আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাঙের ধারে ঘর (পর্ব ২)




চার

গ্রীষ্ম গিয়ে বর্ষা এসেছে। আকাশ কালো করে দিন নেই রাত নেই সবসময় ঝরঝর করে ঝরছে তো ঝরছেই বৃষ্টি বিন্দু। মেঘের যেন মেলা বসেছে দিগন্তজুড়ে। পুকুর,ডোবা আর ছোট ছোট গর্তগুলো জলে টুইটম্বুর। সেখানে গা ঘিনঘিন করা হলুদ রঙের ব্যাং সারাদিন মনের আনন্দে ডাকাদাকি করছে।

মাটিতে রস পেয়ে যাবতীয় গাছ আর আগাছা বেড়ে উঠেছে তড়তড়িয়ে। এক পশলা বৃষ্টির পর যখনই রোদ হানা দেয় বৃষ্টিধোয়া কচি সবুজ পাতায়, তখন মনে হয় যেন গ্রাম জুড়ে সবুজ আলো ছড়িয়ে আছে। সেই সবুজ আলোয় ডুবে চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকা গ্রামে ভোরের প্রথম আলোয় যদি কেউ হাঁটতে বেরোয় তবে তার কবি হতে ইচ্ছা করবে। এমনই এক সকালে বেনু মাথায় শাড়ির ঘোমটা দিয়ে গাঁয়ের রাস্তা ধরে সরকার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। আজ তিন চার মাস হয় সে দরকার পড়লেই এবাড়িতে কাজ করে।

এখানে কাজ করতে দেখে অনেকেই তাকে ভারী কাজ পড়লে ডাকাডাকি করে। সেও মাঝে মাঝে যায়। কখনো কারো বাড়িতে ধান সেদ্ধ করে,কখনো বা মুড়ি ভাজে আবার কখনো চালের আটা কুটে দেয়। আজ সরকার বাড়িতে বড় খানা হওয়ার কথা। সরকার গিন্নীর মৃত্যুদিবস উপলক্ষ্যে মিলাদের আয়োজন করা হবে।

ছেলে মেয়েরা যে যেখানে ছিল সব চলে এসেছে। গত দুইদিন থেকে এবাড়িতে অনেক মানুষ। তাই কাজও বেশি। ফুলির মায়ের সাথে সে দুদিন ধরেই কাজ করছে। বাপরে!কত যে কাজ।

দুজনে মিলেও শেষ করা যায় না। মেজ আর সেজ বউও রান্নাবান্নার পাশাপাশি এটা ওটা করে সাহায্য করে, তাও কুলানো যায় না। একবেলার খাওয়া শেষে থালাবসন মাজতে মাজতেই অন্যবেলার খাবার রান্নার সময় এসে যায়। তবে খাওয়া দাওয়া হয় বটে এবাড়িতে। এমনিতে সাধারন খাবার খেলেও লোক আসলে প্রতিবেলায় পাঁচছয় পদের তরকারি রান্না হবেই।

মেজবউটা পারেও!কলেজ থেকে পড়ায়ে এসে এতসব রান্নাবান্না সেই সাথে সবকিছু দেখাশোনা করা কম কথা নয়। বেনু তো এই মেজ বউয়ের বড় ভক্ত হয়ে পড়েছে আজকাল।

বাড়িতে আসতেই মেজ বউ তাকে নির্দেশ দেয় বাসি ভাত খেয়ে নিয়ে রাতের থালাবাসন মেজে ফেলতে। সে থালাবাসন মাজতে মাজতেই ফুলির মা চলে আসে। এসেই সে কয় একটি বাছা বাছা গালি দিয়ে তাকে বলে, এই মাগী তোর বেশি ত্যাল হয়ছে?শরীফের বউ তোক কাম করতি ডাকছে দুইদিন ধইরি তুই যাইস না ক্যা তাই ক?কয়দিন তো ভালই কাম করলি অই বাড়ি, এখন আবার হয়ছে কি?

বেণু জবাব দেয়, হবি আবার কি?আমি তো কইছিই বাঁধা কাম করবোনা।

বউডা যেই কয়দিন ব্যারামে ভুগছিল সেই কয়দিন কাম কইরি দিছি। এখন আর যাতি পারবোনা। আমি তো দুইদিন আগে বইলেই আইছি বউডাক যে আমি আর আসবোনানে। আবার তোমাক উকালতি করার জন্যি পাঠাইছে ক্যা?

জবাবে ফুলির মা আর কিছু বাছা বাছা গালি দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল। বেনু মনে মনে বলে সে আর যাচ্ছে না ঐ বাড়ি।

ঐ বাড়ির কর্তার নজর বড় খারাপ। স্বভাবও কম খারাপ নয়। খালি ছুঁতা খোঁজে সে কাছে ভিড়বার। বেনু জানত গ্রামের নাম করা কয়জন লুচ্চা লোকের মধ্যে সে একজন কিন্ত বউটা টাইফয়েড হয়ে কয়দিন বিছানা থেকে উঠতেই পারতো না । এমন করে অনুরোধ করলো যে সে ফেলতে পারছিল না।

এখনতো সে নিজের কাজ করতে পারে। এখন আর কেন?তাছাড়া বউটাও যেন কেমন। নিজের স্বামী সামলে রাখতে পারে না?স্বামীতো বউকে ভালই ভয় করে তার কথাও শোনে। তবে কেন তাকে এমন সব কাজ করতে হুকুম দেয় যেগুলো কাজের লোকের করা মানায় না। বাড়ির কাজ করতে গেছে বলে কি বউ এর কাজও তাকে করতে হবে?স্বামী বাইরে থেকে আসলে তাকে লুঙ্গি আগায়ে দেওয়া,গোসলের সময় বাথরুমে গামছা আগায়ে দেয়া,খাবার সময় কাছে বসে তদারকি করা।

