বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সুচিত্রা সেন। লক্ষ-কোটি দর্শকের মন পাগল করা বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। ৮২ বছর আগে এসেছিলেন পৃথিবীর আলোকময় জগতে। বাংলাদেশের পাবনায় তার জন্ম। স্কুলজীবনের অনেকটা সময় তার কেটেছে বাংলাদেশেই।
তারপর কলকাতায় চলে যাওয়া, বড় হয়ে ওঠা, সংসারজীবন শুরু করা- সব মিলিয়ে কেটেছে আরও কিছুটা সময়। এরপর তার আবির্ভাব ঘটে চলচ্চিত্রের নায়িকা হিসেবে। সর্বমোট ৬২টি ছবিতে অভিনয় করেন। সে সব ছবি যারা দেখেছেন তারা মনে রেখেছেন সুচিত্রা সেনকে।
কিন্তু দীর্ঘ ৩৮ বছর নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে বন্দী করে রেখেছিলেন।
যাতে করে কেউ তার বার্ধক্যের বদলে যাওয়া চেহারা না দেখতে পারেন। ৩৮ বছর দীর্ঘ সময়, এই সময়ে যে কোনো একজন মানুষকে মানুষ চাইলে ভুলতে পারে। কিন্তু সুচিত্রা সেন প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন যে নায়িকা আকর্ষণে, সৌন্দর্যে, অভিনয়ে, এতটাই উজ্জ্বল, অনেকটা মধ্য গগনের সূর্য রশ্মির মতো। তার দীপ্তি ৩৮ বছর কেন ৩৮০ বছরেও দর্শকরা ভুলবে না। সব বয়সী, সব শ্রেণী, সব দর্শককে কাঁদিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।
এই বিদায় হয়তো শারীরিক কিন্তু সুচিত্রা সেন তার দর্শকদের কাছে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
আমার পরম সৌভাগ্য আমি দেখেছি সুচিত্রা সেনকে। মুখোমুখি হয়েছি তার, নিয়েছি সাক্ষাৎকার। সদ্য স্বাধীন দেশে সব পত্রপত্রিকার ভিড়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রা প্রিয় হয়ে ওঠে পাঠকদের কাছে। শাহাদাত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, মাহফুজউল্লাহ, মুনতাসীর মামুন, আনু মুহাম্মদ, শেখ আবদুর রহমান, ফারুক ফয়সাল এবং আমি- আমরা ছিলাম একটা পরিবার।
আমার দায়িত্ব ছিল সাংস্কৃতিক পাতার, যেহেতু পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশে বাংলা চলচ্চিত্রের পীঠস্থান, তাই ঠিক করলাম টালিগঞ্জের কথা নিয়মিত লিখব। সেই সূত্রে বহুবার কলকাতায় গিয়েছি টালিগঞ্জের ফিল্মিপাড়ায়, অনেক নামিদামি শিল্পীর মুখোমুখি হয়েছি। সেখানেই পরিচয় ঘটে শিল্পী-নির্দেশক সূর্য চ্যাটার্জির সঙ্গে। এই সূর্য চ্যাটার্জি আমাকে জানালেন দেবী চৌধুরানী ছবির শুটিং চলছে কলকাতার অদূরে ডায়মন্ড হরবারে। গঙ্গা যেখানটায় সমুদ্রের মোহনায়, আমি যাব কিনা, গেলে সাক্ষাৎ মিলবে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে।
আমি তো আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। সুচিত্রার সঙ্গে দর্শন হবে এমন সুযোগ ক'জনার ভাগ্যে ঘটে। যথাসময়ে যথাস্থানে পেঁৗছে গেলাম। গিয়ে দেখি ছবির পরিচালক দীনেন গুপ্ত, তার স্ত্রী কাজল গুপ্ত, নায়ক রঞ্জিত মলি্লক, সুচিত্রাকন্যা মুনমুন ও সূর্য চ্যাটার্জি বজরার ওপর বসা, আমার সঙ্গে সবারই কুশলবিনিময় হলো। আমি সূর্য চ্যাটার্জির কাছে জানতে চাইলাম তিনি কোথায়।
সূর্যদা হাতের ইশারায় আমাকে ধৈর্য ধরতে বললেন। আমি বসলাম, চা বিস্কিট খেলাম, নদীর ওপরে বজরায় দেবী চৌধুরানীর ভূমিকায় সুচিত্রা সেন, তার স্বামীর ভূমিকায় রঞ্জিত মলি্লক এবং বনানি পাঠকের ভূমিকায় বসন্ত চৌধুরী, সবার একসঙ্গে একটা দৃশ্য ধারণ হলো। পরিচালক নিজেই এখানে চিত্রগ্রাহক, তাই কাউকে আর 'কাট' বলতে হলো না। দীনেন গুপ্ত বললেন, ok now for lunch.
