আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিগত সরকাররে র্দুনীতিঃ ওয়ারিদের শেয়ার হস্তান্তরে আঁতাত



মাবাইল ফোন অপারেটর ওয়ারিদের ৭০ শতাংশ শেয়ার এয়ারটেলকে মাত্র ১ লাখ ডলারে হস্তান্তর করা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। যে প্রক্রিয়ায় এবং যত অল্প টাকায় শেয়ার হস্তান্তর হয়েছে তাতে বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং ‘আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং’-এর (গোপন আঁতাত) স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় মন্তব্য করে জাতীয় স্বার্থে এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি করেছে কমিটি। কমিটির সব সদস্য এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে আরও বলেছেন, আমরা মনে করি ওয়ারিদের শেয়ার হস্তান্তরে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া হয়েছে। কমিটির সভায় বলা হয়েছে, ‘ওয়ারিদের শেয়ারের বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে যে উত্তর সংসদীয় কমিটিকে দেয়া হয়েছে তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হয়নি। এ ঘটনায় বিটিআরসি’র (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) ভূমিকাও যথাযথ নয়।

২৩ জানুয়ারি ২০১০ এ অনুষ্ঠিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৩৮তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে এসব তথ্য উলে¬খ করা হয়।

বৈঠকে বিস্ময় প্রকাশ করে কমিটির সদস্যরা বলেন, এয়ারটেল বিনিয়োগ করেছে বলেই দেশ ও জনগণের স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হবে, এটা হতে পারে না। এসব বিদেশী কোম্পানি এ পর্যন্ত কত টাকা এ দেশ থেকে বিদেশে নিয়ে গেছে তার হিসাবও কমিটিকে জানাতে হবে। ৮ ফেব্র“য়ারি দৈনিক যুগান্তরে ‘ওয়ারিদের শেয়ার ক্রয়ে এয়ারটেলের জালিয়াতি’ শিরোনামে শীর্ষ সংবাদ প্রকাশিত হলে সরকারের উচ্চমহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সংশি¬ষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিষয়টির ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।

এরপর মন্ত্রণালয় থেকে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যানকে জরুরি পত্র দিয়ে যুগান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট সম্পর্কে মতামত দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এখনও বিটিআরসি এ ব্যাপারে কোন মতামত দেয়নি। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনও এই নজিরবিহীন কেলেংকারির তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে। সংশি¬ষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিটিআরসি’র বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী টেলিকম খাতের কোন কোম্পানি শেয়ার বিক্রি করলে তার সাড়ে ৫ শতাংশ ট্রান্সফার ফি হিসেবে সরকারকে দিতে হবে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এর আগে একটেল ও সিটিসেলের শেয়ার হস্তান্তর থেকে সরকার প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকা পেয়েছিল। একটেলে একে খান গ্র“পের ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল। সেই শেয়ার ৩৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নেয় জাপানের এনটিটি ডকুমো। ওই শেয়ার বিক্রি থেকে তখন সরকার প্রায় ১৩২ কোটি টাকা ফি পেয়েছিল। এর আগে সিটিসেলে প্যাসিফিক টেলিকমের শেয়ার সিং টেলের কাছে হস্তান্তর থেকে সরকার শত কোটি টাকা পেয়েছিল।

ওয়ারিদের ঘোষণা অনুযায়ী ১ লাখ ডলারে ৭০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি অনুমোদন করায় সরকার পেয়েছে মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার ডলার বা ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। সংশি¬ষ্টরা বলেছেন, কোন পাগলও বিশ্বাস করবে না, মাত্র ১ লাখ ডলারে এত বড় কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ার দিয়ে দেয়া হবে। ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৩৮তম বৈঠকের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানিয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। বৈঠকে সংসদ সদস্যরা এ ঘটনাকে রীতিমতো ভয়ংকর বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়, ওয়ারিদের শেয়ার হস্তান্তরে স্বচ্ছতার অভাব ছিল এবং সরকারের ভূমিকা যথাযথ ছিল না বলেও কমিটির সদস্যরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর ১৫ দিন পার হলেও এ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় বা বিটিআরসি থেকে কোন অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়নি।

ভারতের সর্ববৃহৎ মোবাইল অপারেটর ভারতীয় এয়ারটেল বাংলাদেশে মোবাইল খাতে লাভজনক বিনিয়োগ করতে এসে বড় ধরনের কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়ে। গোপন সমঝোতায় মধ্যপ্রাচ্যের ধাবি গ্র“পের মালিকানাধীন ওয়ারিদের ৩শ’ মিলিয়ন ডলারের (প্রায় ২ হাজার ২শ’ কোটি টাকা) শেয়ার মাত্র ১ লাখ মার্কিন ডলারে ক্রয় করার দাবি করেছে এয়ারটেল। বিশেষ যোগসাজশের কারণে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি নজিরবিহীনভাবে এয়ারটেলের এই অবিশ্বাস্য মূল্যের শেয়ার ক্রয় অনুমোদন করে। এভাবে এয়ারটেল একদিকে বাংলাদেশ সরকারকে কমপক্ষে দেড়শ’ কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে, অপরদিকে কাগজপত্রে ১ লাখ ডলার দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি ওয়ারিদকে পরিশোধ করা হয়েছে হুন্ডির মাধ্যমে।