যত্তসব ঢং!এসব কাজ তো তার বড় মেয়েটাও করতে পারে আর যদি কেউ নাও করে তাহলে কি কয়দিনে মিনষেটা মরে যাবে?তার নিজের স্বামী যদি তাকে মুল্য দিত তাহলে সে স্বামীকে নিজের আঁচলের মাঝে লুকিয়ে রাখত। অন্য কোনো মেয়েলোককে কাছে ভিড়বার সুযোগ দিত না মোটেও।


ফুলির মার মুখটা খুবই খারাপ,গালি ছাড়া কথাই বলতে পারে না। কিন্ত মনটা যথেষ্ট ভাল নাহলে কেউ যেচে এত সাহায্য করে?নিজে থেকেই সে কাজের খোঁজ দেয় আবার দুইটা নতুন সুতির শাড়ি তাকে পড়তে দিয়েছে আর বলেছে ঈদের সময় দেখিস পাঁচ ছয়টা শাড়ি যাকাত পাবি। তখন সেখান থেকে ফেরত দিস।

ফুলির মাকে পরে নিজের সমস্যা বুঝিয়ে বললেই সে বুঝবে। আগামী সপ্তাহে ঐ বউ আবার বাপের বাড়ি যাবে। মেয়ের স্কুল তাই বেনুকে বলেছে বাড়ি দেখতে হবে আর রাতে মেয়ের সাথে থাকতে হবে। বউটা অবুঝ হতে পারে কিন্ত বেনু এত পাগল না যে ঐ বেটাকে কোনো সুযোগ নিতে দেবে। তাছাড়া সেদিন বউটা বারবার বলছিল ড্রয়ারে রাখা তিনশ টাকা খোয়া গেছে।

কে জানে তাকে সন্দেহ করছে কিনা। সে মাঝে মাঝে সামান্য তেল নুন নিতে পারে কিন্ত কারো টাকাতে হাত দেয়নি,দেবেও না। তাই সময় থাকতেই বেনু চলে এসেছে যাতে চোর বা কলঙ্কিনী অপবাদ না নিতে হয় ঘাড়ে। সে ভালই জানে ঘরের পুরুষ যত অপরাধই করুক না কেন সে স্ত্রীর কাছে ঠিকই সাধু থাকবে। তখন যত নষ্টের মূল হবে বাইরের মেয়েলোক।

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই সে কাজ করতে থাকে। এদিকে বাইরে ইঁটের চুলায় বিশাল ডেকচিতে খিচুড়ি চড়ানো হয়েছে। এই দিয়ে বাসার সবাই সকালে নাস্তা করবে আবার যেসব মাদ্রাসার ছেলেরা কোরান পাঠ করেতে আসবে তারাও খাবে। বেনু বুঝতে পারে আজ ভীষন খাটনি যাবে সবার তাই সে আরো তারাতারি হাত চালাতে থাকে।

সেদিন সন্ধ্যায় বেনু এক অভুতপূর্ব প্রস্তাব পায় সরকার বাড়ির বড় ছেলের কাছ থেকে।

এই বাড়ির বড় ছেলে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকে। সেখানে কাজের লোকের দরকার। সে যদি যায় তাহলে খুব ভাল হয়। ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তাব পেয়ে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। ঢাকা শহর?বেনুর কাছে সে তো এক রূপ কথার নগরী!এতদিন শুধু শুনেই এসেছে সেই শহরের গল্প।

বেনু মনে মনে আকর্ষন বোধ করে কিন্ত শেষ পর্যন্ত তার সাহস হয় না রাজি হতে। তাই সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।


রাতে ক্লান্ত দেহে বাড়িতে ফিরে আঁচলে বাঁধা বকশিসের টাকা রাখতে গিয়ে সে সমস্যায় পড়ে যায়। কোথায় রাখবে টাকা?এখানে তার নিজের বলতে কিছুই নেই। মায়ের বাক্সে রাখলে ছোট ভাই ইচ্ছামত হাতিয়ে নেয় অথবা ধার চায়।

চাইলে সে মুখের উপর না করতেও পারেনা। তাছাড়া নিজের কাছে কত টাকা আছে তা অন্যকে জানতে দেয়াও একটা অস্বস্তির ব্যাপার। এই সময় বেনু তার নিজের টিনের ট্রাংকটির অভাব বোধ করে ভীষনভাবে। আহা সেই নীল রঙের ট্রাংকটি!যখন তার বিয়ে হলো তখন তার ছোট মামা কিনে এনেছিল তার জন্য। স্বামীর বাড়িতে তার সঙ্গী হয়েছিল সেটা।

সেখানে সে রাখত বিয়ের লাল শাড়িটা,পুঁতির মালা,বিয়ের আলতা,স্নো আরো কত কি!ছোট একটা তালা দিয়ে রাখত সে ট্রাঙ্কটিতে। লুকিয়ে ডিম,কলা এটা সেটা বিক্রি করে যে টাকা জমিয়েছিল সে সেটাও থাকত একটা ক্রিমের কৌটার মধ্যে। বেনুর মনে পড়ে শশুড়বাড়ি যাওয়ার পর প্রথম যখন গ্রামে বৈশাখি মেলা হলো তখন স্বামীর সাথে গিয়েছিল মেলা দেখতে। তখন তার কিশোরি চোখে সবকিছুই বড় রঙ্গিন আর আকর্ষনীয় লাগছিল। সে দেখেছিল এক যায়গায় রঙ্গিন কাঁচের চুড়ি বিক্রি হচ্ছে।

