আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইমরান খান কি ফেঁসে গেছেন!

পাকিস্তানি তালেবানের নেতৃত্ব ইমরান খানকে বিপদে ফেলেনি, ইমরান খান নিজেই নিজেকে বিপদে ফেলেছেন। সরকারের সঙ্গে তালেবানদের শান্তি আলোচনার জন্য গঠিত কমিটিতে ইমরান খানের নাম যুক্ত করা সত্যিই বড়ধরনের একটি ধাক্কা। কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তালেবানদের সঙ্গে আলোচনার জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করেন। তখনই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, ওই কমিটিতে আলেম ও রাজনীতিকদের কেন রাখা হয়নি। এবার তালেবানদের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে, এই কমিটিতে আলেম ও রাজনীতিককে কেন রাখা হলো।

সাধারণ মানুষ মনে করছে, ইমরান খান সমস্যায় পড়ে গেছেন। কেউ কেউ আগে থেকেই তাকে 'তালেবান খান' বলত। এবার তো তালেবানরাই ইমরান খানকে তাদের মুখপাত্র বানিয়ে নিয়েছে। এর দ্বারা এ কথার স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে যে, ইমরান খান ভেতরে ভেতরে তালেবান।

তবে আমার নগণ্য মত সম্পূর্ণ এর উল্টো। ইমরান খানকে তালেবানরা তাদের আলোচনা টিমে রাখুক বা না রাখুক ইমরানবিরোধীরা তার ওপর অভিযোগ আরোপ থেকে কখনো পিছপা হবে না। তালেবানরা একজন ক্লিন শেইভড রাজনীতিককে তাদের আলোচনা টিমে যুক্ত করায় মাওলানা ফজলুর রহমান তাকে ইহুদিদের এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইমরান খানের ওপর আস্থার প্রকাশ ঘটিয়ে তালেবানরা এই বার্তা দিতে চাচ্ছে যে, যেসব পাকিস্তানি দাড়ি রাখে না আমরা তাদের বিরুদ্ধে নই।

আমার জানামতে, তালেবানদের ভেতরের কিছু লোক ইমরান খানের ব্যাপারে আপত্তি করেছে।

তাদের বক্তব্য হলো, ইমরান খানের অবয়ব শরিয়ত অনুযায়ী নয়। তবে তালেবানদের বেশির ভাগের মত হলো, আমরা ইমরান খানকে দিয়ে শরিয়ত বাস্তবায়ন করবো না, বরং শান্তি আলোচনা করাবো। ইমরান খান সবসময় সেনা অভিযানের পরিবর্তে শান্তি আলোচনার কথা বলে আসছেন। সুতরাং ইমরান খানের মাধ্যমে আলোচনায় কোনো সমস্যা নেই। এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ যে, ইমরান খান আইন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।

তিনি অতীতে অনেকবার এ কথা বলেছেন, আইনের ভেতরে থেকে সরকার ও তালেবানদের মধ্যে আলোচনা জরুরি। তালেবানদের গঠিত আলোচনা টিমে ইমরান খান ছাড়াও মাওলানা সামিউল হক, প্রফেসর ইবরাহিম খান এবং মুফতি কেফায়াতুল্লাহও আইন এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তারা নির্বাচনেও অংশ নেন।

তালেবানদের গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটির চারজনই গণতন্ত্রের মাধ্যমে পরিবর্তনে বিশ্বাসী। এই লোকদের কমিটিতে যুক্ত করার কারণে আমার তো এটা মনে হচ্ছে যে, তালেবানরা গণতন্ত্রবিরোধী নয়।

মানুষের মনের অবস্থা তো একমাত্র আল্লাহ জানেন। তবে আমার মত হলো, তালেবানরা তাদের গঠিত কমিটির মাধ্যমে পাকিস্তানের আইনকে স্বীকার করে নিয়েছে। আমার কাছে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, তালেবানের শান্তি আলোচনা টিমের পাঁচ সদস্যই সবসময় আত্মঘাতি হামলায় নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং তারা এর নিন্দা জানিয়েছেন। ওই পাঁচ সদস্যকে নিজেদের টিমে যুক্ত করায় তালেবানদের পক্ষ থেকে এই বার্তাও এসেছে, আত্মঘাতি হামলার বিরোধিতাকারীদের হত্যা করা জরুরি নয়।

তালেবানের গঠিত কমিটিতে পাকিস্তান লাল মসজিদের খতিব মাওলানা মাওলানা আব্দুল আজিজও রয়েছেন।

তিনি আলটিমেটাম দিয়েছেন, যতক্ষণ না সরকার দেশে শরিয়ত বাস্তবায়নের ওয়াদা করবে ততক্ষণ তিনি ওই কমিটিতে যোগ দেবেন না। আমি মাওলানা সাহেবের কাছে আরজ করবো, প্রথমে আলোচনা কমিটিতে যোগ দেয়ার সম্মতি প্রকাশ করুন; পরে কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে বসে আলোচনার ভিত্তিতে একটি এজেন্ডা ঠিক করুন। সবার সম্মতিতে ঠিক হওয়া বিষয় শর্ত হিসেবে যোগ করতে পারেন।

মনে রাখবেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ইসলামের ওপর ভিত্তি করে। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ পাকিস্তানের মুসলমানদের জন্য বাস্তবেই এমন একটি শাসনতন্ত্র দিতে চেয়েছিলেন যা হবে ইসলামের অনুশাসন উপযোগী।

