জীবন যেখানে যেমন...
৪র্থ অংশের পরঃ
জমিদারবাড়ির প্রধান ফটকের আগেই রাহিকে পেয়ে যায় তানিম আর আবির। রাহি ভিতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় তানিম ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকি দেয়, “এই রাহি, কোথায় যাচ্ছিস?” রাহি কোন উত্তর দেয় না। এক ঝটকায় তানিমকে মাটিতে ফেলে দেয় রাহি। আবার ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা চালায় সে। আবির আর তানিম মিলে জাপটে ধরে রাহিকে।
রাহির মধ্যে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। দুজন মিলেও কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না রাহিকে।
এক দৌড়ে মালিহা আর নিশির ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ায় রিশাদ। মালিহার ব্যাগ তন্ন তন্ন করে খোঁজে। কিন্তু ‘পুরনো পাণ্ডুলিপি’ মেলে না।
রিশাদ ভাবতে থাকে রাহিকে জমিদারবাড়িতে ঢুকাতে পারলে আর ওকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। এক অজানা আশঙ্কায় রিশাদের বুক কেঁপে ওঠে। মালিহা আর নিশিকে বলে কাউকে কিছু না জানাতে। আর ওরা যাতে ঘরের বাইরে না বেরোয় এ ব্যাপারেও সতর্ক করে যায় রিশাদ।
রাহিকে আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে তানিম আর আবির।
কিছুক্ষণ পর রিশাদও এসে যোগ দেয় ওদের সাথে। এরই মাঝে এশার আযান ভেসে আসে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে তিনজন। রাহি মাটিতে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। রিশাদ তানিম আর আবিরকে প্রতিজ্ঞা করায় যাতে এ ঘটনা কেউ জানতে না পারে।
তিনজনে মিলে রাহিকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে। ছেলেদের ঘরে মেহমান থাকায় মালিহা আর নিশির ঘরেই শুইয়ে দেয় রাহিকে। ইতোমধ্যে নাহিয়ান আর বাবলুও চলে এসেছে। রিশাদ সবার উদ্দেশ্যে বলে, “এ কথা যেন কেউ জানতে না পারে। অল্পের জন্য আজ বেঁচে গেছে রাহি।
মালিহা বইটা তুমি কোথায় পেয়েছিলে?” আতঙ্কে আর ভয়ে মালিহার মুখ তখন শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। সে কাঁচুমাচু করে বলে, “রুপালীর ঘরে। আমি ভেবেছিলাম কোন পুরাতন সাহিত্যের বই। তাই কাউকে না বলেই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিই। আমি বুঝতে পারি নি যে সামান্য একটা বইয়ের জন্য এত কিছু ঘটে যাবে।
” নিশি সান্ত্বনা দেয়, “যাক, যা হয়েছে বাদ দাও। ভাইয়া এখন চল। আমরা সবাই এখানে থাকলে সবাই সন্দেহ করবে। ” নাহিয়ান বলে, “কিন্তু রাহির পাশেও তো একজন থাকা দরকার। ” মালিহা জানায় সে থাকবে।
বাকিরা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। শুধু নিশি যাবার আগে একবার মালিহাকে চোখ টিপ দিয়ে যায়, “মালু শেষমেশ কবিকেই ধরলি?” মালিহা বুঝেও না বোঝার ভান করে। ওরা সবাই চলে যাওয়ার পর সে রাহির মুখের দিকে তাকায়। খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর নাকের উপর পুরু ফ্রেমের চশমায় মানুষটিকে সুদর্শনই মনে হয় তার কাছে। নিশির বলা কথাটা ভাবে সে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা লাজুক হাসিতে ভরে ওঠে ছোট ঘরটা। আধপাগল কবি মানুষটার জন্য বুকের মাঝে এক ধরণের শূণ্যতা অনুভব করে মালিহা। না এমনটা তো তার পনের বছরের জীবনে কখনোই হয় নি। এ এমন এক অনুভূতি যার কোন সংজ্ঞা এ মূহুর্তে তার জানা নেই। অদ্ভুত এক ঘোরের মাঝে একা ঘরে সংজ্ঞাহীন রাহির পাশে বসে থাকে মালিহা।
অনেক হাসি আর গল্পের আওয়াজে ঘুম ভাঙে ফারজানার। গায়ে এখনও প্রচণ্ড জ্বর। চারদিকে তাকিয়ে দেখে ও রিশাদের বাবা-মার ঘরে শুয়ে আছে। একা একা শুয়ে থাকতে বেশ অস্বস্তি লাগছিল ফারজানার। হাত বাড়িয়ে মোবাইল সেটটা নিয়ে তানিমের নাম্বার ডায়াল করে সে।