নেড়েচেড়ে হাত বুলিয়ে দেখছিল সে চুড়িগুলো,বড় ইচ্ছা করছিল স্বামী তাকে কিনে দিক একগাছি। কিন্ত বেনু স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখে সে নির্বিকার। সাথে থাকা ছোট ননদকে মাটির পুতুল আর তিলের খাজা কিনে দিয়েছিল তার স্বামী কিন্ত তাকে কিছুই দেয়নি। পরদিন রাতে যখন সে গভীর ঘুমে তখন স্বামীর হাতের স্পর্শে তার ঘুম ভেঙ্গেছিল। ঘুম ভেঙেই সে দেখেছিল স্বামী হাসিমুখে তার দিকে ঝুঁকে রয়েছে।

হাত নাড়াতেই অবাক হয়ে সে দেখে, ওমা! তার নিজের হাত ভর্তি লাল সবুজ কাঁচের চুড়ি। ঘুমের মাঝেই মরদটা তাকে চুড়ি পড়িয়েছে। এই জন্যেই বুঝি সে সকাল সকাল ক্ষেতের বেগুন তুলে হাটে বেচতে নিয়ে গিয়েছিল। হয়ত আগের দিন বিকালে লোকটার কাছে টাকা ছিল না বউয়ের শখ মিটানোর জন্য। কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে তার চোখে জল এসেছিল।

সে রাতে স্বামীর সোহাগটা ভারী মিষ্টি লেগেছিল বেনুর কাছে। সকালে হাতে কাঁচের চুড়ি দেখে শাশুড়ি কত কটু কথা বলেছিল তাকে কিন্ত সারাদিন সে হাত থেকে তা খোলেনি। তবে কাজ করতে করতে যখন তখন চুড়ি ভেঙ্গে পড়ে বলে যত্ন করে সেগুলো নীল ট্রাংকে তুলে রেখেছিল সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেনু ভাবে মরদটা তার এতটা খারাপও ছিল না। তার জন্য প্রথম প্রথম ভালই দয়ামায়া ছিল শুধু দজ্জাল শাশুড়িটাই কোনোদিন এক ফোটা দরদ দেখায়নি তার জন্য।

এমনকি অন্য কেউ দরদ করলেও ডাইনী বেটির তা সহ্য হতোনা। বেনু মনেমনে ভাবে টাকাগুলো আঁচলেই বেঁধে রাখবে। তারপর আর কয়টা টাকা জমলে সবার আগে একটা ট্রাংক কিনে নিয়ে আসবে।



পাঁচ
আরো তিন চার মাস কেটে গিয়েছে। বেনু এখন বেশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।

সে এখন গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভারী কাজ করে বেড়ায় আর তার বদলে টাকা নেয়। অনেকেই তাকে বাঁধা কাজ করতে ডাকে কিন্ত সে রাজি হয় না। কেন হয় না সে নিজেও জানে না। বেনু এখনও তার সৎ মায়ের বাড়িতে থাকে এবং সেখানেই খায়। মায়ের হাতে সে বাজার সদাইয়ের টাকা দেয় তাই মা তেমন কিছু বলে না শুধু ভাইটা গজগজ করতে থাকে।

তবে তাকে আর তেমন তোয়াক্কা করেনা বেনু। কারন এখন সে একটা শক্তি পেয়েছে। সেটা হচ্ছে অর্থের শক্তি। সেটা তাকে এনে দিয়েছে স্বাধীনতা। যার স্বাদ জীবনে সে কখনো পায়নি আগে।

এখন তো বলতে গেলে বেনু নিজেই নিজের কর্তা। নিজের উপার্জনের টাকায় যা ইচ্ছা করতে পারে। এই স্বাধীনতা তাকে সম্পুর্ন নতুন এক অনুভুতির সাথে পরিচিত করে দিয়েছে। সে যে একটা আলাদা মানুষ তা যেন এতদিন সে ভাল করে বুঝতে পারেনি।

কয়দিন হলো ফুলির মা কুটুমবাড়ি গিয়েছে তাই সরকার বাড়িতে তার বদলে বেনু কাজ করছে।

বাড়ির সবাই বাইরে, শুধু মেজ বউয়ের কলেজ পড়ুয়া বড় মেয়েটা বাসায় আছে। এই মেয়েটা সারাদিন খালি পড়ালেখা করে। পড়ালেখা না করলে বসে বসে গল্পের বই পড়ে। আজকেও সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি একটা বই পড়ছিল। বেনু কাজ শেষ করে সেই ঘরের মেঝেতে কাঁথা নিয়ে সেলাই করতে বসলো।

গ্রামের মহিলাদের অর্ডারের কাজ। একটা ডাবল কাঁথা সেলাই করে দিতে পারলে সাড়ে তিনশ টাকা পাওয়া যায় তাই সে এই কাজ নিয়েছে। একমনেই সে কাজ করছিল এমন সময় বড় মেয়ে তাকে জিগাসা করলো, বেনু আপু তোমার যখন বিয়ে হয় তখন তোমার বয়স কত ছিল?
এই মেয়েটা লক্ষী আর শান্ত। কথাও তেমন বেশী বলে না তাই বেনু বেশ অবাক হয়ে উত্তর দিল,চৈদ্দ কি পইনেরো বচ্ছর হতি পারে বড় আপা।
বড় মেয়ে বলে,আজ তোমার বিয়ের আর শশুড় বাড়ির গল্প শুনবো।

