আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চামেলী হাতে কিছু নিম্নমানের মানুষ (ক্রমশ)

আমার কখনো এতো রাগ ওঠে না। আজ কী করে যে এতো রাগ উঠে গেলো---বুঝতে পারলাম না।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি। পরপর দুটো ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেছি রাতে। একটা মধ্যরাতে, আরেকটা ভোররাতে।

কাজেই, সকালবেলা মরার মত ঘুমুচ্ছিলাম।
ঘুম ভাঙে গেলো বাবার চিৎকার-চেঁচামেচিতে।
কী করে তোমার ছেলে? তিন মাস হয়ে গেলো---একটা চাকরি যোগাড় করে পারে না। বালের পড়াশোনা করসে তোমার ছেলে। বালের পড়াশোনা করসে---এইসব শুনতে শুনতে আমি হাতমুখ ধুচ্ছিলাম।


আমি বিশ বছর আমার বাপ-মা’রে খাওয়াইসি। তোমার ছেলে দিসে ঘরে একটা টাকা? দিসে ঘরে একটা টাকা?---বাবা তার ঘর থেকেই সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন।
আমি নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছি। এমন না যে এইসব কথাবার্তা আজকেই প্রথম শুনছি। কাজেই, নিজের সহ্যশক্তির একটা লিমিট গড়ে উঠেছে।


আমি দশ বছর মেস করসি। দশ বছর মেস করসি। বাজার করসি, কাপড় ধুইসি। তোমার ছেলে কোন একটা কাজ করসে জীবনে? বাজারটাও তো ঠিকমত করতে পারে না।
আমি তখন পাউরুটিতে জেলী মাখিয়ে খাচ্ছি।

খাওয়াটা গলায় আটকে যাচ্ছে। খাওয়ার সময় কথা শুনতে ভালো লাগে না। মনে হয়---বাবারটা খাচ্ছি দেখে এই খোঁটা শুনতে হচ্ছে। এর চেয়ে উপোস থাকা ভালো।
টিউশনির টাকাও তো তোমারে কোনদিন দেয় নাই।


এই কথাটা মিথ্যে। মা যখনই যা আবদার করেছেন---ব্যাগটা, ঘড়িটা, চুড়িটা, আমি যতোটুকু সাধ্য কনট্রিবিউট করেছি।
দেখো গিয়া কোন মেয়ের পিছনে খরচ করে। আমরা কী ছিলাম আর আমাদের ছেলেগুলা কী হইলো...
এইবার আমার মেজাজ সত্যিই বিগড়ে গেলো। হাতের কাছে একটা গ্লাস ছিল।

সেটাই সজোরে ছুঁড়ে মারলাম মেঝ বরাবর। গ্লাসটা ভেঙে টুকরোগুলো ঘরময় ছড়িয়ে গেলো। মা ‘কী হইসে, কী হইসে’ বলে ছুটে এলেন। আমি ততক্ষণে দরজা খুলে বাইরে চলে এসেছি। মুশফিক জিজ্ঞেস করলো, কই যাচ্ছি? আমি ক্ষণিকের জন্য পিছু ফিরে তাকালাম।

তারপর দরজায় একটা লাথি দিয়ে হনহন করে নিচে চলে এলাম।
আমার সারা শরীর তখন রাগে থরথর করে কাঁপছে। চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। বাবাকে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে পারলে ভালো হত। ঠাণ্ডা মাথায় বলা উচিত ছিল, বাবা, তুমি যা ভাবছো, তা সত্য নয়।

মা যখনই যা আবদার করেছেন---ব্যাগটা, ঘড়িটা, চুড়িটা, আমি যতোটুকু সাধ্য কনট্রিবিউট করেছি। তুমি কখনো মুখ ফুটে কিছু চাওনি, তাই ওভাবে দেয়াও হয়নি। কিন্তু একটা ভালো, নাহ ভালো না, মোটামুটি চাকরি পেলেও আমি তোমাকে একটা পাঞ্জাবি আর একটা রোলেক্সের ঘড়ই দেব বলে ঠিক করেছি। মা’র জন্য দেশি দশ থেকে একটা ডিজাইনার’স শাড়ি আর লেটেস্ট মডেলের ব্যাগ। আর আমি কোন মেয়ের পেছনে কিছু খরচ করি না।

