আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অশ্বিনীকুমার দত্তঃ বরিশালের মুকুটহীন সম্রাট

আমি দুয়ার খুলে বের হয়ে জোছনা ধরতে যাই। আমার হাত ভরতি চাঁদের আলো ধরতে গেলে নাই!


অশ্বিনীকুমার দত্ত [২৫শে জানুয়ারি ১৮৫৬-৭ই নভেম্বর ১৯২৩] ছিলেন একজন বাঙালি রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সমাজসেবক, লেখক এবং স্বদেশী তথা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যাক্তি। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত বাংলার বরিশাল এর গৌরনদীর অন্তর্গত বাটাজোড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্ত ছিলেন সাব জজ। বরিশালে বিভিন্ন সমাজহিতৈষী এবং কল্যাণমূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী তাঁকে “অদ্বিতীয়” নেতা বলে শ্রদ্ধা জানান।

আধুনিক বরিশালের রূপকার অশ্বিনীকুমার দত্ত শুধুমাত্র ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন অন্যতম বিপ্লবী কর্মীই ছিলেন না বরং তিনি আমৃত্যু রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বরিশালবাসীর জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন। আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি ১৮৮৪-১৯২৩ সাল পর্যন্ত শুধু বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদেরই মানুষ করেননি বরং সমাজের অনেক অশিক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

অশ্বিনীকুমার দত্তের পড়াশোনা হয় কলকাতায় এবং ছাত্রাবস্থাতেই তিনি রামতনু লাহিড়ী, রাজনারায়ন বসু এবং কেশবচন্দ্র সেন এর মতো মনিষীদের কাছে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। শুধু তাই নয় অশ্বিনীকুমার মাঝে মাঝেই দক্ষিণেশ্বর এ গিয়ে দর্শন করতেন ঠাকুর রামকৃষ্ণকে। সেখানেই তাঁর পরিচয় হয় নরেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে [যিনি পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ বলে পরিচিত হন] ।

এইসব লোকজনের সংস্পর্শে অশ্বিনীকুমার বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।
১৮৭৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ এবং একই বছর বি.এল পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হন। ওই বছর তিনি শ্রীরামপুরের নিকট চাতরা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এই স্কুলের সার্বিক উন্নয়ন করতে সক্ষম হন। ১৮৮০ সালে বরিশালে এসে তিনি ওকালতি পেশা শুরু করেন।



অশ্বিনীকুমার যখন বি.এল পাস করে আইন ব্যাবসা শুরু করেন বরিশালে তখন সেইখানে এক অরাজক অবস্থা বিরাজ করছিল। বার লাইব্রেরীতে উকিলরা অত্যন্ত কদর্য আর অশ্লীল ভাষায় কথা না বলে আনন্দ পেতেন না। অতিরিক্ত মদ্য পান এবং গনিকালয় এ যাওয়া অনেক কৃতিত্বর মনে করা হতো। সে সময় সার্থক উকিলেরা তাদের প্রিয় গনিকার বাড়িতে বসেই মক্কেলদের সাথে কথাবার্তা বলতেন। আদর্শবান এবং চরিত্রবান উকিল অশ্বিনীকুমার এই পরিস্থিতি সহ্য করতে পারলেন না।

উকিলদের এইসব জঘন্য কার্যকলাপ এর জন্য তিনি নিজে উকিল হয়েও ওইসব উকিলদের বিরুদ্ধে বার লাইব্রেরী, কোর্ট চত্তর ও পথে ঘাটে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। তাঁর আবেদনময় এবং যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা শুনে বরিশাল শহরের মানুষ শুধু অনুপ্রানিত ও মুগ্ধ হতো না বরং তারা প্রকাশ্যই ওই উকিল আর ধনীদের অশ্লীলতা আর কদর্যতার বিপক্ষে মুখর হয়ে উঠলো। তাঁর এই উদ্যোগ এর কারনেই বন্ধ হল উকিলদের এই কদর্যতা।
অশ্বিনীকুমার শুধুমাত্র উকিলদের সংযত করেই খুশি হলেন না বরং তিনি পথে-ঘাটে, হাতে-বাজারে, ষ্টীমার ঘাটে ও মাঝি-গোয়ালা থেকে শুরু করে চাত্র-শিক্ষক-অধ্যাপকদের সামনেও জীবনে সত্য-প্রেম-পবিত্রতা সম্পর্কে অত্যন্ত আবেগময় কিন্তু যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন এবং আপামর সাধারণ মানুষও প্রভাবিত হতে আরম্ভ করলো।
সেসময় বরিশালের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা নানাদিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল।

রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয় তা থেকে বরিশাল ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। গুটিকয়েক জমিদার ও সরকারি কর্মচারীর পরিবার ছাড়া বরিশালের প্রায় গোটা সমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে ছিল সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে।
১৮৮২ সালে অশ্বিনীকুমার ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হন। এ সময় তিনি বরিশালের ছাত্রসমাজের উন্নতির জন্য নিরলসভাবে নানাবিদ কাজ করতে শুরু করেন। বরিশালের যুবসমাজ অশ্বিনী কুমারের জীবনাদর্শ "সত্য প্রেম পবিত্রতা"র মন্ত্র গ্রহণ করে।

ব্রাহ্মসমাজ ও অশ্বিনী কুমারের উদ্যোগে সেবক দল গঠন করা হয়। এই সেবক দল ছাত্রসমাজের শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এতে করে বরিশালের গণমানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের এক নবজাগরণ ঘটে। ফলে ধীরে ধীরে মানুষের চেতনা থেকে মধ্যযুগীয় চিন্তা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটে।
১৮৮৪ সালে বরিশালে হাজারে মাত্র ৭ জন শিক্ষিত ছিল।

তখন সমগ্র জেলায় ১৫ জনের মতো গ্রাজুয়েট ছিল। সমাজ জীবনে বিশেষত: অভিজাত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মধ্যে দুর্নীতি, ব্যাভিচার, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও অনৈতিকতা জেঁকে বসেছিল। অশ্বিনীকুমার দত্ত বরিশালের এই দুর্দশা দেখে মর্মাহত হন এবং এসব প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।
অশ্বিনীকুমার সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে সৎ শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরী এবং সেই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ১৮৮৪ সালে পিতার নামে ব্রজমোহন বিদ্যালয় এবং তার পাঁচ বছর পরে ১৮৮৯ সালে ব্রজমোহন কলেজ স্থাপন করলেন। এই কলেজও সারা বাংলায় খ্যাতি অর্জন করেছিল।

এই সময়েই তিনি উপলব্ধি করলেন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ওকালতি করা যায় না এবং ওকালতি ছেড়ে তিনি শিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি নিজের গ্রাম বাটাজোড় এও একটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করলেন।
অশ্বিনীকুমারের আন্তরিকতাপূর্ণ কথাবার্তা, উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা ও সমাজ-সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে অল্পদিনের মধ্যে তিনি সবার প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন । ক্রমে ক্রমে তাঁর প্রচেষ্টা সফল হতে থাকে। তিনি নানাবিধ দুর্নীতি, অসামাজিক কার্যকলাপ, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা ও সংগীতের পাশাপাশি জনসাধারণের প্রতিনিধি সভা সংগঠিত করেন।


বরিশালের সমাজজীবনে তিনি প্রথম রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করেন। গঠন করেন বরিশাল জনসাধারণ সভা। এই রাজনৈতিক সংগঠনটিকে তিনিই ধীরে ধীরে শক্তিশালী রূপে গড়ে তোলেন। জাতীয় কংগ্রেসের আগে এই রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়। ১৮৮৬ সাল থেকে বরিশাল জনসাধারণ সভা কংগ্রেসের সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করে।



১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগের কারণে স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন গড়ে ওঠে। বয়কট আন্দোলন এক সময় স্বরাজলাভের আন্দোলনে রূপ নেয়। এসময় বাংলা বিভক্তির প্রতিবাদে অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে বরিশালে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। বরিশালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যতটা তীব্র আকার ধারণ করেছিল বাংলার আর কোথাও তার নজির নেই। তিনি ছিলেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অগ্রনায়ক।

এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটান। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় অশ্বিনীকুমার যখন বরিশাল বা অন্যত্র বক্তৃতা দিতেন, তখন সেই বক্তৃতার আগে জাতীয় সংগীত গাওয়া হত। জাতীয় সংগীতের পরে দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হত। কিন্তু সেসময় তেমন দেশাত্মবোধক গান ছিল না। তাই এসময় তিনি বেশকিছু দেশাত্ববোধক গান রচনা করেন।



এক কথায় রাজনীতি, সমাজকল্যাণ ও শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তাঁকে বলা হতো “বরিশালের মুকুটহীন সম্রাট। “ তিনি ১৯২৩ সালের ৭ ই নভেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
আজ তাঁর ১৫৮ তম জন্মবার্ষিকীতে এই মহান শিক্ষানুরাগীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্রঃ
১. “অশ্বিনীকুমার দত্ত”, গুণীজন ডট কম।


২. নিমাই ভট্টাচার্য, “মহাজাগরন”, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৪।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।