আমাকে বল কিভাবে তোমার বিয়ে হলো,কবে বাচ্চা হলো,শশুড় বাড়ির লোক কেমন ছিল আর কেনই বা তুমি চলে আসলে। আজকে আমি তোমার জীবনের ইতিহাস শুনতে চাই।

নিজের কথা বলার সুযোগ আর দরদি শ্রোতা পেয়ে বেনু গড়গড় করে বলে যায় তার অতীত জীবনের কথা।
তার বাবার যখন মৃত্যু হলো তখন পুরো পরিবার যেন অথৈ জলে গিয়ে পড়ল। বাবা একটা কারখানায় চাকুরী করত আর তাই দিয়েই এতবড় সংসার চলত।

মায়ের কোলে তখন ছোটবোনটা,ভাইটা ছোট, সংসারে আয়ের কোনো উতস নেই,সবদিকে যেন হাহাকার ডেকে গেল। জমানো টাকা ভাঙ্গিয়ে কোনোমতে সবার পেট চলত। এর মাঝে এতিম বেনুর দিকে তেমন নজর দেয়ার কেউ ছিলনা। বেনুর আপন বোন খাদিজা জন্ম থেকে স্বার্থপর। কাছেই তার স্বামীর বাড়ি তবুও বোনের দায়ীত্ব সে একদিনের জন্য নেয়নি।

প্রথম দিকে সে ছন্নছাড়ার মত দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াত। কেউ খেতে দিলে খেত নইলে বাড়িতে এসে সৎ মায়ের অনাদরে দেয়া ভাত দিয়ে পেট ভরাত। মাস ছয়েকের মাঝে তার মা লজ্জা ভেঙ্গে একটু একটু কাজকর্ম করে সংসারটা মোটামুটি সামলে নিল। তার কিছুদিন পর পাশের বাড়ির রইসের বউ মায়ের কাছে বেনুর বিয়ের প্রস্তাব দিল। ভিন গাঁয়ের ছেলে আজমল।

ব্যবসার সুত্রে রইস মিয়ার বাড়িতে আসাযাওয়া করে। ডাগর চেহারার বেনুকে দেখে তার মনে ধরেছে খুব। এই বিয়েতে অমত করার মত কেউ ছিল না। রইস মিয়ার পরিবারই ঘটকালি করে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিল। বাবা নেই মা নেই তাই কেউ ছেলের ব্যাপারে ভালমত খোঁজখবর করেনি।



বিয়ের সময় বর দেখে মেয়ের মামারা একটু আপত্তি তুলেছিল। ছেলের বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে সে তুলনায় মেয়ে কত ছোট। কিন্ত রইস মিয়াই তার মামাদের বুঝিয়ে শান্ত করল যে ছেলে পানের ব্যবসা করে,জমিজমা আছে মেয়ে তাদের কাছে খেয়ে পড়ে ভালই থাকবে। তাছাড়া একটাই মাত্র ছেলে,দুই বোনের বিয়ে হয়েছে আর বাড়িতে আছে মাত্র একটা ছোটবোন। মা মরলে সব জমি তো বেনুদেরই হবে।

এরপর আর কেউ কোন কথা তুলেনি। মামারা হয়ত ভেবেছিল এসব নিয়ে আপত্তি করে কি হবে?মেয়ে মানুষ, সংসার তো করতেই হবে। তাছাড়া বেনু তাদের আপন বোনের বাচ্চা হলেও তার দায়ীত্ব নেয়া তো তাদের পক্ষে সম্ভব না। তারচেয়ে এই ভাল যে কোথাও বিয়েটা হয়ে যক। তাতে যে অদৃশ্য দায় তাদের ঘারে আছে তা নেমে যাবে।



বিয়ের কথায় বেনু বেশ খুশিই ছিল। গ্রামের গরীব ঘরের মেয়েরা অনেক ছোট বেলা থেকেই বিয়ের জন্য প্রস্তত থাকে মানসিকভাবে। তবে বিয়ে হলে তার স্কুলে পড়াও শেষ হয়ে যাবে এটা ভেবেই তার যা একটু কষ্ট হচ্ছিল। যাই হোক একদিন ভিনগ্রাম থেকে বরযাত্রী এল,তারা পেট পুরে মাংশ ভাত খেল তারপর বিয়ে পড়িয়ে বেনুকে নিয়ে চলে গেল। চলে আসার সময় অবশ্য বেনুর খুব কান্না পাচ্ছিল কিন্ত নিজ গ্রামের সীমানা পেরিয়ে যেতেই সে নিজেকে সামলে নিল।

শশুড় বাড়িতে পাকা মেঝের টিনের ঘর,বড় উঠান,পেছনে পুকুর আর পাশে সবজি ক্ষেত। এমনিতে সব ভালই ছিল কিন্ত শাশুড়ির আচরন ছিল সাক্ষাত ডাইনির মত। অবুঝ এতিম কিশোরি শাশুড়িকে নিজের মায়ের মত ভাবতে চাইত কিন্ত প্রথমেই সে বুঝে গিয়েছিল যে মায়ের স্নেহের এক কনাও সে এই মহিলার কাছে পাবে না। তাতে অবশ্য বেনুর তেমন কিছু এসে যেত না। সে তো সৎ মায়ের ঘরেই মানুষ।