সেই ভাগ্য আমার নেই আর সামর্থ্যও নেই। আমার অনেক বন্ধুই তাদের গার্লফ্রেণ্ডদের নিয়ে রেগুলার বিএফসি-কেএফসি করে। আমার দৌড় ঠাটারিবাজারের স্টার কাবাব পর্যন্ত। তাও শেষ কবে ওখানে গিয়ছিলাম, খেয়াল নেই। র্যা গের সময় হবে সম্ভবত।


সমস্যা হচ্ছে বাবার সামনে গেলেই আমার গলা কেঁপে ওঠে। কথা গুলিয়ে যায়। সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে উলটো কণ্ঠস্বর আচমকাই চড়ে ওঠে। ফলাফল একটা বেয়াদব ছেলের জন্ম দিয়ে বাবার হা-হুতাশ।
রিকশায় বসে বসে এইসব যখন ভাবছি, তখনই বুঝলাম, একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে।

মানিব্যাগটা নিয়ে আসা হয়নি। গাঁটে একটা পয়সা নেই। মোবাইলটা সঙ্গে আছে---এইটুকুই যা রক্ষে।
হলের সামনে রিকশা থামিয়ে সৌরভকে ফোন দিলাম। বললাম, একশোটা টাকা নিয়ে নিচে নাম।


রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সৌরভের রুমে গেলাম। সৌরভ জিজ্ঞেস করলো, হঠাৎ হলে কী মনে করে? আমি কোন উত্তর না দিয়ে ওর বেডে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। এখন সেটা উশুল করতে হবে।
তোর শরীর তো কাঁপছে।

জ্বর-টর আসলো নাকি?
আমি এবারও ওর প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
ঘুম ভাঙলো বিকেলে। সৌরভ রুমে নেই। তার মানে টিউশনিতে গিয়েছে অথবা পলাশীতে মনির মামার চায়ের ওখানে।
মোবাইলে আঠারোটা মিসড কল উঠে আছে।

কিছু মা’র নম্বর থেকে, কিছু মুশফিকের।
মা এখন কী ভাবছেন? সম্ভবত এই যে তার ছেলে সারাদিন ঘুরেফিরে ক্লান্ত হয়ে ঠিকই রাতে বাসায় ফিরে আসবে। কিংবা আজ রাতটা হলে কাটিয়ে কাল সকালে নিশ্চয়ই বাসায় ফিরে আসবে। সেক্ষেত্রে মা ভুল ভাবনা নিয়ে বসে আছেন। চাকরি পেয়ে বাবার হাতে বেতন তুলে না দেয়া পর্যন্ত আমি বাসায় ফিরবো না।


ভাবছি---এই ক’টা দিন কীভাবে কাটাবো? আজ মাসের পনের তারিখ। টিউশনির টাকা পেতে পেতে সেই আগামী মাসের পাঁচ তারিখ। এই স্টুডেন্টকে নতুন পড়াচ্চছি। এখনই তাই এ্যাডভান্স চাইতে পারছি না।
সোনালী ব্যাঙ্কে আমার একটা এ্যাকাউন্ট আছে।

সেই এ্যাকাউন্টে কিছু ব্‌ত্তির টাকা আছে। সে টাকাটা তোলা যায়। কিন্তু সেই টাকা তুলতে তো চেকবই লাগবে। চেকবই বাসায়। বাসায় কোনভাবেই যাওয়া যাবে না।

সুতরাং, এই অপশন বাদ।
বেসরকারি ব্যাঙ্কে আমার কেনো একটা এ্যাকাউন্ট নেই---এই ভাবনাটা প্রথমবারের মত আমাকে বেশ ঘা দিতে লাগলো। এই তো গত বছরও ডাচ বাংলার লোকেরা আমাদের ক্যাম্পাসে বিনা জামানতে স্টুডেন্ট এ্যাকাউন্ট করিয়ে দেবে বলে ধন্না দিয়ে বসে ছিল। সেসময় ফ্রি-তে একটা এ্যাকাউন্ট খুলে ফেললেই হতো।
যা বুঝছি, তাতে সৌরভের কাছ থেকে ধার-কর্জ করেই ক’দিন চালাতে হবে।

