আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তঃ আধুনিক বরিশালের রূপকার

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
আধুনিক বরিশালের রূপকার মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী। তিনি আমৃত্যু রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বরিশালবাসীর জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন। দক্ষিণ বাংলার প্রাণ পুরুষ ১৮৮৪-১৯২৩ সাল পর্যন্ত আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি শুধু বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদেরই মানুষ করেন নি, বরং সমাজের অনেক অশিক্ষিত, অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বাণ্ডুলে স্বভাবের বখাটে মুকুন্দদাসকে তিনিই দিনের পর দিন বাড়িতে ডেকে এনে আদর স্নেহ ভালবাসার সহচর্য দিয়ে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুললেন।

যার কারণে মুকুন্দদাস একসময় চারণ সম্রাট হতে পেরেছিলেন। ১৯০৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন চলার সময় বরিশালের টাউন হলে অশ্বিনী কুমার বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে জোরদার করা প্রসঙ্গে তার উপলব্দির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন_ ‘আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি, যদি কেউ তা যাত্রাপালা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা_ আমাদের এরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে’। অশ্বিনী কুমার দত্তের এই বক্তব্য মুকুন্দদাস খুবই গুরুত্বসহকারে নিলেন।

মাত্র ৩মাসের মধ্যে রচনা করলেন অসাধারণ যাত্রাপালা ‘মাতৃপূঁজা’। মাতৃপূঁজার মূল বিষয় ছিল দেশপ্রেম। দেশমাতৃকাকে একত্রীকরণের লক্ষ্যে তার সন্তানরা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে ভারতমাতাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করবে। শুধু মুকন্দদাস নয়, শত শত মানুষকে তিনি সমাজ বদলের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। অশ্বিনীকুমার দত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার ও চেতনায় আস্থাবান ছিলেন।

জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সারা জীবন লড়াই করেছেন। জনগণই ক্ষমতার উৎস এবং জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে- এ দাবির সমর্থনে তিনি ১৮৮৫-৮৬ সালে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক জনসভা করেন এবং আইনসভা বা পার্লামেন্ট গঠনের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। এ সময় তিনি ৪০ হাজার বরিশালবাসীর স্বাক্ষর জোগাড় করে আইনসভা প্রতিষ্ঠার জন্য তা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করেন। মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের জন্ম ১৮৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারি। তৎকালীন বরিশাল জেলার পটুয়াখালী মহকুমায়।

তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলাধীন বাটাজোর গ্রামে। বাবা ব্রজমোহন দত্ত। তিনি ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। অশ্বিনীকুমার দত্তের পড়শুনার হাতেখড়ি গুরুমশাইয়ের কাছে। তিনি তাদের বাড়িতে পড়াশুনা করাতেন।

পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশুনা তাঁকে পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সম্পন্ন করতে হয়। তারপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে আইন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ২৩ বছর বয়সে বিএ এবং এক বছর বাদে এমএ বিএল ডিগ্রী অর্জন করেন। অশ্বিনী কুমার ১৮৮০ তিনি বরিশালে আসেন।

এ সময় তিনি আইন ব্যবসার যুক্ত হন। ঠিক সেই সময় বরিশালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয় তা থেকে বরিশাল ছিল বিচ্ছিন্ন। গুটিকয়েক জমিদার ও সরকারি কর্মচারীর পরিবার ছাড়া বরিশালের প্রায় গোটা সমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। ১৮৭৪ সালে হাজারে মাত্র ৭জন ছিল শিক্ষিত।

তখন সমগ্র জেলায় ১৫ জনের মত গ্রাজুয়েট ছিল সমাজ জীবনে বিশেষত অভিজাত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মধ্যে দুর্নীতি, ব্যভিচার, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও অনৈতিকতা জাঁকিয়ে বসেছিল। অশ্বিনী কুমার বরিশালের এই দুর্দশা দেখে মর্মাহত হলেন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিলেন। ১৮৮২ সালে তিনি ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হন। এ সময় তিনি বরিশালের ছাত্রসমাজের উন্নতির জন্য নিরলস কাজ করতে শুরু করেন। বরিশালের যুবসমাজ অশ্বিনী কুমারের সত্য প্রেম পবিত্রতার আদর্শ গ্রহণ করে।

ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে সেবক দল গঠন করা হয়। এই নবজাগরণের ফলে ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় চিন্তা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটে। বরিশালের শিক্ষা ক্ষেত্রেও অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়। অশ্বিনী কুমারের আন্তরিকতাপূর্ণ কথাবার্তা এবং উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতায় ও সমাজ-সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে তিনি অল্পদিনে লোকমানসে স্থান করে নিলেন। ক্রমে ক্রমে তার প্রচেষ্টা সফল হতে থাকে।

