ক্যাম্পাসের রানা ভাইয়ের দোকানটা একটু আলাদা ধরনের। ক্যাম্পাসে বিশেষত চা-সিঙ্গাড়ার দোকানের ক্রেতা সব বিভাগের শিক্ষার্থীরা হলেও এখানকার ক্ষেত্রে আলাদা। ডেবিট-ক্রেডিট, জার্নাল, ওয়ার্কশীটের সমীকরণ নিয়ে কাজ করা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষার্থীদের কারণেই এমনটা। শিক্ষার্থীরা ক্লাশের মাঝে ফুসরত পেলেই তাদের প্রথম ঠিকানা রবীন্দ্রভবনের সামনে রানা ভাইয়ের চা-সিংড়ার দোকান। গাছের ছায়ার নিচে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খুনসুটিতে মেতে ওঠেন তারা।
বিভাগের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়েও চলতে থাকে তর্ক-বিতর্ক।
গত ২০ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে সেখানে গিয়েও মিলল সেই চিত্র। দোকানের পশ্চিম কোণায় বিভাগের নিয়মিত খেলোয়াড় আর অখেলোয়াড় নিয়ে বিতর্কটা মাতিয়ে তুলেছে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২য় বর্ষের সাগর, তপু, ইমন, লিয়াকত, বিজয়, উজ্জ্বলসহ তাদের কয়েকজন বন্ধু। বিতর্কে সমানে সমান ডিপার্টমেন্টের ক্রিকেটের নিয়মিত খেলোয়াড় তপু, ইয়াছিনুর, ইমন ও তার বিরোধীদল।
ফলাফল শূন্য বির্তকের উত্তাপ কমার সঙ্গে সঙ্গে কমে গেছে কিছুক্ষণ আগে দেয়া রানা ভাইয়ের চায়ের উত্তাপও।
পড়াশোনার পাশাপাশি কোনো কাজ করেন কিনা জানতে চাইলে কিছুটা নিরুত্তাপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে তারা বললেন, ‘না। রাজশাহীতে পার্ট-টাইম কাজের সুযোগ কই? কাজ নেই, তাই আড্ডা, খেলাধূলা করে আর ঘুমিয়ে সময় কাটাই। এছাড়া আর কি-ই বা করবো। মাসও পার করতে হয় হিসাব করে। কারণ, বাসা থেকে পাঠানো টাকাই একমাত্র সম্বল।
কিন্তু দেখেন, আমাদের যেসব বন্ধুরা ঢাকা ও চট্টগ্রামে পড়ে তারা পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক টাকা আয় করে। সেখানে পার্ট-টাইম কাজের সুযোগও অনেক। নিজেরা কিছু আয় করায় তাদের আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি পেশাগত দক্ষতাও বাড়ছে। চাকরির বাজারে তাদের ডিমান্ডও (চাহিদা) বেশি। আর আমরা যারা রাজশাহীতে আছি, কাজ না থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছি।
কেউ দু-একটা টিউশনি ও কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত আছে। কিন্তু সে সংখ্যাটাও কম। আবার মাস শেষে দেয়া সম্মানীটা অনেক কম। এছাড়া আর কাজ নেই, তাই বাধ্যহয়ে কিছু শিক্ষার্থী এই কাজ করে। অনেকটা নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো।
এভাবে আগেও চলেছে এখনো চলছে। ’
ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের এমবিএ শিক্ষার্থী ভবতোষ কুমার রায়। খুলনার ছেলে ভবতোষ গত তিন বছর ধরে টিউশানি করান। তিনি জানান, রাজশাহীতে তাদের বিভাগভিত্তিক কাজের সুযোগ একেবারেই নেই। সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস ঢাকাতে হওয়ায় সেখানেই সব সিদ্ধান্ত হয়।
আঞ্চলিক অফিসগুলো তা কেবল বাস্তবায়ন করে। সেজন্য রাজশাহীতে আমাদের কাজ নেই। তাই অনেকে যুক্ত হন টিউশনি ও কোচিংয়ে ক্লাশ নেয়ার সঙ্গে। কিন্তু এখানেও সমস্যা। টাকা কম।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় একটি টিউশনি করালে কমপক্ষে ৩০০০ টাকা পাওয়া যায়। সেখানে আমি তিনটি টিউশনি করে পাই ৩৫০০ টাকা। একই মন্তব্য করেন অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের এমবিএ শিক্ষার্থী ফজলু।
তিনি বলেন, কাজ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ঘুমিয়ে ও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রোটার্যাক্ট ক্লাবের ট্রেজারার ও মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র জাহিদ রাজশাহীতে তাদের বিভাগ অনুযায়ী কাজ কেমন আছে জানতে চাইলে বলেন, মার্কেটিং কাজটা শুধু পণ্য বিক্রির সঙ্গে যুক্ত নয়।
পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌছা পর্যন্ত। পণ্য বিক্রি মার্কেটিংয়ের একটা ছোট্ট পার্ট (অংশ)। রাজশাহীতে কোম্পনিগুলোর আঞ্চলিক অফিস থাকায় সেখানে কোম্পানির নির্দিষ্ট কিছু লোক কাজ করে। শিক্ষার্থীদের সেখানে কাজের সুযোগ নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি)’র শিক্ষক ফখরুল ইসলাম বলেন, রাজশাহীতে মূলত শিল্পায়ন না হওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না।
শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট-টাইম কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। এতে করে তারা ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সেখানে মোট ৩০ জন শিক্ষক রয়েছেন। এরমধ্যে মাত্র তিনজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাকী সব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
রাবির তিনজন আবার বিভাগের ওসব ব্যাচের সবচেয়ে ভাল ছাত্র। কিন্তু ঢাবি থেকে পাস করা সেখানকার সব শিক্ষক বিভাগের সবচেয়ে ভাল ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু তারা পড়াশোনা করা অবস্থায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাট-টাইম কাজ, চাকরি সর্ম্পকিত কাজ, বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার কারণে তারা ভাইভা বোর্ডে ভাল করতে পেরেছেন। ঢাবির সব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা। পড়াশোনায় একটু দুর্বল হলেও সমস্যা হয় না।
একইভাবে রাবির শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় ভাল কিন্তু সবার সামনে স্টেজে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারে না। এই সমস্যাটা দূর করা জরুরি। এজন্য করণীয় সর্ম্পকে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ফখরুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ডিবেটের সঙ্গে যুক্ত থাকা, বিভাগের শিক্ষক ও সিনিয়র ভাইদের সঙ্গে ভাল সর্ম্পক রাখতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাগত প্রশিক্ষণও নিতে হবে। রাজশাহীর সপুরায় থাকা বিসিকের প্রসঙ্গ টেনে বিউবিটি শিক্ষক ফখরুল ইসলাম বলেন, রাজশাহীর বিসিক শিল্প সহায়তা কেন্দ্র প্রতিবছর বিভিন্ন পেশাগত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
সর্বোচ্চ ৫০ টাকা ফি দিয়ে এসব প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া যায়। এখানকার সার্টিফিকেটও পরবর্তীতে খুব কাজে লাগে।
২০১০ সালে রাবির মার্কেটিং বিভাগ থেকে এমবিএ ডিগ্রি নেয়া পার্থ বড়–য়া জানান, চাকরিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় লিখিত অংশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুব ভালো করছে। কিন্তু ভাইভা বোর্ডে গিয়ে আগের সে সাফল্য ধরে রাখতে পারছে না অ্যাটিচিউট (আচরণ) এর কারণে। বোর্ডে ঢাকার শিক্ষার্থীরা যত স্বতস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারে, এখানকার শিক্ষার্থীরা তেমনটা পারে না।
এর মূল কারণ এখানে কাজ না থাকায় তারা অলস সময় কাটায়, ঢিলেমি স্বভাব থাকে, সিরিয়াসনেসও (সচেতনতা) কম। ব্যক্তিত্ব্য ও ভালো ভবিষ্যত গড়তে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও পেশাগত মনোভাব তৈরির প্রতি জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন রাবির সাবেক শিক্ষার্থী পার্থ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।