ব্যাটা গাঁইগুঁই করবে অবশ্য। চাপ দিয়ে আদায় করতে হবে। এছাড়া উপায়ও নেই। মিডটার্মের ছুটি চলছে। হল একেবারে ফাঁকা।

জুনিয়ররা সব বাড়ি চলে গেছে। সৌরভের মত যারা পাশ করে এখনো হল ছাড়েনি, তাদেরই কেউ কেউ রয়ে গেছে।
রাত দশটার দিকে মা ফোন দিল। আমি তখন সলিমুল্লা হলের সামনের রাস্তা ধরে হাঁটছি।
তাই বলে বাসায় আসবি না?---মা’র কণ্ঠে উদ্বেগ।


না---আমার সোজাসাপটা উত্তর।
হলে কার রুমে আছিস?
সৌরভের রুমে।
কাল সকালে চলে আসিস।
আমি বললাম, কাল সকালেও আসছি না।
তাহলে কবে আসবি? কোথাও ঘুরতে-টুরতে যাবি নাকি?
না, কোথাও ঘুরতে-টুরতে যাচ্ছি না।

আপাতত হলেই আছি। আর বাসায় কবে আসবো, বলতে পারতেসি না। আদৌ আসবো কিনা, তাও বলতে পারতেসি না।
এইসবের কোন মানে হয়? জানিসই তো তোদের বাপ একটু ঐরকম। এইভাবে রাগ করলে আমি পঁচিশ বছর তার সংসার করতে পারতাম?
আম্মু, তুমি মহান।

এইজন্যই পঁচিশ বছর বাবার সংসার করতে পারসো। অন্য কেউ হলে পারতো না।
আজেবাজে কথা রাখ। কাল সকালেই আয়। আমি তোর বাপকে বলসি, তুই খেলা দেখতে হলে গেছিস।

কালকেই চলে আসবি। কালকে না আসলে বাসায় একটা গণ্ডগোল বাধবে।
বাধুক।
তুই বুঝতে পারতেছিস---তোকে না পেয়ে তোর বাপ আমাকে গালাগালি করবে? বলবে---কী ছেলে জন্ম দিসো যে তোমার কথা শুনে না?
মা’র জন্য আমার খারাপ লাগলো।
আম্মু, তোমার কথা ঠিকমত শুনতে পাইতেসি না---বলে মোবাইলটা সুইচ অফ করে দিলাম।


মা’র জন্য আমার খারাপ লাগলো।
আচ্ছা, আমিও কি এরকম বাবা হবো? বউ-বাচ্চা সবাইকে সবসময় ভয়ে তটস্থ করে রাখবো? আমার ছেলেও কি একদিন বাসা থেকে বেরিয়ে সলিমুল্লা হলের সামনে দিয়ে রাতপাখির মত একা একা হাঁটতে থাকবে?
মানুষের নাকি যতো বয়স হয়, ততোই সে তার বাবার মত হতে থাকে! আমার চেহারায় কি বাবার ছাপ পড়ছে ধীরে ধীরে? আমার আচার-আচরণে?
বাবার সাথে আমার কিছু বিষয়ে মিল আছে। বাবা খুব সামাজিক মানুষ নন। অন্তত আমি কখনো দেখিনি। আমিও তেমন সামাজিক নই।

খুব ক্লোজ কোন ফ্রেণ্ডের বিয়েশাদি না হলে আমি বিয়ের প্রোগ্রাম-টোগ্রাম তেমন একটা এ্যাটেণ্ড করি না। জন্মদিন তো দূরের কথা।
বাবা ফুটবলের পাগল ছিলেন। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ হচ্ছে চার বাবা সেটা স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখেননি, অন্তত আশির দশকে এমনটা কখনো হয়নি। বাবা ছিলেন আবাহনীর কড়া সাপোর্টার।

