
যাগগে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সেখানে বসে রইলাম। কেউ উনার নাম্বার দিতে রাজি হল না। একজন বয়স্ক মানুষের মোবাইল নাম্বার কেন কেউ দিচ্ছে না, সেটাই আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হতে লাগল।
ভাবলাম, অপেক্ষা করে দেখাই যাক না, ঘটনাটা আসলে কোথায় প্যাঁচ খেয়েছে।
অবশেষে দুপুর আড়াইটায় উনি অফিসে তশরিফ রাখলেন। বয়স্ক লোক - বয়স প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ হবে। মুখে চাপ দাড়ি - পুরোটাই পাকা। পরনে পাঞ্জাবি-পাজামা।
হালকা পাতলা গড়নের লোকটাকে দেখলে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না । আমি উনাকে যেই রকম ভারিক্কি ধরনের লোক ভেবেছিলাম, উনি মোটেও সেই রকম দেখতে নন।
আমি দরখাস্তটা উনাকে দেখালাম। দরখাস্তটা না দেখেই উনি পাশের টেবিলে সেটা চালান করে দিলেন। আমাকে কিছুই বললেন না।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কখন লাইনটা লাগবে ?’
উনি আমার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘লাইগ্যা যাইব। ‘
আমি উনাকে জানালাম, একটু জরুরী বিষয়।
উনি আমাকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘এইটা আমাগো ব্যাপার। ‘
‘ঠিক আছে, আপনার মোবাইল নাম্বারটা দেন, আমি পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। ‘
আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি বললেন, ‘এইটা তো আমার পার্সোনাল নাম্বার, এইটা আপনাকে দেব কেন ?’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘মোবাইল নাম্বার তো সবার পার্সোনাল নাম্বারই হয়।
আমারটাও পার্সোনাল নাম্বার। কিন্তু আমি তো সেটা সবাইকে দেই। ‘
উনি দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘সেইটা আপনের ব্যাপার। কিন্তু আমি অফিসের লোকদের পার্সোনাল নাম্বার দেই না’।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন, দেন না কেন ?’
তিনি বললেন, ‘এই ফোন তো আমারে অফিস কিন্যা দেয় নাই।
এইটার নাম্বার অফিসের লোকদের দিব কেন ?’
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বললাম, ‘আমার মোবাইলও তো আমার অফিস কিনে দেয় নি। তাই বলে কি আমি অফিসের লোককে নাম্বার দেই না ? আমি সবাইকে নাম্বার দেই। নাম্বার না দিলে লোকজন আমার সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করবে ?’
উনি আবারও তর্ক করে বললেন, ‘আমি পার্সোনাল নাম্বার কাউকে দেই না। ‘
‘তাহলে লোকজন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে কিভাবে ?’
‘আমার অফিসের নাম্বারে ফোন করেন।
‘
‘আপনি তো অফিসে থাকেন না। ‘
উনি বিরস মুখে বললেন, ‘এত কথা বলতে পারব না। আমি পার্সোনাল নাম্বার দেই না’।
আমার মেজাজটা চরমভাবেই খারাপ হল। বলতে ইচ্ছে করল, আপনার পার্সোনাল নাম্বার দিয়ে আপনি কি কেবল আপনার বৌয়ের সঙ্গে কথা বলেন ? কিন্তু মুরুব্বী মানুষ বলে আর কথা বাড়ালাম।
এই ধরনের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নাই।
টেলিফোন অফিসে যদি এই রকম ঠ্যাডা লোক বসে থাকে, তাহলে কিভাবে যোগাযোগ হবে ? হবে না, হয়ও না। ফলে আমরা বার বার পিছিয়ে যাই, পিছিয়ে থাকি, গোটা দেশ পিছিয়ে যায়। জাতি হিসেবেও আমরা পিছিয়ে পড়ি।
জানি না, উনার পার্সোনাল নাম্বার এখনও পার্সোনাল আছে কি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।