অনাদর তো তার কাছে নতুন কিছু নয়। সে নিজের নতুন সংসার,নিজের বিয়েতে পাওয়া শাড়ি গয়না আর উপহার নিয়েই মেতে থাকত। স্বামীকে তার ভালই লাগত শুধু একটা জিনিস বাদে। এই পূর্নবয়ষ্ক পুরুষটার সাথে রাত কাটাতে ভীষন কষ্ট হতো তার। সে তো গ্রামেই মানুষ হয়েছে,বিয়ের পরের ব্যাপার কিছুই অজানা ছিলনা তার কাছে কিন্ত তা জানা আর বাস্তবে সহ্য করা তো এক জিনিস নয়।

বিয়ের ছয় সাত মাস পর সে ঋতুবতী হল আর তার এর দুই বছর পর বেনুর প্রথম সন্তান খুশির জন্ম হয়।

ততদিনে বেনু শশুড়বাড়ির কঠিন বাস্তবের সাথে পরিচিত হয়ে গেছে। তার শাশুড়ি সাত গ্রামের মাঝে সবচেয়ে দজ্জাল মহিলা। তার ভয়ে ঘরের চালে কাক চিল বসতে পারেনা। এমনকি আজমলের আগের বউ দশ বছর সংসার করার পর আট বছরের ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে আর ফিরে আসেনি।

বেনু অবশ্য জানত না তার স্বামীর আগের একটা বউ আছে। বিয়ের পরে যখন সে এটা জানল তখন খুব খারাপ লেগেছিল তার। কিন্ত পরে মন কে বুঝিয়ে শান্ত করেছিল যে স্বামী ভালবাসলেই তো হলো আগের কথা নিয়ে ভেবে কি হবে?কিন্ত সেই ভালবাসার পথেও তো বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বামীর মা। সে একেবারেই সহ্য করতে পারত না স্বামী স্ত্রীর ভাল সম্পর্ক। সবসময় তালে থাকত কিভাবে দুজনের মাঝে ঝামেলা পাকানো যায়।

কতবার যে সে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মার খাইয়েছে তাকে!বেনু মনে করে বউয়ের দোষ হলে স্বামী তাকে মারতেই পারে। স্বামী তো শাষন করবেই। কিন্ত অন্যের কথা শুনে যদি তার গায়ে অযথা হাত তোলা হয় তাহলে সে কিভাবে সেটা সহ্য করবে?প্রথম প্রথম শাষনের পর মাথা ঠান্ডা হলে স্বামী সোহাগও করত। তখন বেনুর সব দু;খ মুছে যেত। কিন্ত দিন দিন সোহাগের পরিমান কমতে থাকে আর বাড়তে থাকে শাষনের পরিমান।

সেই সাথে দুর্বিসহ হতে থাকে বেনুর জীবন।

বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই যখন বেনুর প্রথম সন্তান খুশি জন্ম নেয় তখন তাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যেন নতুন রূপ পেল। তার স্বামী তার মেয়েটাকে বেশ ভালবাসত। তাই মেয়ের মায়ের জন্যও লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার নিয়ে আসত। কখনো হয়ত দুচার টাকার তিলের খাজা,কিংবা একশ চিনা বাদাম অথবা একমুঠো বাতাসা বা কলা পাতায় মোড়া চারটি গরম জিলাপি।

সে একটা ভাল ছাপা শাড়ি এনে দিল একবার। আর একবার তো চুপিচুপি কথাই দিল সামনের মাসে ধান বেচে একটা নতুন সোনার নাকফুল এনে দেবে। তবে সেই নাকফুল আর পাওয়া হলো না বেনুর। পাও্য়া হলো না অবশ্য বেনুর স্বভাব দোষেই। কেন যে সে আগের দিন স্বামীর এনে দেয়া দুটি বাতাসা ছোট ননদের হাতে দিতে গেল!তবে না দিয়েই কি করবে?ছোট মানুষ,সকাল থেকে মায়ের কাছে দুটি টাকার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করছিল কিছু কিনে খাবে বলে।

না পেয়ে উঠানে বসেই কান্না জুড়ল। তবুও মায়ের পাষান মন গলল না। কিন্ত বেনু কি করবে?তার সৎ বোনের মতই বয়স এই মেয়েটির। তাকে রেখে কিছুতেই বাতাসা মুখে দিতে পারছিল না সে। তাই চুপিচুপি দুটি বাতাসা তার হাতে দিয়ে বলল কাওকে না বলে খেয়ে নিতে।

বজ্জাত মেয়ে ঐ দুটি খেয়ে তার কাছে আরো খাওয়ার বায়না জুড়ল। সে কোথায় পাবে আরো?শেষ দুটিই তো নিজে না খেয়ে তাকে দিয়েছে। এইবার সে বেনুর লম্বা চুল ধরে টেনে নাকে মুখে খামচে এক করতে লাগল। মেয়ের চিতকার শুনে গোয়াল ঘর থেকে চিলের মত তার শাশুড়ি ছুটে আসল আর অকৃতজ্ঞ মেয়ে তার মায়ের কাছে বেনুর নামে নালিশ ঠুকে দিল। এর পর আর দেখে কে শাশুড়ির শাপ অভিশাপ আর গালাগালির চোটে বেনুর বাড়ি ছেড়ে পালানোর মত উপায় হলো।

তবে আসল শাস্তি শুরু হলো স্বামী বাড়ি ফিরলে। চুপিচুপি বউকে খাবার এনে দেয়া তাও আবার মাকে না জানিয়ে,ছোট বোনকে না দিয়ে,ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তো ভয়ানক। তাও আবার মায়ের আঁচল ধরা অনুগত ছেলে। তার কি মা কে ছাপিয়ে বউকে দরদ করা মানায়?স্বামী যখন থমথমে মুখে ঘরে ঢুকল তখনই বেনু বুঝে গেল আজ বেনুর কপালে বড় রকমের কষ্ট আছে। তারপর যা হবার তাই।