ছোটবেলায় আমিও ছিলাম তাই। ছোটবেলা সেই ফুটবল নেশাটা এখন কেবল টিভির দৌলতে আবর্তিত হচ্ছে ম্যান ইউ আর বার্সেলোনাকে ঘিরে। আসলাম বা সালাহউদ্‌দীনকে বাবা ঠিক যতোটা পছন্দ করতেন, মেসি বা রোনাল্ডোকে আমার তার চেয়ে কিছু কম করি না।
বাবা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন। তখনো ‘গুলিস্তান’ হলটা চালু ছিল।

স্টেডিয়ামে বিকেলের ম্যাচটা দেখে বাবা গুলিস্তানের ইভিনিং শো-টা ধরতেন। তারপর পূর্ণিমায় সামান্য কিছু মুখে দিয়ে মেসের পথ ধরতেন। বাবার কাছ থেকে বহুবার ঠিক এই গল্পটাই শুনেছি আমরা। বাংলা সিনেমার প্রতি আমাদের এক ধরনের নাক সিঁটকানো ভাব আছে। বাবার কথাবার্তায় যতোটুকু বুঝতে পারি, সিনেমার প্রতি তার আবেগটা ছিল শুদ্ধ।

ফারুক ছিল বাবার প্রিয় নায়ক। ফারুকের মধ্যে বাবা সম্ভবত তার নিজের ছায়া খুঁজে পেয়েছিলেন। মফস্বল থেকে ঢাকা শহরে আসা এক তরুণ প্রতিনিয়ত তার চারপাশের সাথে স্ট্রাগল করছে। পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। আবার হোঁচট খাচ্ছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে।

স্ট্রাগল অফ এ্যা লাইফটাইম।
বাহাত্তরের পর যে জেনারেশনটা ভাগ্যের সন্ধানে ঢাকা শহরে এসেছিলো---তাদের প্রায় প্রত্যেকের গল্পই মোটামুটি এইরকম। তাদের মধ্যে কেউ একটু বেশি উন্নতি করেছে, কেউ কম। কাউকে এই শহর একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
বাবা নিশ্চিহ্ন হননি।

কোনমতে টিকে গেছেন। সেই সূত্রে আমরাও।
আমি হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি’র সড়কদ্বীপে চলে আসি। এগারোটা বাজে। সড়কদ্বীপ এখনো জমজমাট।

একদল ছেলেপেলে গীটার আর ঢোলের কম্বিনেশনে তাড়িয়ে তাড়িয়ে এবশ অশ্লীল একটা গান গাইছে। গানের বিষয়বস্তু---এক ছেলে সম্প্রতি ছ্যাঁকা খেয়েছে। এখন সে তার পুরনো প্রেমিকাকে ইচ্ছামত গালাগাল করছে। ছেলেগুলো গোল হয়ে নাচছে আর গাইছে। অবারই লিরিক মুখস্ত নাকি?
কাছেই আরেকটা দল টুয়েন্টি-নাইনের আসর বসিয়েছে।

কাছে গিয়ে দেখি, না। থ্রি কার্ডস খেলছে ওরা। এদের মধ্যে একটা ছেলে, আমার জুনিয়রই হবে---বললো, ভাই, হবে নাকি একদান?
আমি বললাম, হোয়াই নট?
কেয়াকে আমি অনেকবার হাতে ধরে টুয়েন্টি-নাইন শেখানোর চেষ্টা করেছিলাম। ও খালি বলে, আমাকে দিয়ে হবে না। আমি বলতাম, হবে না ক্যান? একদম সোজা।

শোন, চারজনের খেলা। দু’জন করে দুই দলে ভাগ হয়ে খেলবে। প্রথম বিডে চারটা করে কার্ড ডিস্ট্রিবিউট করা হবে। সেই চারটা কার্ডের ভালোমন্দ দেখে তুই রঙ করতে পারিস বা চেহড়েও দিতে পারিস?
রঙ করা মানে?
রঙ করা মানে কোন বিডে সেই কার্ড প্লেস করলে অন্যগুলা সব তোর হয়ে যাবে।
বাহ! মজা তো।