দেশের মানিলন্ডারিং আইনে যা গুরুতর অপরাধ। এ নিয়ে শুরু থেকেই ভয়াবহ ‘আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং’ কিংবা বড় ধরনের গোপন আঁতাত করা হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল। এই গোপন আঁতাত বা সমঝোতার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরাসহ অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।

কমিটির সভাপতি ডক্টর অলি আহমদ বীরবিক্রম এমপি বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ হলেই দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা হয় না। বিদেশী মোবাইল কোম্পানিগুলো এ পর্যন্ত কত টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে তারও হিসাব যাচাই করতে হবে।

তিনি বলেন, কমিটির ১৪তম বৈঠকে ওয়ারিদের শেয়ার কিভাবে এত অল্প মূল্যে ভারতীয় এয়ারটেলের কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত হল এবং এতে সরকারের কত টাকা ক্ষতি হয়েছে, তা বিটিআরসি নিরূপণ করে মন্ত্রণালয়ের মতামতসহ অবহিত করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে যে উত্তর দেয়া হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হয়নি।
কমিটির অন্যতম সদস্য আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরও এ ঘটনায় সবার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি শেয়ার হস্তান্তরের এই ঘটনায় দেশের স্বার্থ বিবেচনা করা হয়নি বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, বাংলাদেশে ৪টি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি ছিল।

দেশীয় এই কোম্পানিগুলো বন্ধ করে দিয়ে বিদেশী কোম্পানিকে একের পর এক ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার কারণে দেশীয় লোকদের পরিবর্তে এই টেলিপ্রযুক্তি বিদেশে চলে গেছে। এতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির সুযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করতে গিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে অন্যায় করা হয়েছে। অথচ একই অপরাধে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে শুধু জরিমানা করে লঘুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

একই অপরাধে গ্রামীণফোনকে জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হল। কিন্তু দেশীয় কোম্পানিগুলোকে জরিমানা না করে কার্যক্রম বন্ধ করে লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে। এটা অন্যায় করা হয়েছে এবং তা শোধরানো দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর আরও বলেন, দেশীয় কোম্পানিগুলো বন্ধ করে দিয়ে বিটিআরসি এদেশে ঔপনিবেশিকতা সৃষ্টি করেছে। এজন্য মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসিকে জবাবদিহি করতে হবে।



এর আগে ৯ জানুয়ারি বিরোধীদলীয় নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে বলেন, ‘ধাবি গ্র“পের কাছ থেকে ওয়ারিদ টেলিকমের ৭০ শতাংশ শেয়ার ক্রয়ের সময় সরকার অবৈধভাবে এয়ারটেলকে ৪শ’ কোটি টাকার ট্রান্সফার ফি মাফ করেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। ইতিপূর্বে জাপানি কোম্পানি ডকুমো যখন একটেলের ৩০ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করে তখন আমাদের সরকার ১৩৫ কোটি টাকা ট্রান্সফার ফি আদায় করে। কিন্তু এবার সরকার ভারতীয় এয়ারটেলের কাছ থেকে কোন ট্রান্সফার ফি গ্রহণ করেনি। পরে বিটিআরসি চেয়ারম্যান ব্যাখ্যা প্রদান করেন, ভারতীয় এয়ারটেল মাত্র ৭০ লাখ টাকায় অর্থাৎ ১শ’ টাকার প্রতিটি শেয়ার ৬ পয়সা দরে ক্রয় করেছে। ’

ওয়ারিদের শেয়ার কেলেংকারি প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান আরও বলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনসহ অন্যান্য প্রচলিত আইন অনুযায়ী এয়ারটেলের কাছে ওয়ারিদের শেয়ার হস্তান্তর করা হয়েছে।

এতে বাংলাদেশের কোন ধরনের স্বার্থহানি ঘটেনি। শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়টি দেখাশোনা করে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট এক্সচেঞ্জ কোম্পানি এবং সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন। শেয়ার হস্তান্তরে বিটিআরসি’র কোন ভূমিকা নেই। সম্ভবত ১৯৯৫ সালে কমিশনের একজন সদস্য নথিতে শেয়ার হস্তান্তরে ১ শতাংশ রাজস্ব প্রদানের বিষয়টি লেখেন। সেটা কমিশনের সিদ্ধান্ত ছিল না।

শেয়ার যে কোন সময় হস্তান্তরিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শেয়ার হস্তান্তরে ফি আরোপ করার বিষয়ে মোবাইল কোম্পানিগুলো আপত্তি জানিয়েছে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।