কায়েদে আজম স্টেট ব্যাংককে এই নির্দেশনাও দিয়েছিলেন, পাকিস্তানে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কিন্তু কায়েদে আজমের ইন্তেকালের পর আমরা তা ভুলে গেছি। কায়েদে আযম যে কেউই হোন, তিনি একজন ক্লিন শেইভড মুসলমান ছিলেন। তা সত্ত্বেও তার ওপর মাওলানা হাসরত মোহানি থেকে শুরু করে মাওলান শিব্বির আহমদ উসমানি পর্যন্ত হাজারো আলেম আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কায়েদে আজম পাকিস্তান বন্দুকের জোরে প্রতিষ্ঠা করেননি; বরং রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে করেছেন।

কায়েদে আজমের পাকিস্তানে বন্দুকের জোরে কখনো শরিয়ত প্রতিষ্ঠা লাভ করবে না। এজন্য শরিয়ত প্রতিষ্ঠার দাবিতে নিরাপত্তা ফেরানোর চেষ্টাকে বানচাল করা উচিত নয়।

কারো কারো ধারণা হলো, পাকিস্তান তালেবান তাদের আলোচনা কমিটিতে চারটি রাজনৈতিক দলের নেতাকে যুক্ত করে মূলত রাজনীতি করেছে। তাদের কেউ একজনও ওই কমিটিতে যুক্ত হতে অস্বীকার করলে তালেবানরা বলবে, আমরা তো শান্তি আলোচনায় প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু রাজনীতিকরা আমাদের সহযোগিতা করেননি। আমার মতে, সরকারের গঠিত আলোচনা কমিটিও ঠিক, তালেবানদেরটাও ঠিক।

সরকার গঠিত কমিটিতে রুস্তম শাহ মেহমেন্দ ইমরান খানের দল তেহরিকে ইনসাফের নেতা। আর তালেবানদের টিমে খোদ ইমরান খানই রয়েছেন। সরকারের কমিটির একজন মেজর জেনারেল অব. আমের। তিনি বলেন, আমি একটি দ্বীনি পরিবারের সদস্য। আমি মৌলভিও আবার সেনাও।

পাকিস্তানে পারভেজ মুশাররফ যে আগুন লাগিয়েছেন তাতে মৌলভিও মরছে, সেনারাও মরছে। এজন্য আমি চাই এই গৃহযুদ্ধ বন্ধ হোক। অব. মেজর জেনারেল আমের ২০০৭ সালেও সোয়াতের 'কোজাবান্দা' এলাকায় গিয়ে মুসলিম খানের বাসায় তালেবান প্রধান মাওলানা ফজলুল্লাহ’র সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত এফএম রেডিওকে চরমপন্থার বিরুদ্ধে কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে মাওলানা ফজলুল্লাহও এফএম রেডিও’র মাধ্যমে চরমপন্থার নিন্দা জানিয়েছেন।

কিন্তু মুশাররফ সরকার আলোচনার ধারা বন্ধ করে সোয়াতে আগুন আর খুনের খেলায় মত্ত হয়।

আমাকে কয়েক সাংবাদিক বন্ধু বলেছেন, সরকার গঠিত আলোচনা কমিটির সদস্যরা তালেবানদের ব্যাপারে সহানুভূতি পোষণ করেন। আমি জবাবে বলেছি, তাদের চারজনই যদি পাকিস্তানের আইন ও গণতন্ত্রের সঙ্গে থাকেন তাহলে আমাদের কোনো অভিযোগ থাকা উচিত নয়। এবার তালেবানদের গঠিত কমিটির বেশির ভাগ সদস্যও আইন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। দুই পক্ষ যখন যেখানে ইচ্ছা বসে আলোচনার সূত্রপাত করতে পারে।

ইমরান খান, মাওলানা সামিউল হক, প্রফেসর ইবরাহিম, মুফতি কেফায়েতুল্লাহ এবং মাওলানা আব্দুল আজিজ সম্মিলিতভাবে সামনে বাড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। আন্তর্জাতিক কোনো শক্তি এবং কোনো গোয়েন্দা সংস্থা এই আলোচনায় নিজেদের এজেন্ডা চাপিয়ে দিতে পারবে না। এই দুই কমিটি মিলে যা সিদ্ধান্ত নেবে সরকার তাই বাস্তবায়ন করবে।

মূলত তালেবানের আলোচনা কমিটিতে নাম আসায় ইমরান খান ফাঁসেননি, ফেঁসেছে তালেবান ও সরকার। আলোচনা শুরু হলে তালেবান তাদের চরমপন্থামূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে আসতে হবে; আর সরকারকে অন্যায়ভাবে প্রতিরোধের পথ পরিহার করতে হবে।

এভাবে এক পর্যায়ে তালেবান ও সরকার মিলে আমেরিকাকে আহ্বান জানাবে ড্রোন হামলা বন্ধ করতে। তখন সমস্যায় পড়বে আমেরিকাও। এখন তো গোটা পাকিস্তানই সমস্যায় নিপতিত। তবে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইমরান খানের উচিত, সামনে অগ্রসর হওয়া এবং শান্তি আলোচনা শুরু করে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করা।

৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সোমবার পাকিস্তানের দৈনিক জং-এ প্রকাশিত (অনুবাদকৃত)।  

 

হামিদ মীর: পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক; প্রধান নির্বাহী, জিও টিভি

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।