তারপর?
তোকে গেস করতে হবে---তুই এই রাউন্ড থেকে মোট কতো পুয়েন্ট তুলতে পারবি। ধর, তোর মনে হল তুই আঠারো পয়েন্ট পাবি। তুই কল করলি, আঠারো। অন্য কারো মনে হল সে এর চেয়েও এবশি পাবে। সে কল করলো ঊনিশ।

তুই ঊনিশে স্টে করলি বা বিড বাড়িয়ে দিলি।
কিন্তু আমি তো একবা আঠারোতে কল করেই ফেলসি।
তাতে কী? তোর যদি মনে হয়, তুই বিশ পেতে পারিস, বিশ কল করবি। সামান্য রিস্ক হয়ে যায়। কিন্তু নো রিস্ক, নো গেইন।


বাপরে, এতো নিয়ম। আমার দ্বারা হবে না।
বলেই কেয়া ফিক করে একটা হাসি দিত। হাসলে ওর গালে খুব সুন্দর একটা টোল পড়তো। সেই টোল দেখার জন্যই আমি প্রায়ই ওকে লেইম লেইম সব জোক্স বলে হাসানোর চেষ্টা করতাম।

যেমন---বোর্ড থেকে জানানো হয়েছে, এখন থেকে এইচএসসি’র রেজাল্ট আউট অফ ফাইভ জিপিএ হবে না, হবে আউট অফ ফোর। এই শুনে বিল্টু বললো, বাহ! তাহলে তো আমাদের য়াগের চেয়ে টুয়েন্টি পার্সেন্ট কম পড়াশোনা করলেই চলবে। এ ধরনের জোক্সে কেউ হাসবে না---গ্যারান্টেড। কেয়াও হাসতো না। কিছুক্ষণ পর যখন বুঝতো, জোকসটা বলে আমি নিজেই চুপসে গেছি, তখন সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে একটা হাসি উপহার আসতো ওদিক থেকে।


হাসলে ওর গালে খুব সুন্দর একটা টোল পড়তো।
তা কী করবি ঠিক করলি?
সৌরভ মুখের ভেতর পরোটা আর ভাজি ঠেসে ঢোকাতে ঢোকাতে জিজ্ঞেস করে। শালা খেতেও পারে। সকালবেলা কেউ আটটা পরোটা আর তিন তিনটা ডিম ভাজি খায়? আমার তো তিন-এক ফর্মেশনেই দিব্যি ক্ষিদে মিটে যায়।
আমি তখন আমার শেষ পরোটায়।


ভাবছি।
তাড়াতাড়ি ভাব। হল অফিস থেকে নোটিশ আসছে। ১ তারিখ রুম ছেড়ে দিতে হবে। ফার্স্ট ইয়ারের এক ছেলে এসে উঠবে।


আমি বেশ তাচ্ছিল্যের সাথে বললাম, ফার্স্ট ইয়ার? ওটাকে কয়েকদিন ঠেকায়ে রাখ।
এতো দিন তো ঠেকায়াই রাখসি। আর সম্ভব না। প্রভোস্ট স্যার নিজে এসে বলে গেসেন। তার উপর সেই দিন এই ছেলে তার বাপকে নিয়ে আসছে আমার রুমে।


এইটুকু ছেলে তার বাপকে এনে তোরে শাসায়া গেলো?
আরে, শাসায় গেলে কি আর হল ছাড়তাম নাকি? ছেলে তার বাপকে নিয়ে এসে কান্নাকাটি করসে। ছেলে গণরুমে থাকে। পড়াশুনা নাকি কিছুই হইতেসে না।
আরে, পড়াশোনা কইরা কী করবে? ছেলের বাপকে বোঝা। পড়াশোনা কইরা আমাদের মত বেকারি তো থাকতে হবে।


আরে, বুঝস না? ফার্স্ট ইয়ার। গায়ে তেল বেশি। একটা সেমিস্টার যাক, সব তেল বাইর হইয়া যাইবো।
হুমম। কোথায় উঠবি তাইলে?
আপাতত বাড়ি যাব।