খেয়াল করলাম বজরার ওপর ছোট্ট একটা কক্ষ, যেখান থেকে মহানায়িকা বেরিয়েছিলেন সেখানে চলে গেল। সাধারণত পরিচালক, নায়ক-নায়িকা একসঙ্গে আহার করে, এখানকার দৃশ্যপট ভিন্ন ছিল, পরিচালক, নায়ক এবং অন্যান্য শিল্পীসহ আমরা নিচে খেতে গেলাম, মুনমুন তার মায়ের কাছে না গিয়ে আমাদের সঙ্গে খেতে চলে এলো।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আরও দু-তিনটা দৃশ্য ধারণের পর আমার সুযোগ হলো সাক্ষাৎকার গ্রহণের। আমি অবাক ও মুগ্ধতায় নিজের ভেতরে নিজেকে কাঁপাচ্ছি। মিসেস সেন আমাকে বসতে বললেন। আমি প্রশ্ন করার আগেই তিনি জানতে চাইলেন বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? আমি হ্যাঁ, জি, আগে এই তিনটার কোনটা বলেছি আমার মনে নেই। যখন নিজেকে নিজের মধ্যে শান্ত করলাম তখন অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে।
লক্ষ্য করলাম মহানায়িকা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আবারও আমি প্রশ্ন করার আগে তিনি জানতে চাইলেন বাংলাদেশে আমাদের ছবি দেখানো হয়? আমি হ্যাঁ-না মিলিয়ে মাঝামাঝি একটা জবাব দিলাম। তারপর এক এক করে নানা প্রসঙ্গ। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি দ্বিতীয়বার আর তার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ না-ও পেতে পারি। তাই গৎবাঁধা সাধারণ কিছু প্রশ্ন করলাম, তিনি জবাব দিলেন।
আমি যখন জানতে চাইলাম বাংলাদেশে কোনো ছবিতে অভিনয়ের ডাক এলে সম্মত হবেন কিনা। মুখের কোণে মিষ্টি একটু হাসি দিয়ে বললেন, ইচ্ছা আছে। ওটাও আমার জন্মস্থান যেতে পারলে আমারও ভালো লাগবে।
পরবর্তী সময়ে তাকে এবং উত্তম কুমারকে নিয়ে আমি একটা ছবি বানানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'অভিমান' অবলম্বনে সে ছবির জন্য উত্তম কুমারের শিডিউল পাওয়ার পর মহানায়িকার কাছে আরেকবার গিয়েছিলাম তার বাড়িতে।
বাড়ি যাওয়ার এই সুযোগটা করে দিয়েছিলেন বিশিষ্ট প্রযোজক অশিথ চৌধুরী, মাত্র ১৫ মি. সময় সাক্ষাৎ, কথা হয়েছিল হাতেগোনা পাঁচ-সাতটি, তিনি রাজি ছিলেন। কিন্তু শিডিউল মেলাতে মেলাতে উত্তম কুমার চলে গেলেন পরপারে। তিনিও অভিমানে চলে গেলেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে। তাই আমার অভিমান অভিমান করেই অসমাপ্ত রয়ে গেল।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আরও কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে।
কখনো স্টুডিওতে মেকআপ রুম থেকে শুটিং ফ্লোরে যেতে দেখেছি। ডাবিং থিয়েটারে ডাবিং করতে দেখেছি। একটা জিনিস বুঝেছি প্রতিভায় তিনি ছিলেন হিমালয়ের মতো, জনপ্রিয়তায় ছিলেন আকাশের শেষ সীমায় সীমাহীন। এরচেয়েও যেটা বড় ছিল সেটা হলো, তার ব্যক্তিত্ব। একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব কতটা ইস্পাত কঠিন হতে পারে সুচিত্রা সেনকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
সুচিত্রা সেন যে কোনো চরিত্রে অভিনয় এবং ঘরে-বাইরে, স্টুডিও কিংবা শুটিং লোকেশনে, সবখানেই মনে হয়েছে তিনি যতটা না মানুষ তার চেয়ে বেশি শিল্পী। হাঁটায়, বসায়, কথা বলায়_ সবখানে তিনি যে নায়িকা-মহানায়িকা, তা একবারও বলতে দেখিনি। এই মহান শিল্পীর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। চিরকাল তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুন এই প্রার্থনা।
লেখক : সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।