দু’মিনিটের মধ্যে তানিম ঘরে প্রবেশ করে। ফারজানার কপালে হাত দিয়ে বলে, “উঠো না। গায়ে এখনও অনেক জ্বর। মনে হয় কালকে যেতে পারলে না আমাদের সাথে। ” “গিয়ে কিন্তু আমাকে ফোন করবে।
আর মেয়ে পটানোর try করবা না। ”, ফারজানা ওকে সতর্ক করে দেয়। “আরে বাবা, সন্ধ্যার মধ্যেই তো চলে আসব। ”, মুচকি হেসে ওর হাতটা ধরে ওকে নিশ্চিন্ত করে তানিম। “যাও, এখন নিশিকে পাঠিয়ে দাও।
আমার খুব খিদে পেয়েছে। ”
খুব ভোরে সরগরম হয়ে ওঠে চৌধুরীবাড়ি। রাহাত ভাইকে বরবেশে সবার মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। মোটামোটি সবাই তৈরি বরযাত্রায় যাবার জন্য। রিশাদের মা, নানী আর এক চাচী থেকে গেলেন।
এদিকে রাহির জ্বর আসায় ও আর ফারজানাও যেতে পারছে না। আর এক অজ্ঞাত কারণে মালিহা আর তার দেখাদেখি তার প্রিয় বান্ধবী নিশি যাবে না। বিভিন্ন বয়সের একটা বরযাত্রী দল কুয়াশা ভেদ করেই বেরিয়ে পড়ে। নদীর ঘাটে একটা লঞ্চ রাখা আছে। সড়কপথে ভেঙে ভেঙে যেতে হবে বিধায় লঞ্চটা ভাড়া করা হয়েছে।
রিশাদদের পাশের ইউনিয়নে কনেদের গ্রাম। সবাই উঠে বসলে ছেড়ে দেয় লঞ্চ। সূর্য তখনও আরাম করে কুয়াশার লেপ জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। দোতলা লঞ্চের কেবিনে বসে সবাই গল্পে মেতে ওঠে। দোতলায় লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে নাহিয়ান।
সব আনন্দ ছাড়িয়ে তার মন আজ অন্যদিকে। শেষবার লঞ্চে চড়ার স্মৃতি মনে পড়ে যায় তার। তন্বী আর সে লঞ্চে করে সুন্দরবন যাচ্ছিল। কলেজ থেকে শিক্ষাসফরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ওদের। রিশাদ, তানিম আর ফারজানাও ছিল ওদের সাথে।
স্কুল থেকেই ওদের সাথে নাহিয়ানের বন্ধুত্ব। বাবলু, আবির আর রাহি ওদের ভার্সিটি লাইফের বন্ধু। ফারজানা তানিমকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, “এই নাহিয়ান কই গেল?” রিশাদ হেসে বলে, “তন্বীর সাথে হানিমুনে। ” তানিম নিরুৎসাহের ভান করে বলে, “বাদ দে তো প্রেমের মতো ফালতু topic.” রিশাদ বলে, “যখন নিজে পড়বি তখন বুঝবি প্রেম কি জিনিস। ” একটু মুচকি হাসে নাহিয়ান।
তন্বীর হাতটা তবু ছাড়ে না। তন্বী আবারও বলে, “এই কেবিনে চলো। রিশাদরা কি ভাবছে বলো তো? তাছাড়া স্যার চলে আসতে পারেন যেকোন মূহুর্তে। ”, তন্বী বলতেই থাকে। নাহিয়ান পড়ন্ত সূর্যের আভায় তন্বীকে দেখতেই থাকে।
তন্বীর ঠোঁটের প্রতিটি কুঁচকানো দাগগুলো নিরীক্ষণ করতে থাকে।
নাহিয়ান পকেট থেকে রুমাল বের করে। আলতো করে বাঁ চোখটা মোছে। করুণ সুরে তার মোবাইলটা বেজে ওঠে। মোবাইলের স্ক্রিণে একটা নাম দেখে চমকে যায় সে।
নিশি calling.
“হ্যালো, নাহিয়ান ভাই। ”
-“বলো। ”
“কি করেন?”
-“রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ”
“সে কি! ঝাঁপ দেবেন না যেন। ”
-“আমি মরলে কার কি এসে যাবে?”
“আমার কিছু এসে যাবে।
”
-“কি?”
“কিছু বোঝেন না? সব কি খুলে বলতে হবে?”
নাহিয়ান কলটা ডিসকানেক্ট করে দেয়। মোবাইলটা ভাইব্রেশন মোডে দিয়ে দেয়। মুঠোফোনে কম্পন শুরু হয়। নাহিয়ান গোনে। এই মূহুর্তে গুনতে তার ভালো লাগছে।
একুশবার গুনে সে মোবাইলটা সুইচড অফ করে দেয়। একটি সদ্যপ্রস্তুত হাসি নিয়ে কেবিনে ফিরে যায়।
রাহিকে ঘিরে বাসায় একটা গোলটেবিল বৈঠকের সূচনা হয়েছে। রাহির ভাষ্যমতে, ও ‘পুরনো পাণ্ডুলিপি’টা কোন পুরনো বই মনে করে। ইন্টারেস্টিং হবে মনে করে পড়তে শুরু করে।
পড়তে পড়তে ওর মনে হতে থাকে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। ঠিক যখনই ওর পড়া শেষ হয়। কাঁধে একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস অনুভূত হয়। তার পর ওর আর কিছু মনে নেই। নিশি বলে, “থাক যা হওয়ার হয়েছে।
বাদ দিন। আপনি এখন থেকে যতদিন আমাদের এখানে আছেন কোথাও একা যাবেন না। আমাকে বা মালুকে সাথে নিয়ে যাবেন। ” রাহি নিশির প্রস্তাব মেনে নেয়।
(চলবে)
৪র্থ অংশের লিঙ্কঃ
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।