বাপ-মা’র কাছে অনেকদিন থাকা হয় না। ঐখানে গিয়া কিছুদন রেস্ট নিই। তারপর এইম ইন লাইফ নিয়া ভাবা যাবে।
সৌরভের বাড়ি ময়মনসিং। ময়মসিংহের মানুষ খুব হোমসিক হয় জানতাম।

ভার্সিটিতে এসে এর ষোলআনা প্রমাণ পেয়েছি। ঈদ, পূজা আর শীতকালীন ছুটি হলে তো কথাই নেই, হরতাল-টরতালের কারণে সামান্য তিন-চারদিনের ছুটি পেলেও আর কেউ যাক না যাক, আমার যতোগুলো ময়মনসিংহের বন্ধু ছিলো, তারা প্রত্যেকেই বাড়ি যাবে-ই যাবে।
এইম ইন লাইফ মানে? ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে নিশ্চয়ই ডাক্তার হবি না?
হু নোজ? আমার এক আঙ্কেল ছিলেন। উনি মেকানিক্যালে ছিলেন। পাশ করে ভালো চাকরি-বাকরি না পেয়ে কী করবনে কী করবেন! তারপর কার কাছ থেকে যেন হোমিওপ্যাথি শিখে নেন।

ঐ হোমিওপ্যাথি করেই তো উনার জীবন কাটলো।
তোদের এলাকার?
হুমম। এখনো স্টেশন রোডে গেলে উনার নাম বললে লোকে উনার চেম্বার দেখিয়ে দিতে পারবে।
তুইও কি হোমিওপ্যাথি শিখার চিন্তায় আছিস নাকি?
আরে ধুর, এখন আর হোমিওপ্যাথির চল আছে নাকি? ভাবতেসি ময়মনসিং সেটল করে ওখানেই একটা কোচিং সেন্টার দিব। কোচিং সেন্টারের নাম হবে ‘ইঞ্জিনিয়ার সৌরভ স্যার মেরিট একাডেমী’।

জানিস তো, এখন আর ‘কোচিং সেন্টার’ নামটা মানুষ খায় না। খ্যাত খ্যাত লাগে। এখন নাম দিতে হবে অমুক একাডেমিক কেয়ার, তমুক ব্রিলিয়ান্ট স্কয়ার---এইরকম। নামের মধ্যে একটা ডিজিটাল ডিজিটাল ভাব থাকা চাই।
কোচিং সেন্টারের বিজনেস তো অনেক রিস্ক।


এজন্যই তো ঢাকায় দিতেসি না। ঢাকায় তো এখন সব কিছুই স্যাচুরেটেড। এর চেয়ে মফস্বলে বিজনেস করা সোজা। এলাকার বড় ভাইদের কিছু দিতে হবে। কিন্তু আসল কথা...তোর কম্পিটিশন কম।


প্রফিটও কম। ঢাকার লোকজন তাদের ছেলেমেয়ের পড়াশোনার পেছনে যেমন খরচ করে, ময়মসিংহের লোকজন কি তা করবে?
আজ করতেসে না, কাল করবে।
সে না হয় হইলো। কিন্তু এই কোচিং সেন্টার করে কতোদিন? আল্টিমেটলি তো একটা না একটা জবে ঢুকতে হবে?
কোরিয়ার খবর জানিস?
আলোচনার মাঝখানে হঠাৎ কোরিয়ার প্রসঙ্গ ওঠায় আমি কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।
এইখানে কোরিয়া আসলো কোত্থেকে?
কোরিয়ায় মানুষজন এই প্রাইভেট কোচিং করিয়ে মাসে দশ-বারো লাখ করে কামাচ্ছে।


মানুষজন মানে কি স্কুল-কলেজের স্যাররা? ব্যাচে পড়িয়ে?
আরে, নাহ। ওখানে স্যারদের ব্যাচে পড়ানো নিষেধ। আমার-তোর মত ছেলেপেলেই ওখানে টিউশনি করিয়ে মাসে দশ-বারো লাখ করে কামাচ্ছে। ‘দশ-বারো লাখ’ বলার স্ময় সৌরভের ভাবভঙ্গি দেখার মত। মনে হচ্ছে ওর জিহবা দুটো যেন দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ এক গ্রাসে গিলে ফেলতে চাইছে।