ছেলে তার মায়ের কাছে ধরা পড়া আর গালিগালাজের অপমানে জ্বালা মিটালো বউকে ইচ্ছা মত পিটিয়ে। পুরুষ মানুষের রাগ চেতলে কি আর উপায় থাকে?ঘরের কোনে রাখা পাকা বাঁশের লাঠিটা দিয়ে গায়ের ঝাল মিটিয়ে সে বউকে পিটালো। বাপরে বাপ!সে কি মার!অমন মার বেনু বাপের জন্মে খায়নি। তবে এর পরে খেয়েছে অনেক বার। সেবার মার খেয়ে বেনুর জ্বর এসে গিয়েছিল।

মাত্র তিন মাস হয়েছে বাচ্চা হওয়ার। শরীর এখনো সারেনি ভালমত তাতে কি অমন মার সয়?তিন চার দিন সে বিছানা থেকেই উঠতে পারেনি। তারপর অবশ্য মনে মনে সাবধান হয়ে গেছে,যে যত মায়াই হোক স্বামীর আনা জিনিস কাওকে দেখাবে না। তবে এরপর স্বামী তাকে আর কিছু এনেও দেয়নি। নাকফুল তো দুরের কথা একটা চুলের ফিতাও না।

হাজার হোক মা ভক্ত ছেলে। বউকে সোহাগ করতে গিয়ে মায়ের কুনজরে পড়ার মত সাহস তো তার কোনো কালেও ছিলনা।


এমনকি বেনুর শাশুড়ি মাঝে মাঝে তাকে বউয়ের সাথে একঘরে থাকতে দিত না বরং নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে রাখত। ছেলেকে সে যেন নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছিল। ছেলেও মায়ের কথার বাইরে এক পা ফেলতো না।

ছেলের বউকে যেকোনো উপায়ে কষ্ট দেয়া ছিল এই মহিলার প্রিয় কাজ। বিয়ের দুই বছর না কাটতেই বুড়ি তাকে খাওয়ার কষ্ট দেয়া শুরু করল। ভাল মাছ মাংশ বেনুর পাতে পড়ত না। এমনিতে বেনুর তেমন সমস্যা হয়নি এটা মেনে নিতে কারন চিরকাল বাপের বাড়িতে সৎ মা ভাল জিনিসগুলো নিজের ছেলেমেয়েকে আগে দিয়ে যদি থাকে তবেই তাকে দিত। কিন্ত পোয়াতি কালে ভাল জিনিস খাওয়ার বড় লোভ হতো বেনুর।


অন্যসব আশা মিলিয়ে যাওয়ার পর বেনু যখন নিজের মেয়েকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইল তখন বুড়ি তাকেও ছিনিয়ে নিল। মেয়ের বয়স তখন ছয় সাত মাস হবে। বেনু শুধু দুধ খাওয়ানোর সময় মেয়েকে কাছে পেত তাছাড়া মেয়েকে সবসময় তার দাদিই আগলে রাখত। রাতেও মাঝে মাঝে বাচ্চাকে নিয়ে ঘুমাতে পেত না সে। আর বাচ্চা দুধ ছাড়ার পর একদিনও তাকে কাছে নিয়ে রাতে ঘুমাতে পারেনি বেনু।

তাকে খাওয়ানো,গোছল করানো সবই করত বেনুর শাশুড়ি। মেয়ের কাছে তাকে ভিড়তেই দিতনা। সেই সাথে বেনুর বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য যত ভাবে মেয়েকে তৈরী করা যায় তা করেছিল বেনুর শাশুড়ি। খুশির আর দোষ কি?সে তো ছোট মানুষ। ছোট থেকে যার কাছে মানুষ হবে এবং তার কাছে যা শিখবে তেমনই তো আচরন করবে শিশু।

তাই যখন তার মেয়ে তাকে দাদির অনুকরনে ডাকা শুরু করল তাতে বেনু বেশি অবাক হল না। জন্মের পর খুশির কাছে মা ডাক খুব কমই শুনেছে তার বদলে মেয়ের মুখে শুনেছে ‘বেনু মাগী’ তার আধো আধো বোল ফোটার পর থেকেই।


বেনুর শাশুড়ি বেনুর নিজের পেটের মেয়েকে তার শত্রু বানিয়ে ছাড়ল। বেনুর প্রতিটা ভুল দেখে দাদির কাছে গিয়ে নালিশ করতে লাগল তার মেয়ে। আর শাশুড়ি,দুই ননদ আর স্বামী মিলে করতে লাগল অত্যাচা্র।

একদিন বেনু তার স্বামীর কাছে গিয়ে কেঁদে জানতে চেয়েছিল কেন সে নিজের মেয়ের উপর অধিকার পাবে না?তার স্বামী মলিন মুখ করে শুধু তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই মুখ দেখে বেনু বুঝেছিল তার স্বামীও আসলে অসহায়। সেও নিজের মায়ের কাছে এক রকমের জিম্মী। সে পছন করুক না করুক মায়ের কথা মতই তাকে চলতে হবে।

এই পর্যন্ত শুনে বড় মেয়ে বলল,তোমার বর তো দেখছি আস্ত একটা কাপুরুষ!তুমি কি তোমার বরকে জিগাসা করনি সে কেন মায়ের কথায় উঠে বসে?আমি তো আমাদের গ্রামে এমন দেখিনি।