তিনি নানাবিধ দুর্নীতি, অসামাজিক কার্যকলাপ, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা ও সংগীতের পাশাপাশি জনসাধারণের প্রতিনিধি সভা সংগঠিত করেন। ১৯৮৯ সালে ৯ বছর ওকালতির করার মাথায় মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় বলে তিনি আইন ব্যবসাকে ত্যাগ করেন। তিনি বরিশালের সমাজজীবনে প্রথম রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি করেন। গঠন করেন বরিশাল জনসাধারণ সভা। এই রাজনৈতিক সংগঠনটিকে তিনিই ধীরে ধীরে শক্তিশালী রূপে গড়ে তোলেন।

জাতীয় কংগ্রেসের আগেই এই রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়। ১৮৮৬ সাল থেকে বরিশাল জনসাধারণ সভা কংগ্রেসের সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করে। ১৮৮৪ সালে আশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পিতার নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন ইন্সটিটিউশন। ব্রজমোহন ছিল বৃহত্তর বরিশালের বঙ্গভঙ্গ, অসহযোগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলকেন্দ্র। ব্রজমোহন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫ বছর পর ১৮৮৯ সালে অশ্বিনী কুমার ব্রজমোহন বিদ্যালয়কে কলেজরূপে প্রতিষ্ঠা করেন।

অশ্বিনী কুমারের সর্বত্যাগী নেতৃত্ব ও শিক্ষা আন্দোলনের ফলে কয়েক বছরের মধ্যে বিএম কলেজ ও বরিশাল সারাবাংলায় খ্যাতি অর্জন করে। অশ্বিনী কুমার তার বিচক্ষণতা দিয়ে অনুভব করলেন গণশিক্ষা ছাড়া গণজাগরণ সম্ভব নয়। মানুষকে যদি প্রকৃত শিক্ষা প্রদান করা যায় তবেই তারা রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠবে। গণশিক্ষা বিস্তারে ব্রজমোহন স্কুল ও কলেজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা অশ্বিনী কুমারের স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করে গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকতার জীবন গ্রহণ করেন।

তারাই পরবর্তীকালে বরিশালকে এক বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত করেন। ২০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯০০সালে বরিশালে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা ২৫০ জনে দাঁড়ায়। গণচেতনা সৃষ্টির তাগিদে এ সময় তিনি সংবাদপত্রের অভাব বিশেষভাবে অনুভব করেন। তাঁর চেষ্টায় ফলে বিকাশ, স্বদেশী, বরিশাল, বরিশাল হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বরিশাল হিতৈষী ও স্বদেশী অসহযোগ আন্দোলনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে।

অশ্বিনী কুমারের একান্ত চেষ্টায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। জনপ্রিয়তার কারণে তিনি বরিশাল পৌরসভা ও লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসময় তিনি একে ফজলুল হককে পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত করেন। মূলত অশ্বিনীকুমারের হাতেই ফজলুল হককের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়। অশ্বিনী কুমার ১৮৮৭ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সম্মেলনে ভারতে আইনসভা প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন।

ওই বছরই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি কংগ্রেসের আপসকামীতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণসর্বস্ব রাজনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। অশ্বিনী কুমারই প্রথম ব্যক্তিত্ব, যিনি সর্বপ্রথম কংগ্রেসের প্রাসাদ রাজনীতিকে জনগণের দোরগোড়ায় আনতে ব্রতী হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগের কারণে স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন গড়ে ওঠে। বয়কট আন্দোলন এক সময় স্বরাজলাভের আন্দোলনে রূপ নেয়।

এসময় বাংলা বিভক্তির প্রতিবাদে অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে বরিশালে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। তিনি ছিলেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অগ্রনায়ক। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটান। অশ্বিনী কুমারের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে চারণ কবি মুকুন্দদাস। এই আন্দোলনকে সফল করার জন্য অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে স্বদেশীবান্ধব সমিতি শহরে ও গ্রামে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করত।

সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সরকার অশ্বিনী কুমারসহ ৯ নেতাকে তিন আইনে গ্রেফতার করে নির্বাসন দেয়া হয়। অশ্বিনী কুমারকে রাখা হয় লক্ষ্ণৌ জেলে। ১৯১০ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তির পর তিনি জেলা সমিতির সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। সমিতির পক্ষ থেকে প্রচারক পাঠিয়ে গ্রামে গ্রামে নিম্ন বিদ্যালয় স্থাপন, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত গ্রামে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেন।

১৯২১ সালে বরিশালে স্টিমার ধর্মঘটের সময় অসুস্থ দেহে অশ্বিনী কুমার স্বেচ্ছাসেবকদের যাবতীয় কাজ দেখভাল করেন। ১৯১০-২৩ সাল পর্যন্ত মূলত অসুস্থ্য ছিলেন বলা যায়। এ সময়কালে তিনি রোগের সঙ্গে নিয়ত বোঝাপড়া ও দেশ পর্যটনে সময় কাটিয়েছেন। ১৯২২ সালে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯২৩ সালে ৭ নভেম্বর তিনি কলকাতায় মারা যান।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.