সৌরভ কন্টিনিউস---ওখানকার সিস্টেমটা তোকে বলি। প্রাইভেট টিউটররা ওখানে সকালে একটা ক্লাস নেয়। এই ধর সোয়া এক ঘণ্টার মত। সেই লেকচারটা ভিডিও করে রাখা হয়। তারপর পনের মিনিটের কোশ্চেন-এ্যান্সার সেশন।

পরের ব্যাচগুলোতে আর লেকচার দিতে দিতে মুখ ব্যথা করতে হয় না। সকালের ভিডিওটা চালিয়ে দিলেই হলো। যার যা প্রবলেম, কোশ্চেন-এ্যান্সার সেশনে সব সল্ভ হবে।
তুই কি ময়মনসিংহেও এটা চালু করবি?
এখন না হলেও ধীরে ধীরে। দিস ইজ দ্যা ফিউচার---সৌরভ এবার একটা সিগারট ধরায়।


তুই জানিস, প্রাইভেট টিউটররা ওখানে রকস্টারের মত সম্মান পায়? বিলবোর্ডে ওদের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। এক একজন ফেমাস টিউটর এক একজন ইয়াং আইকন ঐখানে।
তোর ছবিও তাহলে বিলবোর্ডে ছাপা হতে যাচ্ছে?
হু নোজ? আমরা এশিয়ানরা পড়াশোনার জন্য পাগল। আর যেইখানে পাগলামি, সেইখানেই বিজনেস।
সৌরভকে বেশ আত্নবিশ্বাসী দেখাচ্ছে।

কনফিডেন্সে ওর চোখমুখ ঝলমল করছে।
বিজনেসটা দাঁড়ায়া যাক। তোকে লেকচারার হিসীব এ্যাপয়েন্ট করবো।
আমি হেসে বললাম, করিস।
বেশ অনেকদিন পর মুক্ত, স্বাধীন একটা দিনের সন্ধান পেলাম।

বাসায় থাকলে তো বিডিজবসের সাইটে ঘুরাঘুরি করেও অনেকটা সময় চলে যায়। আজ সেটাও করছি না।
উদ্দেশ্যহীনের মত হাটঁতে শুরু করলাম। এই নষ্ট শহর আমাকে পদে পদে আটকালেও হাঁটতে কখনোই বাধা দেয় নি।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম পাবলিক লাইব্রেরি।

তারেক মাসুদের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চলছে এখানে। আজ দেখাবে ‘রানওয়ে’।
হল ভর্তি দর্শক। ভার্সিটির ছেলেপেলে দল বেঁধে এসেছে এই মুভি দেখতে। গার্জেন গোছে কিছু লোকজনও দেখলাম বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মুভি দেখতে এসেছে।

প্রত্যেকেই কোন না কোন দলের সদস্য। আমি একলাই বোধ হয় খাপছাড়া এই দলে।
এক নিঃশ্বাসে মুভিটা দেখে শেষ করলাম। তারেক মাসুদের মাস্টারপিস ‘মাটির ময়নার’ লেভেলের না হলেও মুভিটা ভালো। বেশ ভালো।

এই মুভি হলে কেনো রিলিজ দেয়া হয় না, বুঝলাম না। আমার ধারণা, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে এদেশের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে বেশ ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এরা মনে করে, এ ধরনের মুভি একজন রিকশাওয়ালা বা ঠেলাওয়ালা দেখবে না। তারা চায় খালি নাচ, গান আর এ্যাকশন। আমার কিন্তু উল্টোটাই মনে হয়।

সাহস করে এই মুভিগুলো হলে রিলিজ দিলে আর সামান্য পাবলিসিটি করলে কী শিক্ষিত আর কী অশিক্ষিত---সবাই দল বেঁধেই এ ধরনের মুভি দেখতে আসবে। এটা সম্ভবত শিক্ষিত সমাজের এক ধরনের উন্নাসিকতা। এদের ধারণা---তারেক মাসুদের মুভি বোঝার ক্ষমতা আর শিক্ষা কেবল এদেরই আছে। মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখার এ এক ধরনের তরিকা বটে।
মুভি দেখে ছবির হাটে এলাম গুড়ের চা খেতে।