কিছু পরিবারে দজ্জাল মা থাকে কিন্ত ছেলেরা বড় হলে তাকে তো এতটা পাত্তা দেয় না। অবস্থা বেশি খারাপ হলে বউ বাচ্চা নিয়ে আলাদা হয়ে যায়।

বেনু উত্তর দিল,একদিন জিগেস করিছিলাম। ও কইছিল তুই একটু মার সাথে মিলমিশ কইরি থাকতি পারিসনি?মার কতা না শুনলি মা কয়ছে আমাক সম্পত্তি দিবি না। কইদিন একটু সইয্য কর।

মা মইরি যাওয়ার পর আর তো কোনো সমেস্যা থাকবি না।

হ্যাঁ বেনুর স্বামী আসলেই ছিল কাপুরুষ। সে পৈত্রিক সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে সে মায়ের প্রতিটা কথায় হ্যাঁ মিলায়। বউয়ের গায়ে অযথা হাত তোলে,সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়,জোয়ান পুরুষ হয়েও স্ত্রীর বাহুপাশে না ঘুমিয়ে দিনের পর দিন বুড়ি মায়ের শয্যার কোনে পড়ে থাকে। তার কোনো প্রেম নেই,ভালবাসা নেই পিতৃস্নেহ নেই,কামক্ষুধা নেই শুধু আছে অগ্নিশিখার মত সম্পত্তির লোভ।

নিজের বাহুবলে কিছু করে খাওয়ার সাহস নেই তাই মায়ের হাতে জিম্মী হয়ে মৃত বাবার সম্পত্তির দিকে শকুনের মত চেয়ে থাকে সে। মায়ের ভুল ধরিয়ে দিতে পারে না,একমাত্র ছেলে হয়েও কিছু ছিনিয়ে নিতে পারেনা শুধু কুটিল মা আর বিবাহিত বড় বোনের মন্ত্রনায় চালিত হতে পারে। আর পারে নিজের অক্ষম পুরুষত্বের সমস্ত লজ্জা ঢাকতে অসহায় বেনুর উপর হাত তুলতে। একবার নিজের স্ত্রী সন্তান হারিয়েও তার চৈতন্য হয় না। তার কাছে সব চেয়ে প্রিয় কয়এক টুকরো জমির হাতছানি।

এই জমির জন্য সে তার সোনালি যৌবনের সমস্ত সুখ,সমস্ত খুশিকে নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিতে পারে। সে একবার ভেবে দেখে না সময় চলে গেলে লাখ বিঘা জমি দিয়েও যৌবনের মধুর দিনগুলো ফিরে পাওয়া যাবে না আর। কচি বউয়ের সোহাগ,সন্তানের আবদার মাখা কথা এমন করে আর ফিরে আসবে না।

স্বামীর আচরনের আসল কারন জানার পর বেনু বুঝতে পারে তার নিজের পিঠ নিজেকেই বাঁচাতে হবে। এই বাড়িতে কেউ এমন নেই যে তার হয়ে একটা কথা কইবে।

বেনু সাবধানে থাকার চেষ্টা করে কিন্ত সবসময় পারেনা। তাছাড়া সবাই যদি তার প্রতিটা আচরনে ভুল ধরে তো সে বাঁচে কি ভাবে?সে তো আর পাথরে পরিনত হতে পারে না। তারও তো কথা কইতে হয় ,চলতে ফিরতে হয়। আসলে বেনুর স্বভাবটাই অন্যরকম। হাসিখুশি উচ্ছল স্বভাব।

বারবার বিপদে পড়লেও বিপদ কেটে গেলে সে সব ভুলে যায়। তারপর আবার বিপদে পড়ে। সে নিজের ভাল মোটেও বোঝে না। নিজের আবেগকে ঢেকে রাখতেও শেখেনি একেবারে। স্বামী আর শাশুড়ির হাতে যে এত মার খায় তবুও তার হুঁশ হয়না।

নইলে কি দরকার ছিল তার ঐ পাড়ার রমিজের সাথে কলহ করার যখন সে কিশোরী ননদটির বিয়ে নিয়ে কথা বলছিল। ঐ যে নিজের বাঁধ ভাঙ্গা আবেগ,যেটা সে কোনোদিনই সামলে রাখতে পারেনি। রমিজ হচ্ছে এক নম্বরের লুচ্চা। ডাগর কোনো মেয়ে দেখলেই তার দিকে বদ নজর দিবে। সবাই তো জানে সে পাশের গ্রামের জমিলাকে ফুসলিয়ে কি সর্বনাশ করেছে।

গ্রামের যত ভাবি সম্পর্কের মহিলা আছে তাদের সাথে দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে গল্প করতে আসে,ঠাট্টার ছলে গায়ে হাত দেয়। শুধু কি তাই?সে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েদের স্নান করতে দেখে। তার ছোট ননদ মালা কেবল এগারো ছেড়ে বারোতে পড়েছে। শরীর ফুটেছে কি ফুটেনি জামা পরা থাকলে ভাল বোঝা যায় না। এই মেয়ের কেন এখনি বিয়ের কথা হবে?তাও আবার অমন লুচ্চা লোকের মুখে।