গুড়ের চা আমার বিশেষ পছন্দের না হলেও এখানে এসে এই আইটেমটা না খেলে কেমন খালি খালি লাগে। তাই খাওয়া।
চা খেতে খেতে শুনলাম অদূরে এক কবি তার বন্ধুবান্ধবদের স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনাচ্ছে। কবিতার প্রতি আমার তেমন মোহ না থাকলেও এর ভরাট গলা আমার ভালো লেগে গেলো। আমি কান পেতে তার কবিতাআব্‌ত্তি শুনলাম।

এই বান্দা বড় কবি হতে পারবে কিনা জানি না, কিন্তু কালে কালে বড় আব্‌ত্তিকার হবে নিশ্চয়ই।
কবিতাটা সেইদিনের মত আমার মাথায় গেঁথে রইলো---
মোহাম্মদপুরের কানাগলিতে আমাদের রোজকার বসবাস
আমরা লাইন ধরে ইশকুল যাই, কখনো কলেজ
সকাল-বিকাল নিয়ম করে ব্ষ্টিতে ভিজি
অবসরে মেয়েদের উত্যক্ত করতে খারাপ লাগে না
আরো কিছুটা অবসর পেলে মেয়েদের গার্জিয়ানদের
শুক্কুর শুক্কুরবার আমরা দল বেঁধে পরীক্ষা দিতে যাই
হল থেকে বেরিয়ে ধরি পলাশীর রুট
সেখান চিড়া খাই, মুড়ি খাই
খাই কলা এবং ছোলা
পকেট গরম থাকলে চিকেন, হালিম এবং বেনসনের ঝোলা
সন্ধে সন্ধে সবার মেজাজ খুব খ্রাপ
কবিতার ঝোলা বোঝাই করে সবাই হাজির ছবির হাট
ম্যাজিক বাক্স থেকে বেরোয় ছবি, ছবির মাংস
হালকা কমেডি ধাঁচের কবিতা, কবিতার হাড়গোড়
ছবিওয়ালাদের দাপটে অস্থির গোটা পাড়া
সন্ধে সন্ধে সবার মেজাজ তাই আরো খ্রাপ
এই সময়ে খবর আসে গ্যাং-রেপের
সব্বাই খুব উত্তেজিত---এর বদলা এবার নেবেই
প্রয়োজনে ছবির হাটেই হয়ে যাবে একটা গ্যাং-রেপ
কিন্তু কিছু একটা হতে হবে
কেননা অনেকদিন ধরেই কিছুতেই কিছু হচ্ছে না
বলা ভালো, কোথাও কিছু হচ্ছে না
পরদিন আবার রিক্রুটমেন্ট টেস্টের দৌড়
সাবজেক্টিভ, অবজেক্টিভ, বাংলাদেশের মানচিত্র আর খনিজ সম্পদ
১ লাখ টাকার ৭ পার্সেন্ট সুদে কত হয়?
বাবর রোডের বাবলা ভাই অঙ্কে খুব ওস্তাদ
ওনার কাছ থেকে বুঝে নিতে হবে সব
সরল সমীকরণ, জীবন-মরণ---সব
আধখাওয়া সিগারেটে সবাইকে অচেনা মনে হয়
মুনিরের সিঙ্গারা, কাজলের চা---সবাইকে...
ন'টা বাজে বুঝি?
মোহাম্মদপুরের বাস কি আর ধরা যাবে?
আজ-ও না হয় হেঁটেই গেলাম
সিগারেটের ছাই, কবিতার হাড়গোড় আর নকল প্রশ্নপত্র সঙ্গী করে
পরে জেনেছিলাম, কবিতার নাম ‘কানাগলির সকালসন্ধে’।
আমার তরফ থেকে কবির প্রতি এক কাপ গুড়ের চা পাওনা রইলো।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।