বেনু বেশ কয়দিন ধরেই দেখছে লোকটা এদিকে বেশ ঘুর ঘুর করছে। সেদিন তো স্পষ্ট দেখেছে পুকুর ধারে ঝোপের মাঝে তাকে লুকিয়ে বসে থাকতে। অমন ক্যাটক্যাটা কমলা রঙের লুঙ্গি এই গ্রামে সে ছাড়া আর কেউ পরে না। মালা তখন উদোম গায়ে শুধু একটা প্যান্ট পড়ে নারিকেলের গুড়ি দিয়ে বাঁধানো ঘাটে আচ্ছা মত গা ডলে গোছল করছে। উঠতি বয়সের মেয়ের নগ্ন শরীর দেখে বুঝি নেশা ধরে গেছে হারামজাদাটার।

তাই বিয়ের কথার ছলে একটু নোংরামি করার সখ জেগেছে। এই পুরুষগুলোর স্বভাব দেখলে বেনুর গা জ্বলে যায়। একটা মেয়ে একটু চোখে ধরার মত হয়ে উঠলেই পাড়ার লোক যেন তার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগে। ডাগর মেয়ে চোখের সামনে চলেফিরে বেড়াবে এটা যেন তাদের জানে সয় না। হয় নিজে তাকে ভোগ করতে হবে নইলে অন্য কোনো পুরুষ তাকে ভোগ করতে পারে এমন ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

বেনুর গা জ্বলে যায় এসব দেখলে। তাই যখন সেদিন বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মালাকে দেখে রমিজ বেনুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেছিল,যে ভাবি তার ননদ তো বিয়ের যোগ্য হয়ে গেছে,পাত্র দেখতে হবে নাকি?তখন বেনু আচ্ছা করে তাকে দু কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। ভেতর থেকে শাশুড়ি বেনুর কথা শুনে তার চুলের মুঠি ধরে যে কি মার!বেনু নাকি তার ননদের ভাল দেখতে পারেনা,তার ভাল বিয়ে হোক তা চায়না। বড় ননদও তখন বাড়িতে ছিল। সেও মায়ের সাথে যোগ দিল।

স্বামী মাঠ থেকে আসলে মায়ের আদেশে সেও এক চোট মেরে নিল। তারপরে তার শাশুড়ি শান্তিতে বসে এক থালা ভাত খেল।


এমন ঘটনা বেনুর জীবনে একবার ঘটেনি। দিন দিন যেন অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলছিল আর তার সহ্যের মাত্রা যাচ্ছিল কমে। বড় মেয়ের আট বছর পর সে দুটি জমজ ছেলের জন্ম দিল।

ছেলেদের বেলাতেও শাশুড়ির সেই একই দখলদারি। তবুও একা দুজনকে সামলাতে না পারায় ছোট ছেলেটাকে সে নিজের কাছে রাখতে পেরেছিল কিছুদিন। কিন্ত পেটের মেয়ে চিরকাল শ্রু াই রয়ে গেল। তবে সেদিন সে আর সহ্য করতে পারছিল না যেদিন ক্ষুধার জ্বালায় ভর দুপুর বেলা রান্নাঘর থেকে দুটি কলা ছিঁড়ে নিয়ে পুকুরঘাটে গিয়ে খেয়েছিল এবং তা দেখে ফেলে তার মেয়ে দাদিকে নালিশ করল। ফলে শাশুড়ি তাকে স্পঞ্জের স্যান্ডেল তুলে খুব মেরেছিল।

আর বড় নন্দ তাকে চুল ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে ঘরে বন্দি করে রেখেছিল। সেদিন দুপুর থেকে সারারাত সে না খেয়ে ঘরে বন্দি ছিল। সেদিন ব্যাথার সাথে সাথে তার আর একটা জ্বালা হচ্ছিল। সেটা হচ্ছে অপমানের জ্বালা। সেদিনই সে ঠিক করেছিল এভাবে আর নয়।

এতদিনে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাই পরদিন প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে বাড়ি ছেড়ে নিজ গ্রামের দিকে যাত্রা করেছিল।

কথাগুলো বলতে বলতে বেনুর চোখ কখনো ছলছল করে ওঠে,কখনো সেখানে দেখা দেয়া অতলস্পর্শী হতাশা। সরকার বাড়ির বড় নাতনীর মনটা ভিজে ওঠে। সে অবাক হয়ে ভাবে, এ কেমন ধারা জীবন?মানুষের জীবন কি এতটা করুন হয়?তার তো বই পড়ার নেশা কিন্ত কই কোনো লেখক তো কল্পনাতেও এমন বেদনার্ত জীবন চিত্রিত করেন নি।

এ কেমন মা যে নিজের ছেলেকে এভাবে আঁচলে বেধে রেখে তার সংসারটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে?ছেলের একটা সংসার নষ্ট করেও যার সখ মেটেনি এ কেমন কালনাগিনী?কি কারন তার এমন পিশাচ হওয়ার?নিজের কানে না শুনলে সে বিশ্বাস করতো না যে মেয়ে মানুষ ও এমন হওয়া সম্ভব যে নিজ হাতে নিজের একমাত্র ছেলের জীবন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। হয়ত এদের অন্তরে কিছুই থাকে না শুধু থাকে এক মহাকাল পরিমান অতৃপ্তি। তাই হয়ত তারা অন্যের জীবনের সমস্ত সুখ আর তৃপ্তি শুষে নিতে চায়। তার মনে শুধু বিষের জ্বালা তাই সে সবাইকে জ্বালিয়ে মারতে চায়। তার অন্তরে এক বিন্দু শান্তি নেই তাই সে কাওকে শান্তি দিতে চায় না।

বেনু সত্যিই অভাগা একটা মানুষ নইলে বেছে বেছে সেই কেন ঐ বাড়ির বউ হলো?বড় কষ্ট হয় তার বেনুর কথা ভেবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।